মতামত

বাসদের গণচাঁদা: ভিক্ষুকের সাথে ভিক্ষা দাতার সম্পর্ক

-অপু সারোয়ার

 

চাঁদাবাজদের দৌরত্ব নিয়ে হরহামেশাই সংবাদ পত্রে লেখা হয়ে থাকে। অতীতে গণচাঁদা দিয়ে বহু ভাল কাজ হয়েছে। তবে সেই সব গণ চাঁদা অরাজনৈতিক ভাবে সংগৃহীত। এই ভূখণ্ডে রাজনৈতিক দলের সংগৃহীত গণচাঁদা কি ভাবে খরচ হয়েছে তার কোন প্রকাশিত হিসাব দেওয়ার নজির বা রেওয়াজ গড়ে উঠ নাই। গণচাঁদা হচ্ছে প্রধানত হাট -বাজার, শপিং প্লাজা গুলি থেকে ব্যবসা চলাকালীন সময়ে সংগৃহীত টাকা। দোকানে বা দোকানের আসে পাশে গণচাঁদা সংগ্রহকারী থাকলে ক্রেতারা দোকানে ঢুকতে ইতস্তত করে থাকেন। একজন দোকানীর কাছে ক্রেতার উপস্থিতি প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক। একজন দোকানদার ক্রেতা সামলাবেন না চাঁদা প্রাথীদের সামলাবেন বিষয়টি নিয়ে ভাবনার অবকাশ গণচাঁদা সংগ্রহকারীদের মধ্যে কম। যাঁরা গণ চাঁদা সংগ্রহ করেন তাঁদের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন।

বাজারে চাঁদাবাজদের পদচারণা অহরহ লেগেই আছে। দোকানীদের পক্ষে সচরাচর কে কি কারণে চাঁদা নিচ্ছে তা যাচাই করার সময় ও সুযোগ থাকে না। সবার হাতেই চাঁদার কুপন / রসিদ বই থাকে। হরহামেশাই দোকানের সামনে জটলা – চার /পাঁচ জন যুবক- যুবতী দাঁড়িয়ে থাকলে দোকানে খদ্দের ঢুকে না। তাই চাঁদা –  যে কারণেই হোক না কেন, চাইতে আসলে কম কথায় , কম টাকায় বিদায় করার একটা রেওয়াজ চালু হয়ে পড়েছে। বাজারের দোকান গুলির প্রতিদিন চারজনকে চাদা দিতে হবে বিষয়টি অবধারিত হয় গেছে। এর বাইরে রয়েছে স্থানীয় গুন্ডাপান্ডা, বাজার রক্ষনাবেক্ষন কমিটি, নাইট ডিউটির নামে টাকা আদায়ের ঝামেলা দোকানীদের জন্য প্রাত্যাহিক ঘটনা । বেশিরভাগ গনমানুষ যারা চাঁদা দেন, তারা যাদের রাজনীতির বা সামাজিক বক্তব্যের সাথে একমত নয়। অথবা কি বক্তব্য কখনোই জানা হয়ে উঠে নাই।

বিশ্বব্যাপী বামপন্থী আন্দোলন নাজুক অবস্থায়। বামপন্থী আন্দোলনের বেহাল অবস্থা নিয়ে নানান গবেষণা রয়েছে। বামপন্থী আন্দোলনের প্রায়োগিক ও দার্শনিক সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিস্তর লেখালেখি আছে। সেই তুলনায় আমাদের দেশে ছিটেফোঁটা নেই। বামপন্থী আন্দোলন পথ হারা হয়ে পড়ার পরেও যারা হাল ধরে আছেন তাদের তেমন কোন নতুন বক্তব্য নেই। বামপন্থী দল গুলি গণ চাঁদার উপর নির্ভরশীল। বামপন্থী দল গুলির গণচাঁদা তোলার স্বপক্ষে সাধারণ যুক্তি হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম জনগণের জন্য। জনগণের সহযোগিতাতেই দল ও দলের কর্মসূচী করতে হবে। কোন বিশেষ কিছু মানুষ বা গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে গণ সংগ্রাম করা সম্ভব নয়। সমাজতান্ত্রিক দল পরিচালনার  জন্য টাকা জণগণের কাছ থেকেই আসবে। তাই গণচাঁদা সংগ্রহ  বামপন্থী আন্দোলনের জনগণের কাছে যাবার একটি উৎকৃষ্ট পথ। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা প্রকাশেরও উপায়। তবে গণচাঁদার প্রকাশ্য নিয়ে বামপন্থীরা স্বউদ্যোগে  কোন কিছু প্রকাশের নজির তেমন নেই।

