বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৩৫)

– বিজন সাহা

ফেসবুকে বিভিন্ন রকমের স্ট্যাটাস দেখে আমার বার বার স্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, মনে হয় পরস্পরকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের তখন বেশি ছিল। হাই স্কুলে আমাদের ক্লাসে বিভিন্ন গ্রামের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করত। ছিল বিভিন্ন রকমের ছেলেমেয়ে। মনে আছে কাসেম, বিচিত্র, আমি – আমরা পড়াশুনায় ভালো ছিলাম, খেলাধুলায় ভালো ছিল লুৎফর, শাহাদত, খলিল, ইমরান। কেউ কেউ আবার গান গাইত স্কুলের অনুষ্ঠানে, কেউ পড়ত কবিতা। আমরা যদি ভালো রেজাল্ট করে স্কুলের জন্য সম্মান আনতাম, লুৎফররা আনত মেডেল। এভাবেই বিভিন্ন দিকে পারদর্শী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছিল আমাদের ক্লাস। ছিল পারস্পরিক বন্ধুত্ব। এখনও দেশে গেলে চেষ্টা করি সবার সাথে যোগাযোগ করতে। এরপরেও বিভিন্ন কালেক্টিভে ছিলাম, আছি। এইতো আমাদের বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া। সেখানেও বিভিন্ন রকমের লোক। কেউ গান গায়, কেউ ভালো চাঁদা তোলে, কেউ বা সাংগঠনিক কাজে পারদর্শী। আবার আছে আমার মত কেউ কেউ যারা যে কোন কাজের আগে সন্দেহ প্রকাশ করে, দ্বিতীয় বার ভেবে দেখতে চায়। আবার এটাও জানি, আমরা একসাথে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেও সবার ছিল ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য। প্রথমে বুঝিনি, পরে কাজে কর্মে দেখেছি। এ অনেকটা ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য ঠিক করার মত। সবাই ডাক্তার হতে চায় সমাজের সেবা করবে বলে, কিন্তু ডাক্তার হয়ে সমাজ সেবা করলেও অনেকেই এটাকে দেখে সমাজে সম্মান লাভের, অর্থ উপার্জনের পথ। এতে ভালো বা মন্দের কিছু নেই। এটাই ডাইভারসিটি। এসবই আমরা বুঝি, কিন্তু সবাই চাই অন্যেরা আমার মত ভাবুক, আমি যেভাবে বলি সেভাবে চলুক। আর সেটা না হলেই ঝামেলা। তখন নিজেকে প্রশ্ন করি যদি একটা দ্বীপে সবাই ডাক্তার বা সবাই ইঞ্জিনিয়ার বা দার্শনিক হয় সেটা ভালো, নাকি যদি সেখানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নাপিত, ধোপা, কৃষক সব থাকে সেটা ভালো? আমার তো মনে হয় অধিকাংশ লোকই দ্বিতীয় অপশন চাইবে। মনে আছে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি তখন এখানে চুল কাটাতে লাগত ৩ থেকে ৫ রুবল। এক রুবলে ভরপেট খাওয়া যেত, মাংসের দাম ছিল দুই রুবল কেজি। অর্থাৎ তিন রুবল দিয়ে চুল কাটানো ছিল শৌখিনতা। তাই আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ আমাদের চুল কেটে দিত। যে ভালো পারে সে রান্না করত। ঐ দিনগুলোয় রান্না ঘর থেকে খাবার পর্যন্ত চুরি হয়ে যেত। নিত মূলত ল্যাটিন বা আফ্রিকানরা বন্ধুরা। খারাপ লাগত, কিন্তু এর মধ্যেও অন্য ধরণের মজা ছিল। দেশ তো আরও বড় সমাজ। তাই সেখানেও সবই দরকার। আমি ১০০% সিওর যে যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারা সাম্যবাদ চায় না। কিন্তু এরাও দেখি চায় সবাই তার ধর্মাবলম্বী হোক, তার মত করে চলুক। এই যে মানুষের নিজের মধ্যে হাজার বিপরীতমুখিতা, তার চিন্তা আর কাজের মধ্যে বিরোধিতা সে এ নিয়ে কখনও ভাবে না। নিজের মধ্যে হাজার কন্ট্রাডিকশন থাকলেও সে চায় অন্যেরা কন্ট্রাডিকশন মুক্ত হোক, নিঃশর্তভাবে তার চিন্তা ভাবনাকে সমর্থন করুক। নিজেকে চেনার, নিজেকে বোঝার অপারগতাই মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর এই সমস্যা মনে হয় মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। অনেকটা ষড় রিপুর মত। কিন্তু মানুষ যেহেতু কমবেশি নিজের রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আমার ধারণা চাইলে সে নিজের ভেতরের কন্ত্রাডিকশনেও বুঝতে পারবে। আর সে যখন বুঝতে পারবে নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্বই তার সামনে চলার পথে শত্রু নয়, সবচেয়ে বড় বন্ধু, তখন হয়ত অন্য মানুষকে বুঝতেও সক্ষম হবে। কেন বন্ধু? কারণ এটা আমাদের কোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে আবার ভাবতে বলে, সবকিছু নতুন করে দেখতে বলে। ফলে সিদ্ধান্ত সঠিক হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল নিজের মধ্যে এই যে দ্বন্দ্ব সেটা কি সব মানুষের মধ্যেই দেখা যায়? সব মানুষের মধ্যে দেখা যায় কি না জানি না, তবে যারা প্রশ্ন করেন, সন্দেহ করেন মানে যারা বিজ্ঞানমনস্ক তাদের মধ্যে এটা খেয়াল করা যায়। আসলে প্রশ্ন শুধু সেই করে না যে অন্ধবিশ্বাসী। আবার এমনও হয় যখন কেউ কোন কোন বিষয়ে প্রশ্ন করে আবার কোন কোন বিষয় অন্ধের মত বিশ্বাস করে। আর এ ধরণের লোকজন যারা মূলত বিজ্ঞানমনস্ক কিন্তু কোন কোন বিষয়ে অন্ধবিশ্বাসী তারাই সব চেয়ে ভয়ংকর। কারণ বিজ্ঞানমনস্ক বলে অন্যেরা তাদের বিশ্বাস করে আবার তারা নিজেরাও নিজেদের এই অন্ধত্ব কখনই বুঝতে পারে না। এটা অনেকটা সমাজতন্ত্রের সৈনিকরা এক সময় যেমন নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক বলে মনে করত যদিও তারা অন্ধ ভাবে সমাজতন্ত্রের সবকিছু বিশ্বাস করত, এমনকি ভুল দেখতে পেলেও সেটা পাশ কাটিয়ে যেত। এক সময় পড়াশুনা শেখানো হত মানুষকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত করার জন্য, তাকে জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শেখানোর জন্য। বর্তমানে টেকনোলোজির যুগে তাকে সেসব আর শেখানো হয় না। বর্তমানে মানুষের চেয়ে রবোট অনেক বেশি কার্যকরী, তাই তাকে রবোট বানানো হয় মানে তাকে শেখানো হয় নিখুত ভাবে নির্দেশ পালন করতে। আর এটা যে সব সময় স্কুল কলেজে শেখানো হয় তা কিন্তু নয়। সে এসব শেখে টিভি, নিউজ পেপার, সামাজিক মাধ্যম ইত্যাদি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে। আর সেজন্য যেটা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী তা হল কাউকে হয় বন্ধু অথবা শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা। কারণ মানুষ সাধারণত বন্ধু আর শত্রুকে নিয়ে প্রশ্ন করে না। বন্ধুর দোষের প্রতি যেমন চোখ বন্ধ করে থাকে, তেমনি চোখ বন্ধ করে রাখে শত্রুর গুনের প্রতি। আর যারা একবার এটা শিখে তারা আর প্রশ্ন করতে পারে না। সাধারণ পরিস্থিতিতে সেটা আমরা দেখতে পাই না, তবে যেকোনো জরুরি অবস্থায় মানুষের প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসে। হাজারো মুখোশ পরেও তখন সেটা ঢেকে রাখা যায় না। এটা অনেকটা কোন মাধ্যমকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডে স্থানান্তরিত করার মত। স্বাভাবিক অবস্থায় মাধ্যম বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ মানে এর ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জগুলো পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে, কিন্তু ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের উপস্থিতিতে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিশেষ বা জরুরি অবস্থা এমনিতে তৈরি হয় না, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দিনের পর দিন সেটা তৈরি করে, আর সে জন্যে তারা মানুষের মধ্যে সত্যের মোড়কে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য প্রচার করে ঠিক যেমন হয়েছিল ইরাক আক্রমণের আগে। ব্যাপারটা এরকম নয় যে মানুষকে কনভিন্স করতে না পারলে তারা তাদের পরিকল্পনা বাদ দিত। যেকোনো পরিস্থিতিতেই তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত তবে সেটা যদি জনগণের সমর্থন নিয়ে করা যায় তাহলে তাদের সব কাজকর্ম গণতান্ত্রিক রঙ পায়। আর এ কারণেই বর্তমানে যে সমস্ত তথ্য আমাদের জানানো হয়, তা সে যে পক্ষ থেকেই আসুক না কেন, সেটা বিশ্বাস করার আগে, সেটা প্রচার করার আগে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে তার সত্যতা নিয়ে আর মনে রাখতে হবে বর্তমান বিশ্বে স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না। আর তাই প্রতিটি ঘটনার পেছনে প্রত্যক্ষ কারণ ছাড়াও আছে অনেক অনেক বেশি পরোক্ষ কারণ। এটা না বুঝলে আমরা শুধু আইসবার্গের উপরেরটুকুই দেখব, এর নীচে যে বিশাল বিপদ অপেক্ষা করছে সেটা কখনই জানতে পারব না। তখন আমাদের শুধু “আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে” বলে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা