মতামত

উৎসব পালনেও শ্রমিকেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে

– ফজলুল কবির মিন্টু

আমাদের দেশে ঈদের মত একটা সর্বজনীন উৎসব পালন করার ক্ষেত্রেও বেসরকারী খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়।  বেসরকারী খাতে কর্মরত শ্রমিকদের তুলনায় সরকারী খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা অনেক বেশী সৌভাগ্যবান। কারণ সকল সরকারী শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য বৎসরে ২টি মূল বেতনের সমপরিমাণ উৎসব বোনাসতো আছেই, এখন তার সাথে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে বৈশাখী উৎসব ভাতা। বেসরকারী শ্রমিকদের জীবনমান ও অধিকারের প্রশ্নে  শ্রম আইন ২০০৬ রয়েছে বটে কিন্তু  শ্রম আইনের  কোথাও উৎসব বোনাসের ব্যাপারে কোন কিছুই উল্লেখ পাওয়া যায়নি। যেন দেশে কেবল সরকারী শ্রমিকেরাই উৎসব করবে আর বেসরকারী শ্রমিকেরা কেবল কলুর বলদের মত রাত দিন শ্রম দিয়ে যাবে। তাদের কোন উৎসব-ফুৎসব করার প্রয়োজন নাই। ২০১৩ সালে শ্রম আইনের বড় ধরণের সংশোধনী হলেও সেখানেও উৎসব বোনাসের ব্যাপারে কোন ধারা যুক্ত করার প্রয়োজন মনে করেনি সরকার বা মালিকপক্ষ আবার শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও কোন জোরালো আওয়াজ দৃশ্যমান ছিলনা।
২০১৫ সালে শ্রম বিধিমালা তৈরী করার সময় সরকারের টনক নড়েছে হয়তোবা। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, শ্রম বিধিমালার ১১১(৫) বিধিতে শ্রমিকের উৎসব বোনাসের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোন প্রতিষ্ঠানে নিরবিচ্ছিন্ন ১ বৎসর চাকুরী করলে বৎসরে ২টি উৎসব বোনাস প্রাপ্য হবে। তবে এর সাথে এমন একটা শর্ত যুক্ত করা হয়েছে যা কেবল হাস্যকরই নয় রীতিমত গরীব-শ্রমজীবী মানুষের সাথে বোনাস নিয়ে উপহাস করা হয়েছে।
উক্ত বিধিতে বলা হয়েছে বোনাসের পরিমান মূল মজুরীর বেশী হতে পারবেনা। অর্থাৎ কোন শ্রমিকের মূল মজুরী যদি ৪০০০ টাকা হয়, মালিক ইচ্ছা করলে উৎসব বোনাস হিসাবে সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা দিতে পারবে। মূল মজুরির বেশী তথা ৪০০০ টাকার বেশী দিলেই বিধি ভঙ্গ হবে। অন্যদিকে বোনাস মুল মজুরির বেশী দেয়া যাবেনা উল্লেখ থাকলেও সর্বনিম্ন কত হবে তার উল্লেখ না থাকায় মালিক চাইলে শ্রমিকদেরকে ৫ টাকা ১০ টাকাও বোনাস দিতে পারবে। বিশ্বের কোথাও এমন আইন বা বিধি আছে কিনা আমার জানা নেই।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শ্রমমান এবং বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩ নং ধারাটি বিশ্লেষণ করলে আমরা অনুধাবন করতে পারি, আইন হচ্ছে Minimum Standard অর্থাৎ এতে একজন শ্রমিকের সর্বনিম্ন প্রাপ্য উল্লেখ থাকে যাতে কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকের বেশী দেওয়ার সক্ষমতা থাকলে এবং উক্ত মালিক যদি বেশী দিতে ইচ্ছুক থাকে তাতে আইনগতভাবে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরী না হয়। তাই বোনাস সংক্রান্ত বিধিমালার ১১১(৫) বিধিটি শ্রম আইনের ৩ ধারার সাথেও সাংঘর্ষিক ফলে বিধিটির পরিবর্তন খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। শ্রমবিধিমালা সংশোধনের ব্যাপারে ইতিমধ্যে কার্যক্রম চলছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আশা করি, বিধিমালার ১১১(৫) বিধিটি যুক্তিসংগতভাবেই সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হবে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ শিল্পের বা প্রতিষ্ঠানের মালিকগন মনে করেন বোনাস মজুরির অতিরিক্ত অংশ। সুতরাং কোন মালিক শ্রমিককে বোনাস প্রদান করতে বাধ্য নন। মালিকদের এমন মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে শ্রম বিধিমালার ১১১(৫) বিধিতে। প্রথমে এটা ভুলক্রমে যুক্ত করা হয়েছে ধারনা করা হলেও দীর্ঘ ৭ বছরের অধিক সময় পরেও যখন তা সংশোধন করা হয়না, তখন আর বুঝার বাকী থাকেনা ডালমে কুজ কালাহে। এখানে আত্ম সমালোচনার বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন সমূহ দীর্ঘ ৭ বছরের অধিক সময় পরেও এমন একটি অন্যায্য বিধি পরিবর্তন করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। সুতরাং আমাদের দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো শ্রম আইন বা বিধিমালার নানা অসংগতিগুলো দূরীরনে কতটুকু আন্তরিক তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
রাষ্ট্র এবং মালিক পক্ষকে মনে রাখতে হবে বোনাস হচ্ছে একজন শ্রমিকের কোন প্রতিষ্ঠানে এক বছর চাকুরী করার পর তার আইন সম্মত প্রাপ্য বা অধিকার। বোনাস মালিকের দান নয় কিংবা এটা মজুরির অতিরিক্ত কোন বিষয়ও নয়। সুতরাং কোন শ্রমিকের চাকুরীর বয়স এক বছর পূর্ণ হলে তাকে বোনাস দিতে মালিক বাধ্য এবং শ্রমিকের বোনাস প্রাপ্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বোনাসের আভিধানিক অর্থ মজুরীর অতিরিক্ত বুঝালেও বাস্তবে ইহা হচ্ছে উৎসব ভাতা। তাই বোনাসকে মজুরীর অতিরিক্ত বলার কোন সুযোগ নাই। বর্তমানে সরকারী প্রতিষ্ঠান গুলোতেও বোনাসকে উৎসব ভাতা হিসাবেই উল্লেখ করা হয়।
কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা  অবস্থার মধ্য দিয়ে গেলেও সবচেয়ে বেশী সংকটে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ।দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আড়াই কোটি থেকে বেড়ে ছয় কোটি হয়েছে। এরমধ্যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি  মানুষের দুর্গতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেটার্স শ্রমিক সহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশী সংকটে পড়েছে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২ বা ৩ এপ্রিল হতে মুসলমানদের রমজান শুরু হবে। রমজান শুরু হওয়ার ২৯দিন বা ৩০ দিন পর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপন হবে। সব শ্রমিকেরা যাতে ঈদুল ফিতরের বোনাস পায় সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
 শ্রম আইনে উৎসবের কয়দিন আগে বোনাস প্রদান করতে হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নাই। কিন্তু বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের পক্ষ থেকে উৎসবের কমপক্ষে ১০ দিন পূর্বে বোনাস দেওয়ার দাবি জানানো হলেও সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পালিত হয়না। এবার যেহেতু শ্রমিকেরা প্রচন্ড আর্থিক সংকটে আছে তাই এপ্রিল মাসের অর্ধেক মজুরি সহ বোনাস কম পক্ষে ঈদের ১০ দিন আগে প্রদান করার জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, উৎসব করার অধিকার ধনী-দরিদ্র, সরকারী শ্রমিক -বেসরকারী শ্রমিক সবার। সুতরাং উৎসব পালনের ক্ষেত্রে কোন ধরণের সামাজিক-রাষ্ট্রিক বৈষম্য কাম্য নহে।
লেখকঃসংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি