মতামত

খোলা চিঠির খেসারত: বিধান চ্যাটার্জী থেকে আব্দুল্লাহ সরকার -এসইউসিআই ও বাসদের রাজনীতি

-অপু সারোয়ার

সার্বজনীন শিক্ষা আব্দুল্লাহ সরকার

  ফেব্রুয়ারী ২০১৩, আবদুল্লাহ সরকার মারা যান। আব্দুল্লাহ সরকার ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুরের হাইমের চর থেকে স্বতন্ত্র হিসাবে জয়লাভ করেছিলেন। পরে জাসদ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ -সভাপতি ছিলেন। ১৯৮০ সালে গঠিত বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। আবদুল্লাহ সরকার বামপন্থীদের মধ্যে খুব অল্প সংখক কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জীবন জীবিকার জন্য কোন একটা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে বিএলএফ- মুজিব বাহিনীর সদস্য সংগ্রহের জন্য চাঁদপুরে কাজ করেছেন আবদুল্লাহ সরকার । পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সেই সময়ে আক্রোশে আব্দুল্লাহ সরকারের পৈতৃক বাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধকালীন সময়ে । তৎকালীন মুজিব বাহিনীর প্রধান সংগঠকদের একাংশ যারা যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে জাসদ গঠন করেছিলেন । বিএলএফ যোগাযোগ পরবর্তী কালে আব্দুল্লাহ সরকারকে জাসদে টেনে নিয়ে থাকতে পারে।

যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশে নিজ এলাকায় ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল খুলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের পড়াশুনার ছেদ ঘটিয়ে স্কুলের দায়িত্ব ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আবদুল্লাহ সরকার। সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আব্দুল্লাহ সরকার সচেষ্ট ছিলেন। আব্দুল্লাহ সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে হাইমের চরের স্থানীয় একজন, অজয় মজুমদার লিখছেন ” ১৯৬৮ সালে নিজের জমি বিক্রয় করে প্রতিষ্টা করেন হাইম চর সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও হাইম চর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের খোঁজ খবর নিতেন। যারা অভাবের কারণে পড়া বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের বাবা মার সাথে কথা বলে বিদ্যালয়ে আসার ব্যবস্থা করতেন এবং সমস্ত খরচ বহন করতেন। (আব্দুল্লাহ সরকার স্মরাক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ১১৮) ।

ছাত্র জীবনে আব্দুল্লাহ সরকার তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন ( মতিয়া ) এর সাথে যুক্ত ছিলেন। হাইমের চরে দুইটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ছাত্র ইউনিয়নের সর্বজনীন শিক্ষার দাবী অনুপ্রেণার ও অনুঘটকের কাজ করে থাকবে। তৎকালীন সময়ে স্কুল কলেজ প্রধানত মহুকুমা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। অধিকাংশ থানা -উপজেলাতে এসএসএসসি পাশের পর পড়ার সুযোগ ছিল না। যে সমস্ত কলেজ ছিল সেই কলেজগুলির মান ভাল ছিল না। ইউনিয়ন পর্যায়ে ৫/৭ মাইল হেটে স্কুলে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক। বৃষ্টি- বাদল , বর্ষার দিনে রাস্তা-ঘাটহীন জনপদে পড়াশুনা চালানো কঠিন ছিল। সেই সময় শিক্ষকদের বেতনের ৩৩% সরকারী অনুদান থেকে আসত। শিক্ষা সংকোচনের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগকে উপেক্ষা করে স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্য এলাকার মানুষদের সাথে নিয়ে কাজ করেছেন আবদুল্লাহ সরকার। প্রধান শিক্ষক হিসেবে আব্দুল্লাহ সরকার নিয়োজিত ছিলেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত।

