মতামত

আমি সিরাজুল আলম খান বলছি –একটি রাজনৈতিক পর্যালোচনা

-অপু সারোয়ার

 শ্রমিক লীগ

সিরাজুল আলম খান শ্রমিক লীগ গঠনের পিছনের কাহিনী লিখেছেন। জনাব খান ছিলেন প্রধান চালিকা শক্তি। আত্ম জীবনীতে জনাব খান শ্রমিক সংগঠনকে  দাঁড় করানোর জন্য আঞ্চলিকতা ও পদ পদবীর লোভ দেখিয়ে অন্য সংগঠন থেকে লোক ভাগিয়ে আনার জঘন্য সত্যকে প্রকাশ করেছেন সিরাজুল আলম খান ।  জনাব খানের ভাষায় “এলাকার শ্রমিক নেতারা যাঁদের অধিকাংশের বাড়ি ছিল নোয়াখালী। আমি এই নোয়াখালী সূত্রটিকে খুব সফলভাবে কাজে লাগাতে  পেরেছিলাম। ” (পৃষ্টা ৭১)। ” আব্দুল মান্নানকে  সমাজবাদী দল থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেই অতি সহজে রাজি হলেন। আগামীতে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হওয়া এবং শ্রম মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আছে বলাতে প্রথমে উনি বিষয়টিকে হালকাভাবে নিলেন। কিন্ত কাজের ক্ষেত্রে আমার দক্ষতা এবং মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যাক্তিগত সম্পর্ক দেখে তিনি তা বিশ্বাস করলেন। কাজটি যে সমাজবাদী দলের নেতাদের অগোচরেই করতে হবে সেটাও তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হলাম। ” পৃষ্ঠা ১০৪।

আব্দুল মান্নান , সাইদুল হক  সাদু , রুহুল আমল ভূঁইয়াদেরকে দলে টানতে সক্ষম হয়েছিলেন সিরাজুল আলম  খান । এই শ্রমিক নেতারা যুদ্ধ পূর্ব কালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভাল ভূমিকা রেখেছিলেন। এই শ্রমিক নেতারা ছিলেন প্রধানতঃ লেবার-বুরোক্র্যাট। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণীকে সংকীর্ণ গন্ডিতে ধরে রাখাই হচ্ছে এই শ্রেণীর শ্রমিক নেতাদের কাজ। জনাব খান  লিখেছেন  রুহুল আমিন ভূঁইয়া একই প্রায় একশত শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে আগ্রহী কেউ প্রায় একশ শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে যুক্ত থাকা হচ্ছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা।

পদ পদবীর লোভ যাদেরকে পেয়ে বসে তাঁরা খুব বেশি সময় গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামে টিকতে পারে না। সিরাজুল আলম খানের হাতে গড়া শ্রমিক নেতারা সকলেই যুদ্ধত্তোর দেশে ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হয়েছে। যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে আওয়ামলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন আব্দুল মান্নান, সাইদুল হক  সাদু  । কারণ প্রাপ্তির সম্ভবনা অনেক  বেশী ছিল । পরবর্তী সকল  ক্ষমতার পালা বদলের সাথে রাজনৈতিক দিশা পরিবর্তন হয়েছে সাদুদের। ।  আঞ্চলিকতাকে কাজে লাগিয়ে আদমজীতে সন্ত্রাস কায়েমের মধ্যে দিয়ে সামরিক শাসন বিরোধী , শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আন্দোলন গড়ে না উঠতে পাড়ার কাজে সাদুরা শক্ত খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিপরীতে সাদুরা ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় বেঁচে থেকেছে।  জনাব খান শ্রমিক লীগ গঠনে যাঁদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন তাদের সকলের শেষ নিরাপদ আশ্রয় স্থল হয়েছিল জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার।  মোহাম্মদ শাহজাহান, রুহুল আমিন ভূঁইয়ারা এরশাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন। শ্রমিক নেতা মেজবাউদ্দিন আহমেদ সরাসরি এরশাদের রাজনীতিতে যোগ দেন নাই। তিনি এরশাদের সামরিক শাষনামলে জাসদ – মির্জা সুলতান রাজা গ্ৰুপে ছিলেন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার সংবিধান সংশোধনের প্রযোজন হয়ে পড়ে । মির্জা সুলতান রাজা ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। মির্জা সুলতান রাজা – ( জাসদ রাজা ) সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সংসদে ভোট দিয়েছিলেন। প্রতক্ষভাবে শ্রমিক নেতা  মেজবাউদ্দিন আহমেদ নিরাপদ দূরত্বে থেকে এরশাদের সামরিক শাসনের সমান্তরালে পা ফেলেছেন।  শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন নুরুল হক নামের নোয়াখালীর একজন শিল্পপতি। নুরুল হকের আঞ্চলিক পরিচয় আলোচ্য বিষয় নয়। শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক শ্রম শোষণের বিষয়টি হচ্ছে মুখ্য। শ্রমিক সংগঠন গঠনের প্রধান ভূমিকার জন্য সিরাজুল আলম খান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাথে শিল্পপতিকে শ্রমিকদের ঘাড়ের উপর নির্বিঘ্নে চাপিয়ে দেওয়ার জনাব খানের ভূমিকা স্মরণ রাখা দরকার। ইতিহাস যত লম্বাই হোক, শেষ পর্যন্ত ফলাফল দিয়েই বিচার করে মানুষ।

