বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৩৪)

-বিজন সাহা

বাড়িতে সব সময়ই পড়ার রেওয়াজ ছিল। পড়া মানে ক্লাসের পড়ার বাইরে বিভিন্ন ধরণের বই পড়া। সে ইতিহাস হোক, রূপ কথা হোক, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হোক, জীবনী হোক অথবা গল্প উপন্যাস হোক। কারণ এসব বই এক একজনের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া বা জীবনের প্রতি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি। সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক হবে তার মানে নেই, তবে সেটা মানুষকে একটা জিনিস শেখায় – জীবন বৈচিত্র্যময়, শুধুমাত্র একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখা এটা সেই বৈচিত্র্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা। আমাদের সব ভাইবোনের ছিল নিজ নিজ বইয়ের সংগ্রহ। পড়তাম সব ধরণের বই। রামায়ণ মহাভারত  থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের বিভিন্ন লেখকদের বই। কারণ বাড়িতে এটা শেখানো হত যে সমাজকে জানতে হলে, মানুষকে জানতে হলে, জ্ঞান অর্জন করতে হলে বই পড়ার বিকল্প নেই। এভাবেই কাটবে জীবনের অনেকগুলো বছর। কলেজে পড়ার সময় পরিচয় হয় অনেকের সাথে যারা বাম ঘরানার রাজনীতি করতেন। হয় বন্ধুত্ব। নিজেও জড়িয়ে পড়ি রাজনীতির সাথে। পাল্টে যায় জীবনের দিক নির্দেশনা। পড়াশোনায় আসে বাছবিচার, বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে। না, কেউ যে জোর করেছে, তা নয় – তবে অনেকে একসাথে চলতে গেলে যেটা হয়, সবার যা পছন্দ বা সবাই যা নিয়ে আলোচনা করছে সেটা পড়ার দিকে মন ঝুঁকে পড়ে। এভাবেই পড়াশুনার মূল বিষয় হয় বাম ঘরানার বইপত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, এদিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন সেন, জুলিয়াস ফুচিক, গরকি, অস্ত্রভস্কি ইত্যাদি। না, হেফাজতের আন্দোলনের কারণে নয় এমনি এমনি রামায়ণ, মহাভারত, গিরিশচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র – এসব সিলেবাজ থেকে বাদ পড়ে যায়। বাড়িতে বরাবরই ইত্তেফাক আর সংবাদ পড়লেও এখন আমি ইত্তেফাকের পরিবর্তে একতা পড়ি।

১৯৮৩ সালে যখন মস্কো আসি তখন বাংলা বই পাওয়া কষ্ট হয়ে যায়। তারপরেও বন্ধুরা দেশ থেকে বই নিয়ে এলে পড়তাম। আসলে ঐ সময় মস্কোয় বাংলা বই ছিল অমাবস্যার চাঁদের মত, আমাদের বইগুলো হাতে হাতে ঘুরত। এটা ছিল একেবারেই অন্য রকম সময়। মাঝেমধ্যে প্রগতি প্রকাশন থেকে নতুন বাংলা বই বেরুলে আমরা দল বেঁধে চলে যেতাম সেসব কিনতে। আর ছিল দ্বিজেন কাকুর বাসার লাইব্রেরি। তবে তখনও সব সময় চেষ্টা করতাম এক বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বই পড়তে।

আমরা সব সময় গর্ব করতাম যে ছাত্র ইউনিয়ন বা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা দেয়। এরা শুধু মাঠের রাজনীতিই করে না তত্ত্বটাও জানতে, বুঝতে চায়। সন্দেহ নেই যে কর্মীদের জন্য বিভিন্ন তাত্ত্বিক ক্লাসের আয়োজন খুবই ভাল উদ্যোগ। তবে অনেক সময় সেটা হয়ে যায় পক্ষপাতদুষ্ট। কারণ সে সব ক্লাসে শুধু বিশেষ ধরণের মানে বামপন্থী ঘরানার বই পড়তেই বলা হয়। এর ফলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয় একপেশে। যদি আমাদের বিভিন্ন ধরণের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা হত, যদি বিভিন্ন ঘরনার বই পড়া কেন গুরুত্বপূর্ণ সেই সম্পর্কে জানানো হত তাহলে শিক্ষাটা সম্পূর্ণ হত।

