চলমান সংবাদ

ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের জব্বারের বলীখেলায় জীবন চ্যাম্পিয়ন

বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ চট্টগ্রামের আবদুল জব্বারের বলীখেলার ১১৩তম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন চকরিয়ার জীবন বলি। সোমবার (২৫ এপ্রিল) বিকেলে লালদীঘি সংলগ্ন জেলা পরিষদ মার্কেট চত্বরে ২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফুট প্রস্থের বালুর মঞ্চে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে এবারের বলীখেলায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লড়াইয়ে গতবারের সর্বশেষ (২০১৯) চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলীকে হারিয়ে জীবন বলী এবারের আসরে চ্যাম্পিয়ন হন। গতবার শাহজালাল বলীর কাছে হেরেই শিরোপা হাতছাড়া হয় জীবন বলীর। বলী খেলা দেখতে হাজারো দর্শক জড়ো হয়েছিল। খেলার মঞ্চের আশেপাশের এলাকা কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। বিভিন্ন ভবনের ছাদে উঠেও মানুষ ঐতিহ্যবাহী এ বলী খেলা দেখে। উল্লাসে ফেটে পড়া দর্শকরা জীবন ও শাহজালাল বলীর পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন। খেলা পরিচালনা করেন ৩৩ বছরের অভিজ্ঞ রেফারি সাবেক কাউন্সিলর আবদুল মালেক। জীবন বলী বেশ কয়েকবার শাহজালালকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করেও পারেননি। শেষ মুহূর্তে পয়েন্ট ভিত্তিতে তারিকুল ইসলাম জীবনকে বিজয়ী ঘোষণা করেন খেলার রেফারি আব্দুল মালেক। গতবার শাহজালাল বলীর কাছে শিরোপা হাতছাড়া হওয়া জীবন এবার সেই শাহজালালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরে দারুণ খুশি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। স্বপ্ন ছিল এই জব্বারের বলী খেলায় চ্যাম্পিয়ন হবো। অবশেষে চ্যাম্পিয়ন হতে পেরে ভীষণ খুশি হয়েছি। এর আগে চ্যাম্পিয়ন হতে না পেরে শপথ নিয়েছিলাম। এবার জিতবই। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে।’ এর আগে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সোমবার বিকেল ৩ টায় ঐতিহাসিক লালদীঘির চত্বরে ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলীখেলা শুভ উদ্বোধন করা হয়। বলীখেলা উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার-সিএমপি সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তার পৃষ্ঠপোষকতায় জব্বারের বলী খেলার ১১৩ তম আসরের আয়োজন করা হয়। উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন সিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার শ্যামল কুমার নাথ, শামসুল আলম, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) আমিনুল ইসলাম, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী প্রমুখ। শাহজাহান বলীকে হারাতে ২০ মিনিট লড়তে হয় জীবন বলীকে। ৩ পয়েন্টে শাহজাহানকে হারিয়ে জীবন জিতে নিয়েছেন প্রথম পুরস্কার ২৫ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট। এবারের বলী খেলায় প্রথম রাউন্ড, কোয়ার্টার ফাইনাল (চ্যালেঞ্জিং বাউট), সেমি ফাইনাল ও ফাইনালে (চ্যাম্পিয়ন বাউট) মোট ৭২ জন বলী অংশ নেন। এর মধ্যে পেশাদার’ বলীর পাশাপাশি শৌখিন বলীও রয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপের পাশাপাশি পুরস্কৃত করা হয় চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেওয়া ৪০ বলীকে। এছাড়া রানার আপ শাহজাহান বলী পেয়েছেন ১৫ হাজার টাকা। এবার তৃতীয় ও চতুর্থ হওয়া বলীর জন্যও যথাক্রমে ছয় ও পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কারের ব্যবস্থা হয়। এদিকে বলীখেলাকে ঘিরে লালদীঘির দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রোববার থেকেই শুরু হয়েছে তিন দিনের বৈশাখী মেলা, যা চলবে বুধবার ভোর পর্যন্ত। মেলায় লোকজ, গ্রামীন বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। এ মেলায় সাংসারিক নিত্য ব্যবহার্য ও গৃহস্থালি পণ্যের তালিকা থাকে ভরপুর। বিক্রেতারা হাতপাখা, শীতল পাটি, ঝাড়–, মাটির কলস, মাটির ব্যাংক, রঙিন চুড়ি, ফিতা, হাতর কাঁকন, বাচ্চাদের খেলনা, ঢাকঢোল, মাটি ও কাঠের পুতুল, বাঁশি, তৈজসপত্র, আসন, চৌকি, খাট, আলমারি, ফুলদানি, তালপাখা, টব, হাঁড়ি-পাতিল, দা-ছুরি, কুলা-চালুন, টুকড়ি, বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা, মুড়ি, মুড়কি, লাড্ডু, জিলাপির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। তবে মেলায় সবচেয়ে বেশি থাকে ঝাড়–র চাহিদা। ১৯০৯ সালে প্রথম বলী খেলার আয়োজনের পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা ১১০ বছর চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলা। এরপর করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বন্ধ থাকে এটি। করোনা প্রকোপ প্রায় নিয়ন্ত্রণে আসায় আবারও হচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ আয়োজন। এবার মেলার ১১৩তম আসর ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও বলীখেলার ভেন্যু লালদিঘী মাঠ সংস্কারের কারণে বন্ধ থাকায় এ আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আয়োজকরা বলিখেলা ও মেলা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নিজে দায়িত্ব নিয়ে বলিখেলা ও মেলার আয়োজন করেন। প্রসঙ্গত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের যুব সমাজকে সংগঠিত করতে ১৯০৯ সালে বদরপাতির আব্দুল জব্বার সওদাগর নগরীর লালদীঘি মাঠে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। পরে যা আব্দুল জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিত ও বৈশাখী মেলায় পরিণত হয়। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ জব্বারের বলী খেলা অনুষ্ঠিত হয়। জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমন্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘি ময়দানের আশপাশে প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। ১২ বৈশাখের দুই-তিন দিন আগে থেকে লালদীঘির মাঠ ও আশপাশের এলাকা নানা গ্রামীন ও হস্ত তৈরি পণ্যে ভরে ওঠে। তিন দিনের মেলা হলেও সপ্তাহব্যাপী নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে চলে বিকিকিনি। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা, শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর প্রেরণা থেকেই এই বলীখেলার আয়োজন। জব্বার মিয়ার বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। # ২৫.০৪.২০২২ চট্টগ্রাম #