মতামত

আমি সিরাজুল আলম খান বলছি – পাঠক প্রতিক্রিয়া – ৩

-অপু সারোয়ার

আহমেদ শরীফ নিউক্লিয়াস

সিরাজুল আলম খান বলছি বইয়ে অনেক স্বনামধন্য মানুষের উল্লেখ করেছেন জনাব খান। যাঁদেরকে নিউক্লিয়াসভুক্ত বা সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের প্রায় সকলেই কোন কিছু লিখে যান নাই। অথবা লিখে গিয়ে থাকলেও তা খুব বেশি প্রচার পায় নাই। ছাত্রলীগের বাইরে যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তাঁদের প্রায় সকলেই পরিণত বয়সে মারা গেছেন। মৃতের কোন জাত নেই তবে মৃত মানুষকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য বেচা বিক্রির রেওয়াজ এই অঞ্চলে জগতদল পাথরের মত চেপে বসেছে। জনাব খান মৃত মানুষকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করেছেন। জনাব খান আহমেদ শরীফকে নিউক্লিয়াস সমর্থক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

আহমদ শরীফ  (১৯২১-১৯৯৯)  শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, লেখক এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক। ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’ প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটির কথা উল্লেখ করেছিলেন শরীফ ১৯৬৫ সালে  । ১৯৭১-এর মার্চে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূর্ব বাংলার লেখকদের শপথ বাক্য পাঠ করান আহমদ শরীফ  । স্বাধীনতা পরবর্তীকালে  মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি,  কর্নেল তাহের সংসদ জাতীয় সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন বা পৃষ্টপোষকতা করেছন।  পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক যুক্তিবাদী, দার্শনিক,  মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধির ও নির্মোহ চিন্তার এক অনন্য ধারক ছিলেন ড. আহমদ শরীফ। এমন একজন মানুষ সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস অতিকথন উপাখ্যানের শিকার হয়েছেন। আহমেদ শরীফের লেখায় সমসাময়িক ছাত্রনেতাদের কথা উল্ল্যেখ থাকলেও সিরাজুল আলম খান অনুপস্থিত।

লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ সিরাজুল আলম খানের বক্তব্যকে ইতিহাস হিসেবে বর্ণনা করে খান সংকীর্তন প্রতিনায়ক শিরোনামে বই লিখেছেন  । অগাধ অন্ধ আনুগত্য ও আস্থা থাকার পরেও স্বনামধন্য মহিউদ্দিন আহমেদ জনাব খানের অতিকথনকে গোলার্ধকরণ করতে পারেন নাই। মহিউদ্দিন আহমেদ অতিকথনের স্বরূপ উম্মোচন করে লিখছেন – ” তিনি [ সি আ খা ] দাবি করছেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত—লেখক কামরুদ্দীন আহমদ এবং অধ্যাপক আহমদ শরীফ নিউক্লিয়াসের পরামর্শদাতা ছিলেন। ঢাকা ছাড়িয়ে তাঁদের এই নেটওয়ার্ক জেলা পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছিল। আহমদ শরীফের নানান লেখা ও চিঠিতে শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুল আজিজ বাগমার, আল মুজাহিদী প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতার উল্লেখ থাকলেও সিরাজুল আলম খানের প্রসঙ্গ নেই। বরং আহমদ শরীফের লেখা থেকে জানা যায়, ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের একসময়ের সভাপতি আবদুল আজিজ বাগমার স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। জানা যায়, ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে বাগমার স্বাধীনতার তিনটি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’। সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। প্রথম ইশতেহারটি লিখে দিয়েছিলেন অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। দ্বিতীয়টি বাগমারের নিজের লেখা, সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আহমদ শরীফ। তৃতীয়টি আহমদ শরীফের লেখা ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালি’। সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির উল্লেখ আছে। বাগমারের ব্যাপারে আহমদ শরীফের স্নেহ ও উৎসাহের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো বিশ শতকে বাঙালী বইটি বাগমারের নামে উৎসর্গ করা। উৎসর্গলিপিতে তিনি লেখেন, ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াসে পথিকৃৎ আবদুল আজিজ বাগমার প্রিয়বরেষু।’ বাগমারের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ছয় দফার মধ্যে বাগমার তাঁর লক্ষ্য অর্জনের দিশা পেয়ে যান। ” ( দৈনিক প্রথম আলো  ০৪ জুন ২০১৯) । আহমেদ শরীফ নিউক্লিয়াস ও সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে কেন কিছু লিখলেন নাই। আহমেদ শরীফের কলমে সিরাজুল ইসলাম খান উপেক্ষিত।

