মতামত

পাদুকা শিল্প  এবং শিল্পের শ্রমিকদের রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের

– ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশে পাদুকা শিল্পের যাত্রা সত্তরের দশক থেকেই। এই শিল্পের অধিকাংশ কারখানাই আকারে খুবই ছোট। এই সমস্ত কারখানার মালিকদেরকে মালিক না বলে স্বনিয়োজিত শ্রমিক বললে যথার্থ হবে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে মিলে প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক এখানে কর্মরত আছে। এই সেক্টরে কোন নারী শ্রমিক নাই তবে প্রচুর শিশু শ্রমিকের অস্তিত্ব আছে। কাঠের সিলিং দিয়ে ছোট্ট এক একটা ঘরকে দুটো ঘরে পরিণত করা হয়। এই ঘরগুলোতে মাথা সোজা করে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকেনা,  মাথা নীচু করে এবং বসে কাজ করতে হয়। এইরকম অর্ধেক ঘরই এক একটি পাদুকা ‘কারখানা’।

আলো বাতাসহীন স্যাতস্যাতে ছোট্ট ঘরেই দিনরাত একটানা ১০/১২ ঘণ্টা কাজ করেন পাদুকা শ্রমিকরা। আয়ের স্বল্পতার কারনে অধিকাংশ শ্রমিকেরা কারখানাতেই থাকে খায় আর ঘুমায়। শ্রম আইনের ৫ম অধ্যায়ে ৫১ থেকে ৬০ নং ধারায় বর্ণিত আছে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন নিয়ম কানুন। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে সচেতন নয়। সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করে এই খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা। দাহ্য পদার্থ পরিবেষ্টিত কারখানাগুলোতে আগুনের ঝুঁকি থাকলেও অগ্নি নির্বাপনের কোন ব্যবস্থা নাই। এডহেসিভ, আইকা, ফোম সহ নানা রকম কেমিক্যালের তীব্র গন্ধের মধ্যে একরকম দমবন্ধ পরিবেশে শ্রমিকেরা দিনরাত কাজ করে। মালিক পক্ষ শ্রমিকদেরকে কোন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেনা। সচেতনতার অভাবে শ্রমিকরাও এর প্রয়োজন অনুভব করেনা। কাজ করতে গিয়ে হাত কেটে গেলে, আহত হলে কিংবা অসুস্থ হলে মালিক চিকিৎসার কোন দায় নেয় না। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করা হয় কিনা তাও শ্রমিকেরা জানেনা। এই রকম অস্বাস্থ্যকর এবং কেমিক্যালযুক্ত পরিবেশে কাজ করার কারনে পেশাগত রোগের ঝুঁকি প্রবল।

এই সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের নিয়োগ পত্র, পরিচয় পত্র দেওয়া হয়না। কোন সবেতন ছুটি নাই। অধিকাংশ শ্রমিকের মাসিক নির্দিষ্ট মজুরি নাই। এরা কাজ করে কানামনা অর্থাৎ কাজ নাই মজুরি নাই ভিত্তিতে। অধিকাংশ শ্রমিকের পুরো মাস কাজ থাকেনা। মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন কাজ থাকে। দৈনিক ১০/১২ ঘন্টা কাজ করার পরও উৎপাদন হিসাব করে শ্রমিকদেরকে ২০০/২৫০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। দক্ষ কারিগর হলে মাসিক ৯০০০ থেকে ১০০০০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকে। ক্রম বর্ধমান উর্ধগতির বাজারে শ্রমিকেরা যে আয় করে তা দিয়ে তাদের পারিবার পরিজন নিয়ে জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে। না খেয়ে কিংবা অর্ধাহারে তাদের দিনাতিপাত করতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় আয় এত কম যে তাদের কোন সঞ্চয় থাকেনা।সদস্যদের অসুখ বিসুখ হলে চিকিৎসা করাতে  পারেনা। সৃষ্টি কর্তার উপর ভরসাই তাদের একমাত্র নিয়তি। শ্রমিকের চাকুরীর কোন স্থায়িত্ব নাই। কোন কারনে মালিকের রোষানলে পড়লে বিনা নোটিসে কেবল মৌখিক নির্দেশে শ্রমিকেরা চাকুরি হারায়। চাকুরীর ক্ষতিপূরন, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড কিছুই নাই।

পাদুকা শিল্পে অধিকাংশ মালিকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও খুব বেশী নয়।  আর্থিক সক্ষমতা কম হওয়ায় পাদুকা কারখানার মালিকেরা ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে ঋন পায়না। ফলে উচ্চ সুদে বিভিন্ন এনজিও বা ছোট ছোট অর্থ লগিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋন  নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে বাধ্য হয় অধিকাংশ মালিক। তাই পাদুকা শিল্প  এবং শিল্পের শ্রমিকদের রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। মালিকদেরকে স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ঋন দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৭০ এর দশকে শুরু হওয়া পাদুকা শিল্প ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভালভাবেই চলছিল। মুক্ত বাজার অর্থনীতির নামে রাষ্ট্রের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে বিদেশ থেকে অবাধে পাদুকা আমদানী করতে দেয়ায় পাদুকা শিল্প এখন মৃত প্রায়। পাদুকা শিল্পের অতিত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে দেশীয় চাহিদার ৫০% আমাদের দেশের উৎপাদিত পাদুকা দিয়ে পূরণ করার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবী। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এবং দেশের শিল্প ও শ্রমিক বাঁচবে।