বামপন্থী দলের কর্মীভিত্তি ছাত্র। সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনের বক্তব্য সাধারণ ভাবে কর্মী সংগ্রেহের উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে। এর বাইরে পারিবারিক পরিমন্ডল , বন্ধু বান্ধবদের প্রভাব ছাত্রদেরকে বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত করে। ১৬/১৮ বছর বয়সে আদর্শ কর্মসূচী বুঝে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া বেশ কঠিন। অল্প বয়সের কারণে রাজনীতির দুরহ পাঠ পড়া ও আত্মস্থ করার সুযোগ কম। সংগঠনে যোগ দেওয়ার পর নেতাদের বক্তৃতা, সঙ্গবদ্ধ হয়ে শিক্ষাঙ্গনে সমবয়সীদের সাথে আলোচনা , চলাফেরা আর সংগঠনের ঘোষণা পত্র জাতীয় বই পুস্তক ছাত্র যুবকদের জানা বোঝার ভিত্তি। এই ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই পরবর্তী চিন্তার ভিত্তি ভূমি গড়ে উঠে। এইভাবেই বিভিন্ন বামপন্থী দলের বিভিন্ন ধারা ও চিন্তার পার্থক্য গড়ে উঠে।

বামপন্থী রাজনৈতিক দল গুলির মধ্যে বাসদখালেক , বাসদমার্ক্সবাদী , সাম্যবাদী আন্দোলন গণচাঁদা তোলার জন্য সুপরিচিত। এই তিনটি দল ১৯৮৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক সাথে ছিল। এরপর ভেঙে গেছে। এই ভেঙে যাওয়ার পিছনে রাজনৈতিক বিতর্ক তেমন কিছু নেই। দেশীয় রাজনৈতিক অবস্থার শত্রু – মিত্র নির্ধারণ ও রাজননৈতিক কলা-কৌশল নিয়ে কোন বিতর্ক এই সব ভাঙ্গনের কারণ নয়। ভাঙ্গনের কারণ শিবদাস ঘোষের রাজনৈতিক মূল্যায়ন নিয়ে।

শিবদাস ঘোষ ভারতের এসইউসিআই দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । সাম্যবাদী আন্দোলন নিয়ে বেশ কিছু বই লিখেছেন। উপরে উল্লিখিত দল গুলি সবাই শিবদাস ঘোষ পন্থী। শিবদাস ঘোষ পন্থীতার মাত্রা নিয়ে এই দল গুলির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বাসদমার্ক্সবাদী শিবদাস ঘোষকে মার্ক্সবাদের পঞ্চম স্তম্ভ মনে করে এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে এই ঘোষণার ঢোল -মাদল বাজাচ্ছে । এই ঘোষণার ঢোল -মাদল বাজানোর প্রক্রিয়া নিয়ে বাসদখালেকবাসদমার্ক্সবাদীর বিরোধ। বাসদ -খালেক মার্ক্সবাদের পঞ্চম স্তম্ভ এর ঢোল মাদল নৃত্যে অংশ না নিয়েই শিবদাস ঘোষকে গ্রহণ করেছে। সাম্যবাদী আন্দোলন ও বাসদ মার্ক্সবাদী আন্দোলনের পার্থক্য নেতৃত্বের পর্যায়ে একে অপরকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করার। এই দল গুলির মৌলিক কোন পার্থক্য নেই।