তর্কবাগীশ নিউক্লিয়াস

১৯১৯ সালে তিনি খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন মওলানা তর্কবাগীশ ৷ ১৯২২ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী  কৃষক বিদ্রোহ ঐতিহাসিক ‘সলংগা আন্দোলন’-এর নেতৃত্ব দিয়েছেন । মওলানা তর্কবাগীশ ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে  জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের নির্বাচনী এলাকা থেকে আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ।  এমন মানুষকে নিউক্লিয়াসভুক্ত করা নিঃসন্দেহে বড় ধরণের কাজ। জনাব তর্কবাগীশকে নিউক্লিয়াসভুক্ত করার কথা উল্লেখ করেছেন ‘আমি সিরাজুল আলম খান বলছি’ বইয়ের ৮২ পৃষ্টায়।  মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ লিখতে না পাড়ার ভান  -ভণিতার করেন নাই। তাঁর আত্মজীবনী মূলক বই  ” স্মৃতির সৈকতে আমি ”  ৷ এই বইতে সিরাজের কথা উল্লেখ আছে। তবে তর্কবাগীশের সিরাজ বাংলার নবাব সিরাজ-উদ দৌলা, দুর্ভাগ্য বশতঃ সিরাজুল আলম খান নন।

মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ছয় দফা প্রণয়ন ও প্রকাশ কালে আওয়ামীলীগ এর সভাপতি ছিলেন। তবে তিনি ছয় দফা বিরোধী ছিলেন। ‘বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র’ বইয়ে কাজী আরেফ আহমেদের  লিখছেন ” আওয়ামীলীগের সভাপতি মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সাহেব। ……সিরাজুল আলম খান ও আমাকে ডেকে পাঠান। …….তিনি আমাদের বললেন যে মুজিব একক ভাবে ৬ দফা কর্মসূচী দিয়েছেন। …… তিনিও ৬ দফা কর্মসূচীকে শেখ মুজিবের বাইরে কোন শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করা কাজ বলে জানান। ( পৃষ্ঠা ৩৮ ) । সিরাজুল আলম খান ‘বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন। সাধারণ ভাবে ভূমিকা লেখার আগে পুরো বই পড়ার রেওয়াজ। কাজী আরেফ আহমেদের বইকে সিরাজুল আলম খান ‘ আমার ও কথা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কাজী আরেফ আহমেদ মওলানা তর্কবাগীশের সাথে নিউক্লিয়াসের কোন ধরণের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন নাই। কাজী আরেফ এর বক্তব্যে তর্কবাগীশ স্বাধীনতা পন্থী ছিলেন না।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় মওলানা তর্কবাগীশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। এ প্রসঙ্গে আ ফ ম মাহবুবুল হক এর অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। আ ফ ম মাহবুবুল হক যুদ্ধ পূর্ব ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ -সাধারণ সম্পাদক, যুদ্ধকালীন বিএলএফ এর অন্যতম প্রশিক্ষক ছিলেন। জনাব খান বার দুই মাহবুবুল হকের কথা আত্ম জীবনীতে উল্লেখ করেছেন। আ ফ ম মাহবুবুল হক এই কথাগুলো বলেছিলেন ১৯৯৩ সালে চট্টগ্রামে  ডা. মাহফুজুর রহমান লিখিত ” বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ-নিউক্লিয়াস” বইয়ের প্রকাশনী উৎসবে। এই পুস্তক প্রকাশনী উৎসবে আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ, হাসানুল হক ইনু, মাসুদ আহমেদ রুমী সহ যুদ্ধ পূর্ব ছাত্রলীগের ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থানরত সংগঠকদের একাংশ উপস্থিত ছিলেন। ” ১৯৭০ সালের নির্বাচন দেখা হয়ে গেল তখন অশীতিপর [ বোধ হয় ] মওলানা তর্কবাগীশের। উনাকে বললাম আমরা যে ঢাকা থেকে আসলাম নির্বাচনী প্রচারণার জন্য , এখানে আমাদের দুইটি উদ্দেশ্য আছে। একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে   আমরা সংখ্যা গরিষ্টতা চাই। এই তা নিয়ে সামান্যতম মত পার্থক্যের ব্যাপার নেই। আরেকটি হচ্ছে এই নির্বাচন কিন্তু শেষ নয়। যেমন ভাষা সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট , আইউব বিরোধী সংগ্রামের পরিনতিতে আজকে আমরা এমন একটি জায়গায় এসেছি আমাদের নির্বাচনে আমরা যদি সংখ্যা গরিষ্ঠতা  পাই পাকিস্তানী  ২২ পরিবার পাকিস্তানী  শাসন ক্ষমতায় আমাদের মেনে নিবে না। সুতারং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সশস্র স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া বিকল্প কিছু থাকবে না। তিনি [ তর্কবাগীশ ] বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে কিছু ভর্ৎসনা করলেন যে নির্বাচনী বক্তিতা এটা হবে না  । ”  মাহবুবুল হক যে বিষয়কে ” ভর্ৎসনা ” বলেছেন বাস্তবে অবস্থা ছিল জটিল ও স্বাধীনতা পন্থীদের জন্য অস্বস্তিকর।