 জাসদ থেকে বাসদ

১৯৭৯ সালে জাসদের মধ্যে অতীত মূল্যায়ন ও ভবিষৎ কর্মপন্থা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৮০ সালে জাসদ থেকে বাসদ তৈরী হয়। জাসদের মধ্যে বিতর্কে ” কেন জাতীয় সরকার ” শিরোনামে পুস্তিকা প্রকাশ করে বাসদপন্থীরা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছিল। বাসদের প্রারম্ভিক পুস্তিকা আব্দুল্লাহ সরকারের লেখা ছিল । বাসদ গঠনের পর আমলাতন্ত্র দলের নেতৃত্ব দখলের পর বাসদের প্রারম্ভিক পুস্তিকা হিমায়িত মহাফেজখানায় স্থান পায়। ১৯৮৩ সালে বাসদ ভেঙে যায়। এই ভাঙ্গনের মূল বিতর্ক ছিল ভারতের এসইউসিআইকে অনুসরণ করা নিয়ে। এই বিতর্কে খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া সহ ছয়জন এসইউসিআই পন্থীরা পক্ষে দাঁড়ায়। শুরু হয় খালেক -হায়দার নিয়ন্ত্রণ। এই ভাঙ্গনের অল্প দিনের মধ্যে বাসদ- কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য একরামুল হক ও মোস্তাফিজুর রহমানকে দৃশ্যপট থেকে মুছে ফেলা হয়। এই দুই কেন্দ্ৰীয় সদস্যের রাজনৈতিক অগস্থ্য যাত্রা নিয়ে বাসদ খালেক -হায়দার নীরবতার আশ্রয় নিয়ে এসেছে। ১৯৮৩ সালে ভাঙ্গনের সময় বাসদ খালেক -হায়দার গ্রুপ ধর্মীয় পারিবারিক মূল্যবোধের ধোঁয়া তুলে দলের বড় অংশকে কাছে টানতে সক্ষম হয়েছিল। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্যের সাথে মহিলা ফোরামের একজনের সম্পর্কে এই বিতর্কের সময় সামনে আনা হয়েছিল। খালেকুজ্জামান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ ছিল। তবে দলের আহবায়ক হিসেবে এই অভিযোগ আলোচনা করতে অস্বীকার ও অপারগতা প্রকাশ করছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর পর এই বিতর্ক হাস্যকর মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে ১৯৮৩ সালে দেশের সামাজিক পটভূমিতে খুব বেশী স্বস্তিকর ছিল না।

বিভক্ত বাসদ

আব্দুল্লাহ সরকার এসইউসিআই অনুসরণের পথের পথিক হন। ১৯৮৩ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আব্দুল্লাহ সরকার এই গ্ৰুপের রাজনীতি ধারণ করেছেন। ২০১০ সালের আগে কোন বিতর্ক – মতবাদিক সংগ্রাম সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। এর আগে ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি নুরুল ইসলাম দলের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে ছিলেন। নুরুল ইসলামের উত্থাপিত অভিযোগ গুলির সাথে আব্দুল্লাহ সরকারের অভিযোগ গুলির মিল রয়েছে। সেই সময়ে আব্দুল্লাহ সরকার সহ বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি নুরুল ইসলামের অভিযোগকে গুরুত্ব দেয় নাই। ২০১০ সালে আব্দুল্লাহ সরকার যখন দলের নেতা কর্মীদের কাছে খোলা চিঠি লেখেন তখনও তিনি বাসদের রাজনীতির সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন না। দলের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা ও নারী কর্মীদের যৌন নিপীড়ণের বিরুদ্ধে কথা বলে ছিলেন মাত্র । দলের রণনীতি রণ কৌশল নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না। সংক্ষিপ্ত কথায় , আব্দুল্লাহ সরকার বাসদের সংস্কার চেয়ে ছিলেন। এই সময় আব্দুল্লাহ সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান সঠিক -কি বেঠিক ছিল তা এই আলোচনার অংশ নয়।

আব্দুল্লাহ সরকারের খোলা চিঠির প্রধান অভিযোগ গুলি ছিল:

(১) দলের তহবিল পরিচালনায় অস্বচ্ছতা

(২) কেন্দ্রীয় কমিটি অকার্যকর,দল ব্যক্তির ইচ্ছায় পরিচালিত

(৩) দলের নেতাদের মধ্যে নারী কর্মীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক

(৪) সঠিক বিপ্লবী দল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মার্কস বাদী চর্চা নেই

(৫) নেতাদের বিলাসী জীবন, গণচাঁদায় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের জন্য ফ্লাট কেনার মত বিষয়