পুঁজি সংগ্রহের নানান পন্থা রয়েছে। আমাদের এই অঞ্চলে কৃষিতে বেগার প্রথা , টংক প্রথা এর মত বিভিন্ন প্রথা চালু ছিল ব্রিটিশ আমলে। এই প্রথা গুলির প্রধান দিক হচ্ছে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেওয়া। জমিদার শ্রেণী এইভাবেই পুঁজির বিকাশ ঘটিয়েছিল। আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে ক্রীতদাস প্রথা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে পুঁজির সঞ্চয় ঘটানো হয়েছিল। বেগার বা ক্রীতদাস প্রথার আইনী উচ্ছেদ ঘটলেও সমাপ্তি ঘটে নাই। এই ব্যবস্থার আধুনিক রূপান্তর হচ্ছে সস্তা কিংবা নাম মাত্র মূল্যে কাজ করানো। আমাদের দেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা নাম মাত্র মূল্যে শ্রম বিক্রিতে বাধ্য জনগোষ্ঠী। ১৯৮০ এর দশকে সস্তা শ্রমের বাজারে নতুন মাত্রা আনে এনজিও গোষ্ঠী। প্রথমত বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্রকে বেঁচে বিদেশ থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে দেশে বিনিয়োগ করে এনজিও গোষ্ঠী । এই বিনিয়োগ হয়েছে ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্ষুদ্র ঋণে। এই বিনিয়োগ গুলি সাধারণ ব্যবসা -বাণিজ্যের মত আয়কর এর দেওয়ার বাধ্য বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। কর্ম সংস্থানের সংকট বেকার যুবকদের এনজিও গুলিতে চাকুরীতে আকৃষ্ট করে আসছে। পাশাপাশি এনজিওদের রাজনৈতিক স্লোগান ‘দারিদ্র মুক্তি ‘ ‘নারী শিক্ষা’ ‘ লিঙ্গ বৈষম্য দূর ‘ পরিবেশ রক্ষা ‘ সহ নানান সামাজিক সমস্যা বিষয়ে বক্তব্য সামাজিক পরিবর্তন প্রত্যাশীদের একাংশকে কাছে টানতে সক্ষম হয়। বাসদ এনজিও স্টাইলে জনগণকে আন্দোলন সংগ্রামের কথা বলে চাঁদা সংগ্রহ করে পুঁজি সংগ্রহ করে বিনিয়োগ করে আসছে। পার্থক্য এনজিওরা সংস্কারের আওয়াজ তুলছে আর বাসদ বিপ্লব -শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে এক ঝাঁক সমাজ পরিবর্তন প্রত্যাশীদের কাজে লাগিয়ে পুঁজি সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করছে।

বাসদ গণচাঁদার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে। কর্মীদের গণচাঁদায় উৎসাহিত ও মনোনিবেশ সহায়তার জন্য দলের প্রকাশিত পুস্তিকা রয়েছে। পুস্তিকার নাম ‘বিপ্লবীদের অর্থ সংগ্রহ প্রসঙ্গে’। বাসদীয় ধারা গুলির গণ চাঁদার মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ ও বিনিয়োগের সাফল্য অভাবনীয়। অতি সম্প্রতি বাসদ -খালেক গণ চাঁদা ও এই বিনিয়োগ কৃত অর্থ দিয়ে ২৩/২ তোপখানা রোড ঢাকা ভবনটি কিনে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই ভবনের আনুমানিক মূল্য ১০কোটি টাকা। এই ভবনের মালিকানা হিসেবে দলের একজন নেতার নাম লেখা আছে। ‘বিপ্লবীদের অর্থ সংগ্রহ প্রসঙ্গে পুস্তিকায় গণচাঁদা ব্যবসায় বিনিযোগ হবে এমন কোন ইঙ্গিত বাসদ করে নাই। কিন্তু বাস্তবে সেটাই সংগৃহীত গণচাঁদার বিনিয়োগের প্রাধান্যে চলে আসে বাসদের রাজনীতিতে।  রাজনৈতিক কর্মসূচী বাসদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গে সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রকাশিত পুস্তিকা ‘ বাসদ (মার্কসবাদী) অভ্যন্তরে মতাদর্শিক সংগ্রামের দুটো দলিল এ বাসদের এই প্রবণতাকে সম্পদ ও অর্থ যোগান দিতে সক্ষম কর্মীদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা হিসেবে চিত্রিত করেছে ।