তাজুলের খুন এবং সাদু – সিরাজ – জেনারেল এরশাদ

জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারী করেন। তখনো জনাব খান জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন বা ‘অদলীয় ‘ ভাবে সিদ্ধিদাতা ছিলেন। সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠার শুরুতে অসম রবের নেতৃত্বে জাসদ ভাগ হয়ে এরশাদের সমর্থক হয়ে যায়। এরশাদের সামরিক শাসনের তল্পিবাহক হিসেবে জাসদ রব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আর সিরাজুল আলম খান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন জেনারেল এরশাদের সিদ্ধিদাতা হিসেবে। জনাব খানের ভাষায় ” এরশাদের সঙ্গে আমার সব মিলিয়ে চারবার দেখা হয়েছে। প্রথম সাক্ষাতেই আমার ১৪ দফা কর্মসূচির প্রাথমিক খসড়া নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়। উপজেলা ভিত্তিক প্রশাসন ব্যবস্থা আমার ও তাঁর উভয়েরই প্রস্তাবিত কর্মসূচি। .” – পৃষ্ঠা ২১১।

এরশাদ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে উপজেলা পরিষদের কাঠামো তৈরি করে নির্বাচনের ঘোষণা  দেয় ১৯৮৪ সালে। আজকের দিনে উপজেলা প্রশাসন হিসেবে পরিচিত প্রশাসন তৎকালীন সময়ে সাধারণের কাছে থানা প্রশাসন নামে পরিচিত ছিল। থানা প্রশাসনের প্রধানকে বলা হত সার্কেল অফিসার -সিও । সার্কেল অফিসারদের পরিবর্তিত পদবী হচ্ছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ভিন্ন তৎকালীন সময়ে প্রশাসনের মৌলিক কোন পরিবর্তন না এনেই জেনেরাল এরশাদ উপজেলা নির্বাচন ঘোষণা করেছিল ১৯৮৪ সালের শুরুতে। পরবর্তীতে নিম্ন আদালতের বিচারকার্য উপজেলাতে স্থানান্তরিত হয়। নিম্ন আদালতের কার্যক্রম ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে নতুন কিছু সরকারী দফতর উপজেলা প্রশাসনের সাথে যুক্ত হয়েছে।  কোন মৌলিক পরিবর্তন আসে নাই। আসার মত কোন উপাদান উপজেলার মধ্যে ছিল না। সিরাজুল আলম খান উপজেলা ব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ার জন্য জেনারেল এরশাদের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। জনাব খান লিখছেন ” কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁরই [ জেনারেল এরশাদ ] দলের সংসদ সদস্যদের চাপে  তিনি উপজেলা ব্যবস্থার বহু কিছুতে সংসদ সদস্যদের প্রভাব খাটানো সুযোগ করে দেন, যা ছিল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যে বিরোধী।  পৃষ্ঠা ২১১ ।

পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো।  সিরাজুল আলম খান এই কাজটি করেছেন মাত্র। প্রথম উপজেলা ঘোষনা আসে ১৯৮৪ সালে।  সেলিম – দেলোয়ার-তাজুলের রক্তস্নাত গণ আন্দোলনের চাপে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। ১৯৮৫ সালে অতি অল্প রাজনৈতিক বিরোধিতায় প্রথম উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল। এরশাদের আমলের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৬ সালের মে মাসে । ১৯৮৫-১৯৮৬ সালের মধ্যে এরশাদের কোন সংসদ ছিল না।  সংসদ সদস্যদের চাপের কোন প্রশ্নই উঠে না। এইসময়কালে উপজেলা প্রশাসন – স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার কোন বিশেষ অগ্রগতির নজির নাই। এরশাদ কর্তৃক উপজেলা ব্যবস্থার বেশ কিছু পরিবর্তনের অভিযোগ এনেছেন সিরাজুল আলম খান । তবে স্পষ্ট করে দিক নির্দেশনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন একক ভাবে এরশাদ কি পরিবর্তন এনেছেন।