পারিপার্শিক অবস্থা প্রমান করে আব্দুল্লাহ সরকার যা বিশ্বাস করতেন তা কর্যকর করার চেষ্টা করেছেন। বাসদ ব্যাক্তি সম্পত্তি বিরোধী আকর্ষণীয় স্লোগান দিত। কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যাক্তি সম্পত্তি পার্টির কাছে হস্তান্তরের কথা প্রকাশ্যে প্রচারে আনে। আব্দুল্লাহ সরকার এ সম্পর্কে বলেন ” আমরা ব্যাক্তিগত সম্পত্তিকে সামাজিক সম্পত্তিতে রূপান্তরের অংশ হিসেবে আমাদের ব্যাক্তিগত সম্পত্তি দলের কাছে সমর্পনের অঙ্গীকার করেছিলাম। অন্যদের বিষয়টা জানি না। আমি আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার ভাগে পড়া পারিবারিক সম্পত্তির সমস্ত কাগজ কমরেড খালেকুজ্জামানের কাছে জমা দেই। ” ২০১০ সালের শেষের দিকে তিনি উপলব্ধি করেন চার সদস্যদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যাক্তি সম্পত্তি পরিত্যাগ করার যে অমৃত স্লোগান দল তুলেছে তা নিজ জীবনে পালন করছেন। ২০১০ সালে এসে তিনি দেখলেন অন্য তিন নেতা ( খালেক – হায়দার – শুবরাংশু ) নিজেদের বয়ানকে নিজেরাই পদদলিত করেছেন।

১৯৮৩ সালে এস ইউ সিআই – শিবদাস ঘোষ পন্থী হওয়ার পথে যিনি সম্পত্তি ত্যাগ করছিলেন তিনি ২০১০ সালে এসে দেখলেন বাসদ-খালেক হায়দার ভিন্ন পথে চলছে। গণচাঁদা সংগৃহিত অর্থ শেয়ার মার্কেট, পরিবহন খাত, দালান ব্যবসায় বিনিয়োগ হয়েছে। দল ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে। বাসদ- খালেক কখন , কিভাবে শেয়ার মার্কেট, পরিবহন ব্যবসার জড়িয়ে গেল সে সম্পর্কে আব্দুল্লাহ সরকার খোলা চিঠিতে কিছু উল্ল্যেখ করেন নাই। গণচাঁদায় অর্থ সংগ্রহ করে বাণিজ্যিক বিনিয়োগ এর পদ্ধতি নিয়ে আব্দুল্লাহ সরকার কোন প্রশ্ন তোলেন নাই। আব্দুল্লাহ সরকারের প্রশ্ন ছিল স্বচ্ছতা -জবাবদিহিতা নিয়ে ও দলকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে পরিণত করার বিরুদ্ধে। জনগণের কাছ থেকে দলের কাজ চালানোর জন্য অর্থ সংগ্রহের পর সেই টাকা বাণিজ্যিক বিনিয়োগ কথা ও কাজের সাথে অসঙ্গতি পূর্ন – এই বিষয়ে আব্দুল্লাহ সরকার নিরব থেকেছেন। খোলা চিঠির সীমাবদ্ধতা এখানেই। তবে বাসদ – খালেক এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি বাসদ-খালেক এর ব্যবসায়ী হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি সামনে না আনলে এই বিষয়টি আলোর মুখ দেখতে ও গ্রহণ যোগ্যতা পেতে অনেক বেশি সময় লাগতো। বামপন্থী দলের সম্পত্তি রক্ষনাবেক্ষনের নিয়ম নীতি নিয়েও খোলা চিঠিতে কোন আলোচনা নেই।

আব্দুল্লাহ সরকার প্রত্যাশা করেছিলেন দল নেতাদের জন্য ফ্লাট কেনার পরিবর্তে পার্টি ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তুলুক। আব্দুল্লাহ সরকারের খোলা চিঠি থেকে জানা যায় বাসদ- খালেক দলের নেতা কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য জায়গা কিনেছিল। পরবর্তীতে এই জায়গার হদিস না পাওয়ায় আব্দুল্লাহ সরকার খোলা চিঠিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন ” পেশাদার বিপ্লবী গড়ে তোলার জন্য একটা ট্রেনিং ইনিস্টিটিউড গড়ে তোলার কথা ছিল। জায়গাও কেনা হয়েছিল। সে জায়গা এখন কোথায় ?” দলের অপ্রত্যাশিত উল্টো পথে চলার বিরুদ্ধে তিনি নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি প্রকাশ করে ছিলেন।