২০১০ সালের অগাস্ট মাসে বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য আব্দুল্লাহ সরকার দলের তহবিলের স্বচ্ছতা চেয়ে দলের সাধারণ নেতা কর্মীদের কাছে বিষয়টি নজরে আনার উদ্যোগ হিসেবে বাসদের উদ্দেশে খোলা চিঠি প্রকাশ করেন ১লা অগাস্ট ২০১০। খোলা চিঠির খেসারত হিসেবে আব্দুল্লাহ সরকার বাসদ থেকে খসে পড়েন , দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। উল্লেখ্য আব্দুল্লাহ সরকার ইতিপূর্বে দলের সিদ্ধান্তে পৌত্রিক সূত্রে পাওয়া বাসদকে দান করে দিয়েছিলেন। । জীবন ধারণের জন্য একান্তই দলের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। আব্দুল্লাহ সরকার যখন বাসদের তহবিলের স্বচ্ছতা সহ অন্য বিষয়ে খোলা চিঠি লিখেছিলেন সেই সময় আব্দুল্লাহ সরকারের বয়স ছিল ৭০ এর কাছাকাছি । নানান রোগে আক্রন্ত ছিলেন আব্দুল্লাহ সরকার । তহবিলের স্বচ্ছতার দাবি জানানোর অপরাধ হিসেবে বাসদ আব্দুল্লাহ ঔষধ সরবরাহের টাকা বন্ধ করে দিয়েছিল। আব্দুল্লাহ সরকার এর পরে বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না। আব্দুল্লাহ সরকার ২০১৩ সালে ৭২ বছর বয়সে মারা যান।

আব্দুল্লাহ সরকার খোলা চিঠিতে লিখছেন ” দলের তহবিল সম্পর্কে পরিষ্কার কোন চিত্র আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির কোন সভায় হাজির করা হয়নি। খাগড়াছড়ির বাগান, পরিবহন ব্যবসার বিষয়গুলো এখনও ধোঁয়াসাচ্ছন্ন। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ সম্পর্কে কমরেড খালেকুজ্জামানের বাইরে কেন্দ্রীয় নেতারা কিছুই জানেন না। দল কার্যত একটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে রূপ নিয়েছে। ” উল্লেখ্য আব্দুল্লাহ সরকার যে সময় খোলা চিঠি লিখছেন সেই সময় বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন (১) খালেকুজ্জামান (২) মুবিনুল হায়দার চৌধুরী (৩) আব্দুল্লাহ সরকার (৪) শুভ্রাংশু চক্রবর্তী। আব্দুল্লাহ সরকার ২০১১ সালে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। বাকী তিন নেতা বাসদ তিন খন্ডের নিয়ন্ত্রক ও গণচাঁদা ও এই চাঁদার বিনিয়োগের বিভিন্ন অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। বাসদ কর্মীদের ধারণা দলের ভাঙ্গনের প্রক্রিয়ার বাসদ খালেক ৮০ ভাগ সম্পদের নিয়ন্ত্রণে। বাকী ২০ভাগ বাসদ -মার্ক্সবাদী ও সাম্যবাদী আন্দোলের নিয়ন্ত্রণে।

একজন সাধারণ মানুষ যদি জানে বাসদের ৬/৭ তলা বিল্ডিং, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ, পরিবহনে বিনিয়োগ আছে, তবে খুব কম মানুষ বাসদকে চাঁদা দিবে। দল যখন ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটে তখন কেন গণচাঁদা তোলার প্রযোজন হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। কেনইবা পরিবর্তন প্রত্যাশী যুবকদের রাজনৈতিক কাজে নিয়োজিত না করে চাঁদা তোলার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে? বাসদের গণচাঁদা কি বাসদের গণ সম্পৃক্তা বাড়িয়েছে ? অবস্থা দৃষ্টে বিষয়টি এমন মনে হয় না। বাসদ নির্বাচন মুখী দল। সংসদ নির্বাচনের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। নির্বাচনে কালো টাকার দৌরাত্ম, পেশী শক্তির খেলা আছে তবে যে সমস্ত এলাকা থেকে কোটি টাকা তোলা সম্ভব সেই সমস্ত এলাকায় ভোটের পরিমান অতিসামান্য। যে মানুষ দল -আদর্শের জন্য টাকা দিচ্ছে বলে দাবী করা হয় সেই মানুষ গুলি কেন বাসদকে ভোট দিচ্ছে না? ভোট না পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সচরাচর ভিক্ষুকের সাথে ভিক্ষা দাতার কোন সম্পর্ক গড়ে না।

বাসদ – খালেক নির্বাচনী ফলাফল – সূত্র : নিবাচন কমিশন

১৯৯১ সাল প্রাথী ১৩ জন ভোট প্রাপ্তি .১০ (দশমিক ১০)

১৯৯৬ সাল প্রাথী ৩১ জন ভোট প্রাপ্তি .০.০২( শূন্য দশমিক শূন্য দুই )

২০0১ সাল প্রাথী ৩৭ জন ভোট প্রাপ্তি .০.০৪(শূন্য দশমিক শূন্য চার)

বাসদ বিপ্লব আখাঙ্খী যুবকদের বিপ্লবী কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে ছাত্র-যুবকদের চাঁদা ও ভ্যানগার্ড বিক্রির কাজে নিয়োজিত রাখছে। কর্মীদের নিয়োজিত করার কৌশল হচ্ছে আদর্শের কথা বলা। আদর্শের কথা বলে কর্মীদের বিপ্লবী ঝুলি কাঙাল ভিখারী বানাচ্ছে। ফল ভোগ করছে ঢাকার নেতারা! শুধু মাত্র নেতার রুমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অন্যদের জন্য ফ্যান এর বৈষম্যের কথা আব্দুল্লাহ সরকারের খোলা চিঠিতে উঠে এসেছে। বাসদ আব্দুল্লাহ সরকারের খোলা চিটির অভিযোগ গুলির কোন উত্তর না দিয়ে কুৎসা হিসেবে প্রচার করেছে। ২০১০ সালে তিন নেতা এক সাথে ছিলেন। দল বাঁচাও এই স্লোগান দিয়ে কর্মীদের চোখ ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল।

যাদের কাছ থেকে গণচাঁদা পাওয়া যাওয়া যায় তাদের বড় অংশ রাজনীতি বোঝেন না । বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মসূচী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কয়েকজন ছাত্র -যুবক/যুবতী দেখে ভদ্রতা করে চাঁদা দিয়ে থাকেন। চাঁদা দেওয়ার পিছনে ভয়-বা ভক্তি কোনটি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা নেই। রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে তেমন ভাবে অবগত নন তাদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা কতটুকু নৈতিক ? আবার সেই টাকা যখন ব্যবসা বাণিজ্যে বিনিয়োগ তা কতটুকু নৈতিক । গণচাঁদা দলের কর্মীসূচি বা দলের প্রাত্যাহিক কাজ চালানোর জন্য টাকা নেওয়া হয়। যারা চাঁদা দিচ্ছেন, তারা যদি জানেন বাসদ গণ চাঁদা দিয়ে ঢাকা শহর বড় বিল্ডিং, শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে, তাহলে কি এই লোক গুলি চাঁদা দিবে?  ভিন্ন দলের সমর্থক ও দরদিদের নিজের দল্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র কিছু কথার চাতুর্যের আড়ালে, নিজেদের কোন বিশেষ কর্মীসূচীর কথা বলে চাঁদা নেয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক। যে কোনো দলের মানুষের কাছে চাঁদা চাওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে আগে তাকে নিজের দল্ভুক্ত করা।

বাসদের গঠনতন্ত্র গণচাঁদার ব্যবহার এর জবাবদিহিতাকে নিরুৎসাহিত করে আসছে। বাসদের গঠনতন্ত্রের ধারা -১৫ পার্টি তহবিল এর ভাষ্য ” প্রতি বছর পার্টির আয় -ব্যয়ের  হিসাব কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক গঠিত কমিটি দ্বারা অডিট হবে এবং কংগ্রেসে আয়  ব্যয়ের হিসাব উত্থাপন ও অনুমোদন করা হবে। পার্টির একটি ব্যাঙ্ক একাউন্ট যে কোন বাণিজ্যিক ব্যাংকে খোলা হবে। পার্টি তহবিল ব্যাংক একাউন্টে জমা থাকবে। সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধক্ষ্যের যৌথ নামে একাউন্ট পরিচালিত হবে। যে কোন একজনের স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যাবে। কোষাধক্ষ্য নির্বাচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক বা তার মনোনীত কোন সদস্যের নামে একাউন্ট পরিচালিত হবে। – ( গঠনতন্ত্র ১৩-১৪) ।

বাসদের তহবিল সম্পর্কিত ধারণা অস্পষ্ট। সাধারণ সম্পাদকের হাতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দলের ব্যাংক একাউন্ট সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধক্ষ্য এর নামে খোলার বিধান রাখলেও যে কোন একজনের স্বাক্ষরে টাকা তোলার ব্যাবস্থা রয়েছে। একজনের স্বাক্ষরে টাকা তোলার ব্যবস্থা রাখার মধ্য দিয়ে একাধিক ব্যাক্তির নামে ব্যাংক একাউন্ট খোলাকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেসে আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিলের কথা বলা হয়েছে। সুন্দর প্রস্তাবনা। তবে বাসদের প্রথম কংগ্রেস দলের প্রতিষ্টার ৪১ বছর পরে ৪ মার্চ ২০২২ এ অনুষ্ঠিত হচ্ছে! বাসদের গঠনতন্ত্রে কোষাধক্ষ্য নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে সাধারণ সম্পাদক বা তার মনোনীত ব্যাক্তি ব্যাংক হিসেবে পরিচালনা করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঘুরে ফিরে সাধারণ সম্পাদকের হাতেই সব কিছু কেন্দ্রীভূত থাকছে। শিবদাস ঘোষ জাসদ -বাসদের ভাঙ্গন প্রসঙ্গ বই থেকে জানা যায় বিগত ৩০ বছরে বাসদের কোন নির্বাচিত কোষাধক্ষ্য ছিল না। (পৃষ্ঠা ৯৫) । উল্লেখ্য এই বইয়ের লেখক জয়নাল আবেদীন ১৯৮০ সালে বাসদের জন্ম থেকেই এই দলের সাথে যুক্ত ছিলেন।

বাসদের গণচাঁদা পরিবহন খাতে বিনিয়োগ হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বাসদের অঙ্গ সংগঠন। বাসদের রাজনীতি প্রতিফলিত হয় সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নীতি আদর্শে।

ছাত্রদের হাফ ভাড়ার জন্য সোচ্চার সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট । ন্যায় সঙ্গত দাবীর পক্ষে থাকা বিপ্লবী সংগ্রামের অংশ। বাসদের পরিবহন -বাস গুলি কি হাফ ভাড়া নিচ্ছে? সমাজের সাধারণ মানুষদের কাছে কথা ও কাজের মিল না থাকা মানুষদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। বাসদের বিনিয়োগ পরিবহন বা বাগানে যারা কাজ করছেন তারা কি ন্যায্য মুজুরী পাচ্ছেন ? এই কর্মজীবীরা  যে শোষিত হচ্ছেন না তার নিশ্চয়তা কোথায় ?

গণচাঁদা ছাড়া দল চলে। ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও মতাদর্শ নিষিদ্ধ ছিল এই ভূখণ্ডে। মার্ক্সবাদী সাহিত্য রাখার অপরাধে গ্রেফতার নির্যাতনের নজির রয়েছে। এই সময়ে, এই ভূখণ্ডে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শের দল সক্রিয় ছিল। সমাজতন্ত্রী আদর্শের বই পুস্তকের বড় অংশ এই সময়েই অনূদিত হয়েছে। কমিউনিস্ট নাম নিয়ে রাস্তায় গণচাঁদা তোলার কোন সুযোগ ছিল না। এরপরেও পাকিস্তানী শাসনের প্রায় সিকি শতাব্দী ছিল সাজতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের উজ্জ্বল দিক। গণচাঁদা না তুলেও দল চালানের প্রায়োগিক অভিজ্ঞাতা ভূমিজাত।

———————-

সহায়ক গ্রন্থ :

 

১. আব্দুল্লাহ সরকার স্মারক গ্রন্থ। প্রকাশক: আব্দুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদ। ঢাকা। অগাস্ট ২০১৪।

২. শিবদাস ঘোষ জাসদ – বাসদ রাজনীতি ও ভাঙ্গন প্রসঙ্গ – লেখক জয়নাল আবেদীন । খড়িমাটি প্রকাশন।  চট্টগ্রাম। প্রকাশ কাল ২০১৪।

৩. বাসদ (মার্কসবাদী)র অভ্যন্তরে মতাদর্শিক সংগ্রামের দুটো দলিল’

বাংলাদেশের সাম্যবাদী অন্দোলন, কেন্দ্রীয় পাঠচক্র ফোরাম। প্রকাশকাল ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১.

৪. বিপ্লবীদের অর্থ সংগ্রহ প্রসঙ্গে – বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি ঢাকা। দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৭।

৫. বাসদের সর্বস্তরের নেতা – কর্মী – সমর্থক শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আহ্ববান – আব্দুল্লাহ সরকার। ১ অগাস্ট ২০১০। ঢাকা।

৬.দলত্যাগীদের কুৎসা ও অপপ্রচারের জবাব – বাসদ। ২৩/২ তোপখানা রোড। ঢাকা। ২৫অগাস্ট ২০১০। ঢাকা।

৭. কথিত কুৎসা ও অপপ্রচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে – আব্দুল্লাহ সরকার ও সাইফুর রহমান তপন। ঢাকা। অক্টোবর ২০১০।

৮.গঠনতন্ত্র – বাসদ। প্রকাশ কাল ১ অক্টোবর ২০০৮।

 

পাদটীকা:

 

বাসদ –  বাসদ খালেক, বাসদ -মার্ক্সবাদী, সাম্যবাদী আন্দোলন বুঝানো হয়েছে। ১৯৮৩ সালের পর বাসদ -খালেক এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে খালেকুজ্জামান, মুবিনুল হায়দার, আব্দুল্লাহ সরকার, শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী ছিলেন । এই দল ২০১৩ সালের পর ভেঙে তিন দলে পরিণত হয়েছে। বাসদ দিয়ে এই তিন অংশকেই বুঝানো হয়েছে। এর বাইরে বাসদ – মাহবুব এর অস্তিত্ব রয়েছে। এই গ্ৰুপের তেমন কোন কাজ কর্ম চোখে পড়ে না। গণচাঁদাতেও এই গ্ৰুপের অংশ গ্রহণ দেখা যায় না।