লেখক , সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মাহবুবুল হকের অবস্থা বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন । প্রসঙ্গত  সাইফুল ইসলাম ২১ জুলাই ১৯৭২ সালের ছাত্রলীগের ভাঙ্গনের সময় থেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী  ধারার রাজনীতির সাথে যুক্ত। ১৯৭৬ সালের গণবাহিনীর সাংগঠনিক কাজে অংশ নেওয়ার অভিযোগে  সামরিক শাসনের ‘ জেল – সংশোধনাগার ‘ ছিলেন বছর আড়াই। । সাইফুল ইসলাম ১৯৯০ এর দশকে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।  “ মাহবুব ভাই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক হিসেবে সিরাজগঞ্জ নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে আসেন। …… সে সময়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে আদর্শিক লড়াইটা ছিল স্বাধীনতা ও স্বায়ত্বশাসন পন্থীদে মধ্যে। এ ছাড়াও ছিল সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন। ছাত্রলীগের একটি ক্ষুদ্র অংশ স্বায়ত্বশাসনের বাইরে আসতে চাইতো না, সমাজতন্ত্রের ব্যপারেও অনীহা ছিল তাদের। তারা স্বাধীনতাপন্থীদের টেনে ধরার চেষ্টা করতো পিছন দিকে। আর আওয়ামী লীগের শেখ মুজিব ছাড়া প্রায় পুরোটাই স্বায়ত্বশাসন পন্থী। ফলে, ছাত্রলীগের সঙ্গে সহযোগি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের আদর্শিক দূরত্ব দৃশ্যমান। তারা মূলত পাকিস্তানি কাঠামোতেই রাজনীতি করতে চাইতো, তবে, পাকিস্তানীদের  মাতব্বরী অপছন্দ তাদের; সে হিসেবে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তারা আপোষহীন। অপরদিকে ছাত্রলীগের প্রধান অংশ চাইতো বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা, গড়তে চাইতো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, চাইতো সমাজতন্ত্র। ………….মাহবুব ভাই জনসভা এবং কর্মীসভা দু’টোতেই ভালো বক্তৃতা করতেন। কিন্তু তাকে সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় নিয়ে যেতে ছিল ভীষন অনীহা। কারণ, মাহবুব ভাই পাকিস্তানের সমালোচনা করতেন তীব্র ভাষায়। শুধু বলতে বাকী রাখতেন- বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জনের বিকল্প নেই- কথাটি। ভোটে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করার পাশাপাশি আরো বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বাণ জানিয়ে তিনি বক্তৃতা শেষ করতেন। তার বক্তৃতার এখানেই আওয়ামী লীগের আপত্তি। তারা মনে করতো, পাকিস্তানকে এতো তীব্র ভাষায় সমালোচনা করলে কট্টর পাকিস্তানপন্থীদের ভোট নষ্ট হতে পারে। তাই তাকে জনসভায় নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকতো আওয়ামী লীগ নেতারা, ভোটার লিস্টের কপি করেও সময় ব্যয় করতে হতো তাকে।

………. তিনি ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে প্রচুর আড্ডা দিতেন। সুযোগ পেলেই করতেন কর্মীসভা। এ সব কর্মীসভা করতে কোনও নোটিসের প্রয়োজন পড়ত না। সেখানে তিনি স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য দিতেন খোলামেলা, বলতেন ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের প্রস্তুতির কথা। পাঁচ জন কর্মী পেলেই মিছিল বের করতেন। শ্লোগান ধরতেন তিনি নিজেই। শ্লোগানের মূল সুর হতো বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেওয়া। এক হোস্টেল থেকে আরেক মেসে যেতে মিছিল করতেন, তা কর্মীর সংখ্যা যাই থাকনা কেন। তার এ মিছিলেও কর্মীদের উৎসাহের কমতি থাকতো না। যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে করতেন পথসভা।  ( জাসদ – বাসদের রাজনীতি ও আ ফ ম মাহবুবুল হক -পৃষ্ঠা ৭০ )