আপেল বা অন্য কোন ফল অনন্ত কাল ধরেই পড়ছে, অনেকের মাথায়ই পড়েছে। গাছ থেকে আপেল পড়া সবাই দেখে কিন্তু সবাই নিউটন হয় না। কারণ বিজ্ঞানীর কাজই এটা – প্রশ্ন করা। হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা এমনই হন। যে কোন কিছু নিয়েই প্রশ্ন করেন, ভাবেন। আর ভাবেন বলেই বিজ্ঞানী সাধারণ ঘটনায় অসাধারণের দেখা পান। একই ভাবে একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ সমাজের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পলিসি নিতে পারেন। বিজ্ঞানী যেমন সাধারণের মধ্যে অসাধারণের দেখা পান অনেকটা একই ভাবে সত্যিকারের সাহিত্যিক সমাজকে অনেক গভীরে দেখেন, তার মানসপটে সমাজের এক্স-রে প্লেট ভেসে ওঠে। তাই সমাজকে বুঝতে হলে, সমাজের পালস জানতে হলে সাহিত্য ও সাহিত্যকদের মতামত এড়িয়ে গেলে চলবে না। এ জন্যেই লেনিন বলেছেন তলস্তয় রুশ বিপ্লবের আয়না। আসলে শুধু তলস্তয় নয়, যেকোনো সত্যিকারের লেখকই তাঁর সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। একজন বিজ্ঞানী যেমন এমনকি ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করে সেটার কারণ বুঝতে চান, একজন লেখক সেই একই ভাবে সমাজের চরিত্র উন্মোচন করেন, বুঝতে চান সমাজের ব্যাধিটা কোথায়? অবশ্যই লেখক বিভিন্ন রকমের। কেউ অন্যদের স্রেফ আনন্দ দিতে চান। তাঁরা রম্য রচনা লেখেন। এটা ব্যথিত মনে মলমের প্রলেপ দিতে পারে তবে রোগ সারায় না। কিন্তু তলস্তয়, দস্তইয়েফস্কি, চেখভ, শরৎচন্দ্র, মানিক, রবি ঠাকুর, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক – এদের মত লেখকরা সমাজটাকে বিশ্লেষণ করেন, সমাজের ব্যাধিটার ডায়াগনোসিস করার চেষ্টা করেন। আর কে না জানে সঠিক চিকিৎসার জন্য দরকার সঠিক ডায়াগনোসিস। তাই যারা সমাজ বদলাতে চান, সমাজকে রোগ বালাই থেকে মুক্ত করতে চান তাদের জন্য সমাজের ব্যাধিগুলো জানা, রোগীর ব্যথাটা অনুভব করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু বই পড়লেই হবে না, সেটা বুঝতে হবে। শ্রীকান্ত পড়ে অনেকেই শুধু প্রেম আর বিরহের কথাই মনে রাখে, কিন্তু গভীর ভাবে দেখলে যে কেউ সেখানে সমাজের একটা চিত্রও পাবে। মানুষ সমাজেরই অংশ। তার সাথে যা ঘটে সেটা সমাজ বহির্ভূত নয়। সমাজ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাকে, তার চরিত্র গড়ে তোলে আর সে সেভাবেই নিজেকে প্রকাশ করে। নায়ক নায়িকা বা অন্যান্য চরিত্র লেখক ব্যবহার করেন শুধু প্রতীকী হিসেবে। পাঠককে নিজের চেষ্টায় এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা সামাজিক ছবিটা বের করে নিতে হবে। বুঝতে হবে ব্যাধিটা কোথায়।

আমরা যখন মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিনের রচনা পড়ি তখন বলা যায় শুধু ওষুধটা পাই। এটা কিন্তু সর্ব রোগ নিরাময়কারী কিছু নয়। এখানে শুধু পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে। এসবই রিকমেন্ডেশন। কিন্তু তাকে ব্যবহার করতে হবে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী। সব রোগীকে একই ওষুধ একই ডোজে দিলে তো চলবে না। এদের লেখা বলতে পারেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের বাক্সে থাকা বিভিন্ন শিশির তরল আর পাউডারের মত। ডাক্তার যেমন বিভিন্ন রোগীকে এইসব ওষুধই দেন শুধু বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে, একই ভাবে বিভিন্ন সমাজের ক্ষেত্রে এই সমস্ত রিকেমেন্ডেশনগুলো বিভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আর এ জন্যেই দরকার সমাজটাকে জানা। জানা দরকার সমাজের ইতিহাস, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সমাজের বিভিন্ন আচার বিচার, রীতি নীতি। ইংরেজরা ভারতকে জানার জন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করে, এ জন্যে তারা সংস্কৃত শিখতে পিছপা হয়নি। ভারত শাসনে তাদের সাফল্যে এটাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই আমরা যারা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখি তাদের সমাজটাকে জানতে হবে। আর এ জন্যেই বাম রাজনীতি যারা করেন তাদের শুধু সমাজতন্ত্রের তত্ত্বই নয় বিভিন্ন গল্প সাহিত্য পড়ে সমাজটাকে চিনতে, জানতে হবে। একমাত্র তখনই তাত্ত্বিক বই পড়ে লব্ধ জ্ঞান সমাজের কাজে লাগানো যাবে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো