মতামত

বসন্তের মাতাল হাওয়ায় বাজে কান্নার সুর

– ফজলুল কবির মিন্টু

ঋতুরাজ বসন্ত এসে গেছে। শীতের শুষ্কতায় বিবর্ণ প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে প্রাণ। শীতের খোলস পাল্টে প্রকৃতি তার রূপ বদলাতে শুরু করেছে। গাছের শুষ্ক ও মরা পাতা ঝরতে শুরু করেছে। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে ঝরা পাতার স্থানে গাছে গাছে সবুজ-সতেজ কচি পাতাও নতুন করে গজাতে শুরু করেছে । সবুজ কচি পাতা এবং কৃষ্ণচূড়ার লাল রং একাকার হয়ে প্রকৃতিতে বসেছে যেন লাল সবুজের মেলা। ইট পাথরের নগরীতে মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে কোকিলের কুহুডাক। সবকিছু মিলে প্রকৃতি এক অপরূপ সৌন্দর্য ধারন করেছে।

বসন্ত মানে তাই নতুন প্রত্যাশার আগমনী বার্তা। বসন্ত এলেই প্রকৃতির রঙে মানুষ নিজেকেও আরেকবার রাঙিয়ে নেয়। মানুষ অতীতের হতাশা-গ্লানি-ব্যর্থতা ভুলে গিয়ে নতুন করে পথ চলতে শিখে। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ নতুন করে বাঁচতে শিখে। কিন্তু অন্ধকার যদি গাঢ় হয়, হতাশা যদি গভীর হয়, মানুষ কি সে অন্ধকার ভেদ করে নতুন প্রত্যশা বুকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে?

দীর্ঘ ২ বছরের বেশী সময় মানুষ করোনার অভিঘাতে জর্জরিত।  ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে  ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট  (বিআইজিডি)  এবং পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি)  যৌথ জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী  দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। ২০২১ সালের মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। এখন ২০২২ সালে দরিদ্র বৃদ্ধির হার বেড়েছে বৈ কমেনি। একদিকে করোনার অভিঘাতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অন্যদিকে পাগলা ঘোড়ার মত লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম। তাই বসন্তের আগমনে সতেজ-রঙ্গিন প্রকৃতির মাঝেও মানুষ যেন কোন কিছুতেই স্বস্তি বা ভরসা খুঁজে পাচ্ছেনা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। অর্থাৎ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব দেখে মনে হতে পারে দেশের মানুষের আয় বুঝি বাড়ছে কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী। মানুষের আয়তো বাড়েইনি বরং মূল্যস্ফতি আমলে নিলে দেখা যাবে মানুষের প্রকৃত আয় আরো কমেছে। কেননা একজন মানুষের মাসিক আয় যদি ১০ হাজার টাকা হয় তাহলে  ১০ হাজার টাকা দিয়ে এক বছর আগে সে যে পরিমান পণ্য কিনতে পারতো বর্তমানে  একই পরিমান পণ্য কিনতে হলে কমপক্ষে ১২ হাজার থেকে ১২ হাজার ৫০০ টাকা প্রয়োজন হবে কিন্তু তার আয় যদি ১০ হাজার টাকা রয়ে যায় তাহলে তার পক্ষে পূর্বের সমপরিমান পণ্য ক্রয় করা সম্ভব নয়। যার অর্থ দাঁড়ায় তার আয় অপরিবর্তিত থাকলেও প্রকৃত আয় এবং ক্রয় ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় কমে গেছে। মুষ্টিমেয় কিছু অতি ধনি মানুষ ও মুনাফাখোর ফটকা ব্যবসায়ীদের আয় হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফল স্বরূপ  গাণিতিক নিয়মে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেও দেশের মানুষের গড় আয় তথা মাথাপিছু আয়ও হয়তো বেড়েছে। কিন্তু মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির এ হিসাব শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমরা স্বীকার করি বা নাই করি, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা উল্লম্ফন ঘটেই চলছে, তাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে নিদারুন কষ্টে আছে। যা বুঝার জন্য খুব বড় অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। টিসিবির পণ্য বিক্রি করার জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক গুলোর পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন এবং ঐ লাইন গুলোতে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা কি পরিমান যুক্ত হচ্ছে তার একটা হিসাব নেয়া গেলে বিষয়টা আরো পরিস্কার হবে।

দেশে বর্তমানে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটির অধিক। যার মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা শতকড়া প্রায় ৮৫ ভাগ। অর্থাৎ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটির অধিক। এরমধ্যে অন্তত চার কোটি শ্রমিক আছে যারা দিন এনে দিন খায়। এ ধরনের শ্রমিকেরা গত দুই বছর কীভাবে দিন পার করেছেন তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানেন না।

আমি একজন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী। চট্টগ্রামের অনেক শ্রমিকের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে। শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে লেখালেখি করি বলে অনেক শ্রমিক তাদের দুঃখ কষ্টের কথা আমার সাথে শেয়ার করেন। তাদের একজন মোহাম্মদ পারভেজ। তিনি চট্টগ্রাম জেলা এবং মহানগর কমিউনিটি সেন্টার ও ডেকোরেশন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তার একটি কথা আমাকে দারুনভাবে ব্যথিত ও আপ্লুত করেছে।

একদিন কথা প্রসঙ্গে পারভেজ জানান, করোনার দুই বছরের অধিকাংশ সময় কমিউনিটি সেন্টার গুলো বন্ধ ছিল। ফলে তাদের আয়রোজগারও ছিলনা। কোন রকম অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন। তার সবচেয়ে হৃদয় বিদারক কথাটি ছিল, “মাঝে-মধ্যে অনুষ্ঠান থাকলে আমি হয়তো ভাল খাবার খায়। কিন্তু বিগত দুই বছরে আমার ঘরে ছেলে-মেয়েদের একবেলাও মুরগীর মাংস বা গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাওয়াতে পারিনি”। তিনি আরো যোগ করে বলেন, “অনুষ্ঠানের ভাল খাবার তাই আমার কাছে বিষের মত মনে হয়”। কথাটি  যতবারই মনে পড়ে ততবারই হৃদয়ের গভীরে ভীষণ কষ্ট অনুভব করি। এক অব্যক্ত বেদনায় চোখ ভিজে যায়। ভাবতে থাকি,এ কি আমার সে স্বপ্নের বাংলাদেশ? যে দেশ অর্জনের ইতিহাসের সাথে যুক্ত আছে দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত?  আচ্ছা স্বাধীনতার অর্থ কি কেবল ভৌগলিক স্বাধীনতা?  নাকি এর সাথে যুক্ত রয়েছে গণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য, ন্যায় বিচার, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিও।

আমরা বিগত বছর আমাদের বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী এবং আমাদের বিজয়ের মহান নায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী উদযাপণ করেছি অথচ স্বাধীনতার মৌলিক প্রশ্নটি আজও নিষ্পত্তি করতে পারিনি। এরচেয়ে লজ্জার-গ্লানিকর আর কী হতে পারে? এ যেন বসন্তের মাতাল হাওয়ায় বেজে চলছে ক্ষুধার্ত মানুষের কান্নার সুর।

 

লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক ও শ্রম আইন বিশ্লেষক