সাইফুল ইসলামের লেখায় মাহবুবুল হকের রাজনৈতিক দৃঢ়তা কথা উঠে এসেছে। তবে সবচেয়ে বড়   বিষয়টি সামনে এসেছে নিউক্লিয়াস বলতে কিছু ছিল না। যা ছিল তা হচ্ছে ছাত্রলীগ। নির্বাচিনী প্রচারণা হোক আর স্বাধীনতার কথাই হোক সবই ছাত্রলীগের পতাকার নিচে ।  মাহবুবুল হকের কর্মী সভার কথা উল্লেখ করেছেন সাইফুল ইসলাম । এই কর্মী সভাগুলি ছিল ছাত্রলীগের কর্মী সভা। নিউক্লিয়াসের নয়। তর্কবাগীশ যদি নিউক্লিয়াস এর চিন্তার কাছাকাছি চিন্তা করতেন তবে মাহবুবুল হকের সাথে পূর্ব পরিচয় না থাকলেও মাহবুবুল হকের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত কারণ বুঝে উঠার কথা। ১৯৬৬ সালে তর্কবাগীশ ৬ দফার বিরোধী ছিলেন। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা পন্থী আলোচনাকে অবদমন করেছেন। আর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাকের প্রশংসায় বিগলিত হয়েছিলেন মওলানা আব্দুর রশিদ। ( সূত্র বঙ্গভবনে মোশতাকের ৮১ দিন – লেখক -আবু আল সাঈদ – পৃষ্ঠা ৪৩) ।

কাকতলীয় ভাবে মওলানা তর্কবাগীশ ও সিরাজুল আলম খানের চিন্তার কিছু জায়গায় মিল আছে। কাজী আরেফে আহমেদে উল্লেখ করেছেন তর্কবাগীশ মনে করতেন বাইরের কোন শক্তি ৬ দফা প্রণয়ন করেছেন। সিরাজুল আলম খানের ৬ দফার বর্ণনায় তর্কবাগীশের চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। সিরাজুল আলম খান লিখেছেন ” পরবর্তী কালে শুনেছি ৬-দফা প্রণয়ন এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আহমেদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দস ও ড. শামসুর রহমান (জনসন) । এঁরা তিন জনই ছিলেন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের ঊচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। – (পৃষ্টা ৬৯) । যাঁরা ৬ দফা প্রণয়নে বিদেশী শক্তি বা আমলাতন্ত্রের বুদ্ধিবিত্তিক কাজ মনে করেন তারা মূলত শেখ মুজিবর রহমানের বুদ্ধিবিত্তিক সক্ষমতাকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করেন।  চীন পন্থী কম্যুনিস্টরা মনে করতো ৬ দফা সিআইএ এর দলিল।  অন্য কথায় শেখ মুজিবর রহমান  নয় বাইরের কেউ ৬ দফা প্রণয়ন করেছে। জামায়াতে ইসলামী – মুসলিমলীগ ৬ দফাকে পাকিস্থান ভাঙার বিদেশী চক্রান্ত মনে করত। তর্কবাগীশ ঠিক একই ভাবে মনে করতেন বাইরের কেউ ৬ দফা প্রণয়ন করেছে। সিরাজুল আলম খান ঠিক একই ভাবে শুনেছেন ৬ দফা আমলারা প্রণয়ন করেছেন।  এই চিন্তা গুলি পরষ্পর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ছিল। তৎকালীন সময়ের এই রাজনৈতিক শক্তি গুলির ঐক্য সম্ভব ছিল না। তবে ৬ দফার বিরোধীতাকারীদের একটা জায়গায় মিল হচ্ছে ৬ দফার কৃতিত্ব মুজিবকে না দেওয়া।

৬ দফা এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে খুব বেশি নতুন বিষয় ছিল না । এই  দাবিগুলি  রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের  ফসল। ভারত পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন প্রস্তাব পেশ করেছিল।  এই প্রস্তাব কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ – এই তিনটি বিষয় ন্যাস্ত করে। মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস উভয়ই মিশনের প্রস্তাবগুলি মেনে নিয়েছিল। পরে কংগ্রেস এই প্রস্তাব থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৫৪ সালে  যুক্তফ্রন্টের ২১-দফার  ইশতেহার প্রকাশ করেছিল। ২১ দফায় পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং মুদ্রা এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখার প্রস্তাব করেছিল । কেবিনেট মিশনের ‘যোগাযোগ’ পরিবর্তীতে ২১ দফায় মুদ্রা স্থান করে নিয়েছিল। ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৬ সাল – দুই দশক   রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক সংকট ; আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য আন্দোলন ও আলোচনা হয়েছে। এই আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতার ফসল ৬ দফা।

ঢাকার আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ!