১৯৮৪ সালের ১ মার্চ ১৫ দল ও ৭ দল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছিল। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদও  ১০ দফা দাবিতে একই দিন কল-কারখানায় ২৪ ঘণ্টা ধর্মঘট ডেকেছিল। শ্রমিক কর্মচারী পরিষদের হরতালের অন্যতম দাবী ছিল রাষ্ট্রায়ত্ব কল-কারখানাকে নাম মাত্র মূল্যে বেসরকারী করণের বিরোধিতা। ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ হরতালের সমর্থনে মিছিলে সামরিক বাহিনীর ছাত্র মিছিলে সামরিক ট্রাক চাপা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সেলিম – দেলোয়ারকে হত্যা করেছিল। ট্রাক চাপায় মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছিলেন ছাত্রনেতা আব্দুর সাত্তার, মুন্সী মুজিব সহ বেশ কয়েক জন। এরশাদের বিরুদ্ধে আগের কোনো কর্মসূচিতে আদমজিতে কাজ বন্ধ করা সম্ভব হয়ে উঠে নাই সাদুদের জন্য । হরতাল ও শ্রমিক ধর্মঘট সফল করার জন্য আদমজী শিল্প এলাকায় সক্রিয় ছিল টিইউসি – কমিউনিস্ট পার্টি। তাজুল ইসলাম ছিলেন টিইউসি – কমিউনিস্ট পার্টির নেতা।  “ দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজীতে ধর্মঘট প্রস্তুতির মিছিলে হামলা চালিয়ে খুনি এরশাদের মদদপুষ্ট ছায়াদুল্লাহ সাদুর গুণ্ডাবাহিনী ছুরিকাহত ও মাথা থেতলে দেয় শ্রমিক নেতা বীর কমরেড তাজুল ইসলামকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১ মার্চ হরতাল চলাকালে কমরেড তাজুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। – ( একতা ০৩ মার্চ, ২০১৯)

তাজুলের মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা ছিল না।  আদমজিতে শ্রমিক ধর্মঘট সফল করতে শ্রমিক-মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন তাজুল ইসলাম । সিরাজুল আলম খান ও এরশাদের স্বপ্ন উপজেলা নির্বাচন বাস্তবায়নের বিরোধিতা করায় এরশাদের পেটুয়া বাহিনী হত্যা করেছিল তাজুল ইসলামকে। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস যুদ্ধ পূর্ব  কালে সিরাজুল আলম খান এবং আদমজীর সাইদুল্লাহ সাদু রাজনীতিতে কাছাকাছি এসেছিল। যুদ্ধত্তোর কালে সিরাজুল আলম খান এবং আদমজীর সাইদুল্লাহ সাদু  সামরিক শাসক এরশাদের রাজনীতির বাস্তবায়নের জন্য এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। নাঙ্গা তলোয়ার হাতে সাইদুল্লাহ সাদু তান্ডব চালিয়ে বিরোধীদেরকে গুম খুন করেছে আদমজীতে । সিরাজুল আলম খান জ্ঞানী – দার্শনিক মানুষ খাতা কলম নিয়ে হাজির ছিলেন বুদ্ধিবিত্তিক ভাবে এরশাদের রাজনীতির পক্ষে। তাজুল ইসলামের খুনের সাথে সিরাজুল আলম খানের কোন যোগাযোগ নেই। তবে তাজুল খুন হওয়ার রাজনীতির নেপথ্যের অগ্রপথিকদের একজন হচ্ছেন সিরাজুল আলম খান।

আব্দুল মান্নান – লাল বাহিনী

শ্রমিক লীগ গঠনে শেখ মুজিবর রহমানের ছিটে ফোটা উদ্যোগের কথা জনাব খানের বয়ানে উঠে আসে নাই।  জনাব খানের ভাষ্যে শ্রমিক সংগঠনের ধারণা তিনিই শেখ মুজিবর রহমানকে দিয়েছিলেন। -( সূত্র:  পৃষ্ঠা ১২৫/১২৬) । বামপন্থী নেতা ও সাংবাদিক নির্মল সেনেই বক্তব্যের ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। শ্রমিক লীগের প্রধান কান্ডারি ছিলেন আব্দুল মান্নান। শ্রমিক লীগে যোগ দেওয়ার আগে আব্দুল মান্নান ছিল তৎকালীন চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । চটকল ফেডারেশন ৬ দফার সমর্থক ছিল। ” এ সময় [ ১৯৬৬ ] গ্রেফতার হয়ে যায় আমাদের ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান ও আমাদের নেতা কমরেড নেপাল নাহা। …….জেলখানায় নেপালদার সঙ্গে শেখ সাহেবের আলোচনা হয়েছিল। শেখ সাহেব বলেছিলেন আসুন এক সঙ্গে দল করি। ……. ১৯৬৯ সালে শেখ সাহেব জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আবার আমাদের ডেকেছিলেন। তার প্রস্তাব ছিল একসাথে শ্রমিক ফ্রন্ট গঠনের। তিনি আলোচনা করেছিলেন আমাদের অন্যতম নেতা রুহুল আমিন কায়সারের সঙ্গে তাঁর ৩২ নামবে সড়কের বাসায়।.” ( সূত্র : আমার জবানবন্দি – নির্মল সেন – পৃষ্ঠা ২৫২-২৫৩) .। নির্মল সেন আরো লিখছেন ” আমাদের পূর্ব পাকিস্তান চটকল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুল মান্নান। ৬দফা আন্দোলনে সে জেলে গিয়েছিল। মনে হয় ওখানেই তার আওয়ামীলীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়। ” –( সূত্র : আমার জবানবন্দি – নির্মল সেন – পৃষ্ঠা ২৬৪) । নির্মল সেনের বক্তব্য থেকে শ্রমিক সংগঠনের ব্যাপারে শেখ মুজিবর রহমানের দৃষ্টি ভঙ্গি ও উদ্যোগে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সিরাজুল আলম খানের বই থেকে জানার কোন উপায় নেই আব্দুল মান্নান ৬ দফার সমর্থক ছিলেন। ৬ দফার জন্য জেলে ছিলেন। জেল খানায় শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আব্দুল মান্নানের কথা বলার সম্ভবনা ও সুযোগ ছিল। নির্মল সেন অকপট ভাবে স্বীকার করছেন সিরাজুল আলম খান চটকল ফেডারেশন থেকে লোক ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

নির্মল সেনের  বক্তব্যের সামাজিক  গ্রহণ যোগ্যতা বেশি। রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্মল সেনদের দল শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল দাঁড়াতে পারে নাই। তবে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের কোন শাসক গোষ্ঠীর সাথে আঁতাতের অপবাদ নির্মল সেনের বিরুদ্ধে নেই। ১৯৭২-১৯৭৫ সালে  শেখ মুজিবের শাসনামলের বিরুদ্ধে নির্মল সেন শক্ত হাতেই কলম ধরে ছিলেন।  আরো বড় বিষয় হচ্ছে নির্মল সেন নিজেদের রাজনৈতিক পরাজয়ের ইতিহাসকে সামনে এনেছে। শেখ মুজিবের ছয় দফার স্রোতে চটকল ফেডারেশনের প্রধান নেতাদের ছয় দফা পন্থী হয়ে পড়ার কথা নির্মল সেন গোপন করেন নাই। গোপন করেন নাই তাদের সংগঠনের সাথে শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক আলোচনার কথা। ইতিহাসে খুব কম মানুষই নিজের দুর্বলতা ও পরাজয়ের কারণ গুলি প্রকাশ করে থাকে। এই ক্ষেত্রে নির্মল সেনের স্বীকারোক্তি ব্যাতিক্রম। নির্মল সেনের বক্তব্য শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সিরাজুল ইসলামের একক চিন্তার ফসল এমন দাবীকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়।

সিরাজুল আলম খান বলছি বই অসংগতি, পরস্পর বিরোধী তথ্য, তথ্য বিভ্রাট, অতিকথণ, অপ্রামাণিক তথ্যের ভরপুর। শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নানকে সমাজবাদী দলের নেতা হিসেবে উল্ল্যেখ করেছেন জনাব সিরাজুল আলম খান। আব্দুল মান্নান শ্রমিক লীগের সাথে যুক্ত হওয়ার পরে  ১৯৬৯ সালের ২৯ অগাস্ট সমাজবাদী দল গঠিত হয়েছিল। পাট কল শ্রমিক ফেডারেশনের কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। ১৯৪৭ সালের পূর্বে পাট কল শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানী শাসকদের দমন পীড়নে দলের অনেক নেতারা দেশান্তরী হয়েছিলেন। বাদবাকিরা আরএসপি নাম কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চটকল ফেডারেশনের নেতা হিসেবে আব্দুল মান্নান শ্রমিক লীগের সাথে যুক্ত হন সমাজবাদী দল হিসেবে নয়। বিষয়টি মামুলি ভুল। তবে ভুল বটে। এই ভুল দিয়ে সিরাজুল আলম খানের বক্তব্যের মর্মাথের কোন পরিবর্তন হয় নাই। সিরাজুল আলম খান বলছি বইয়ের এই রকম মামুলি ভুল গুলিকে চিহ্নিত করলে বইটির সততা ও নিভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

জনাব খানের  তারকা খচিত মামুলি ভুল গুলির অন্যতম হচ্ছে : ” বিজয়ী শক্তি [ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ] হিসেবে রাশিয়া আরও ১৪টি দেশ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করে ” – পৃষ্টা ৫৫। সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন হয়েছিল ১৯১৭ সালে পুরানো জার্ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ প্রদেশ গুলিকে নিয়ে। সেভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের পর ফিনল্যান্ডকে স্বাধীনতা দিয়েছিল লেনিন-ট্রটস্কীর নেতৃত্বাধীন পার্টি। জনাব খান হয়তো ওয়ারসো সামরিক চুক্তিকে বুঝতে  চেয়েছেন। জনাব এই সব বিষয় গুলি কিন্তু খানের অজানা নয়। তিনি পড়াশুনা জানা মানুষ। কম বয়সেই কি বই পড়েছেন তার নাতিদীর্ঘ বর্ণনা সিরাজের আত্মজীবনীতেই আছে। এই সব ভুল গুলির উৎপত্তি হচ্ছে পাঠক ও ইতিহাসে প্রতি অবহেলা – অবজ্ঞা থেকে। জনাব খানের এই সব মামুলি ভুলের পিছনে আত্ম প্রচারের খাই-খাই প্রবণতা, ইতিহাস একমাত্র স্রষ্টা এই সব ধারণা কাজ করে থাকবে। এই সব ধারণা গুলির জ্বলানি হিসেবে কাজ করে আসছে মহিউদ্দিন আহমেদ এর    প্রতিনায়ক জাতীয় বই পুস্তক। লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ লিখছেন ” সিরাজুল আলম খান নিজে যেটুকু বলবেন বা অন্য কোনো চাক্ষুষ স্বাক্ষীর বয়ান থেকে যা জানা যাবে, সেটুকুই ইতিহাসের উপাদান হতে পারে।” (পৃ.৩৩৭) । অসঙ্গতি মূলক তথ্যের ভরপুর আমায় সিরাজুল আলম খান বলছি পুস্তক।  নিজেকে নিয়ে নিজের গড়ে তোলার মিথের ধ্বংসাবশেষ যা ছিল তা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন সিরাজুল আলম খানের আত্মজীবনী । সিরাজুল আলম খান ও শামসুউদ্দিন পেয়ারা ধন্যবাদ যোগ্য কাজ করেছেন।

আব্দুল মান্নান শ্রমিক লীগ গঠনের পর গুরুত্ব পূর্ন নেতা হিসেবে আবির্ভুত হন। যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে আব্দুল মান্নান লাল বাহিনীগঠন করেছিল। লাল বাহিনী মূলত তৎকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বজ্রমুষ্টি হিসেবে শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্রোহ দমন করতে ব্যবহৃত হত। লাল বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় হাজার শ্রমিক নির্যাতিত ও সহিংসতার স্বীকার হয়।১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার পর আবদুল মান্নান রাজনীতির মঞ্চ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।  শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নান ও লাল বাহিনী , শ্রমিক অঞ্চলে আঞ্চলিকতার প্রভাব পৃথক আলোচনার দাবী রাখে।

তথ্য সহায়ক

১. শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রপথিক তাজুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি -শফী আহমেদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ১ মার্চ, ২০১৮

২. শহীদ তাজুল ইসলাম, সশ্রদ্ধ অভিবাদন -হাবীব ইমন, একতা ০৩ মার্চ, ২০১৯

৩. আমার জবানবন্দি – নির্মল সেন