‘ঢাকার আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ ‘ , ‘ ঢাকার আমেনা বেগম ‘, ‘ চাঁদপুরের মিজানুর রহমান চৌধুরী’ .সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ত্রিশ জন আওয়ামীলীগের স্বস্ব এলাকায় সুপরিচিত  নেতাদের  নাম উল্লেখ করে জনাব খান লিখেছেন  তিনি এইসব নেতাদের ” আমাদের পক্ষে আনতে সমর্থ হই ” ১৯৬৮ সালে   ( পৃষ্ঠা ৮১-৮২ ) । কোন মানদন্ডে সিরাজুল আলম খান যাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের কেন নিউক্লিয়াসভুক্ত ভাবা হলো তার কোন ব্যাখ্যা দিতে জনাব খান সমর্থ হন নাই। যুদ্ধ ও নির্বাচন কে কোন চিন্তার ধারক তা নির্ধারণের মাপকাঠি। ১৯৬৮ সালে জনাব খান যাঁদেরকে পক্ষে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে পুস্তকে দাবী করেছেন এর মধ্যে একজন বাদে কেউই যুদ্ধকালীন সময়ে জনাব খানদের বিএলএফের সাথে থাকেন নাই। এই হচ্ছে পক্ষে আনতে সমর্থ হওয়ার নমুনা।

সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালী জেলায়। যুদ্ধ পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি গুরুত্ব পূর্ন  ভূমিকা পালন করেছেন। যুদ্ধত্তোর বাংলদেশের এক দশকের সামান্য পর থেকে জনাব খান সামরিক শাসনের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন ১৯৮২-১৯৯০ সালে । নিজেকে নিধিরাম সর্দার এর তকমা থেকে রক্ষার জন্য জাসদ ভেঙে একাংশ নিয়ে সামরিক শাসনের সমর্থক করে রেখেছিলেন। যার পরিণতিতে প্রতিবাদী এক ঝাঁক মানুষ রাজনৈতিক ভাবে পথ হারা হয়ে পড়ে । জনাব খান ছিটকে পড়েন আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস থেকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত খান যতটুকু  আলোচিত -পরিচিত ছিলেন আজ ততটুকু নন। তবে কেউ যদি সিরাজুল আলম খানকে পরিচয় করিয়ে দিতে নামের আগে বা পরে নোয়াখালী লিখেন তবে তা  হবে অগ্রহণযোগ্য ও মারাত্মক অশোভন। আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ,  আমেনা বেগম , মিজানুর রহমান চৌধুরী এই তিন জন কোন না কোন সময় আওয়ামীলীগের সভাপতি , সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই নেতারা নিজ নামেই পরিচিত। এঁদের নামের আগে ঢাকা বা চাঁদপুর লেখার মধ্য দিয়ে এক ধরণের উন্নাসিকতার ও অসম্মান প্রকাশের পথে পা ফেলেছেন জনাব খান।

আমেনা বেগম (১৯২৫-১৯৮৯)  ১৯৫০ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬৬   ছয়দফা আন্দোলনের সূচনা পর্বে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের পর আমেনা বেগমকে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সাথে। ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে পদ- পদবী নিয়ে বিরোধে আওয়ামীলীগ রাজনীতি থেকে খসে পড়েন আমেনা বেগম। যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে আমেনা বেগমের রাজনীতি দক্ষিণ দিকে ঝুকে পড়ে। ১৯৭০ সাল থেকে আমেনা বেগম আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগের নেতা ছিলেন। জনাব খান ৬ দফা নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। তিনি ন্যায্য ভাবের বলার অধিকারী। তবে জনাব খান অন্যায্য ভাবে ৬ দফা আন্দোলনে আমেনা বেগমের ভূমিকাকে ছেঁটে ফেলেছেন পুরুষতান্ত্রিক -পিতৃতান্ত্রিক ধারায় ।

আরও পড়ুন:  আমি সিরাজুল আলম খান বলছি – পাঠক প্রতিক্রিয়া – ২

অপু সারোয়ার: লেখক ও ফ্রীলান্স সাংবাদিক