এই চিঠিতে গণচাঁদার জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ ও দলের মহিলা কর্মীদের নেতাদের যৌন আকাঙ্খা পূরণের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ এনেছেন। প্রসঙ্গত আব্দুল্লাহ সরকার বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। উত্থাপিত বিষয় গুলি সম্পর্কে তিনি স্পস্টতঃ ওয়াকিবহাল ছিলেন। মার্কস কোন এক প্রসঙ্গে বলছিলেন যদি কেউ ইংল্যান্ডের চার্চ -গীর্জার অর্থনৈতিক স্বছতার বিষয়কে বাদ দিয়ে ৩৯টি ধারার মধ্যে ৩৮টি ধারা নিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলে , তবে চার্চের বিরাগভাজন থেকে রক্ষা পেতে পারে। তবে গীর্জার বিরাগ ভাজন হওয়ার জন্য একটি মাত্র ধারা -নিয়ম অর্থনৈতিক স্বছতার দাবী তুলেই খড়্গ নেমে আসবে। আব্দুল্লাহ সরকারের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। ‘বাসদ’ আব্দুল্লাহ সরকারের ঔষধ কেনার আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। আব্দুল্লাহ সরকারের পরিবার বাসদ -খালেক এর হামলার শিকার হয়েছিল। হামলার বিষয়টি পত্রিকাতে এসেছিল।

মতবাদিক সংগ্রামের বাসদীয় ধারবাহিকতা……

আবদুল্লাহ সরকারের উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নাই বাসদ ( খালেক – হায়দার ) । বরং খোলা চিঠিকে এটাকে কুৎসা রটনা বলে চালিয়ে দিয়েছে । বাসদ ( খালেক – হায়দার ) সব সময় দলের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা কে অনুৎসাহিত করেছে। বাসদ ( খালেক – হায়দার ) এর চট্টগ্রামের প্রাক্তন সংগঠক, শ্রমিক নেতা আ ক ম রইসুল হক বাহার এর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় ” ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে আমি বাসদ ছাড়ি। ………দলের কেন্দ্রীয় বিশেষ শিক্ষা শিবিরে আমার মনে জাগা কমিউনিস্ট বিপ্লবের ভবিষৎ সম্পর্কিত প্রশ্ন গুলো তুলেছিলাম এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে অত্যন্ত ক্রূদ্ধ ও অরাজনৈতিক জবাব পেয়েছিলাম। যাদেকে এসব কথা বলছি তারা সকল ভিন্ন ভিন্ন কারণে ১৯৯৬- ১৯৯৭ সালে এসে দল ছাড়ে। তারও প্রায় ১৩-১৪ বছর পর নানা রকমের অভিযোগ তুলে সরকার ভাইও দল ছাড়লেন। ভবিষতে আরও কোন সরকার ভাই বা রাজু -পাশা -বালাগাত হয়তো দল ছাড়বেন। ” ” আমাদের দেশে আদর্শের বুলি কপচানো মানুষগুলোর ভেতরের আসল রূপটি চিনে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ভাইয়ের মৃত্যু আমরা যারা এখনো জীবিত আছি তাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। ” ( আব্দুল্লাহ সরকার স্মরাক গ্রন্থ , পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬)

আব্দুল্লাহ সরকারের শেষ রাজনৈতিক অবস্থান নাগরিক ঐক্য 

আব্দুল্লাহ সরকারের নাগরিক ঐক্যেও সম্পৃক্ততা নিয়ে মান্না ছাড়া অন্য কেউ এমন দাবী করেনি। যদি আব্দুল্লাহ সরকার নাগরিক ঐক্যেও উপদেষ্টা হয়ে থাকেন তবে সেটা হবে চারদশকের বামপন্থী রাজনীতির সাথে ছেদ ঘটানো। মার্কসবাদীদের কাছে ‘সামাজিক সংগঠন’ বলে কিছু নেই। প্রত্যেক সংগঠনই কোন না কোন শ্রেনীর প্রতিনিধি। নাগরিক ঐক্য এর ব্যতিক্রম নয়। ২০১২-১৫ এর মধ্যে নাগরিক ঐক্য নিজেদেরকে সামাজিক সংগঠনের স্লোগানে আবৃত করলেও হাল আমলে খোলস ছেড়ে রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা উড়িয়ে দিয়েছে।

আব্দুল্লাহ সরকারের স্মৃতি রক্ষায় গঠিত হয়েছে ‘কমরেড আব্দুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদ’। একটা শুভ উদ্যোগ। আব্দুল্লাহ সরকার স্মারক গ্রন্থ প্রকাশনা স্মৃতি সংসদের বড় ধরনের কাজ। আব্দুল্লাহ সরকারের সবচেয়ে বড় পরিচয় একজন মার্কসবাদী। এই পরিচয়েই তিনি পরিচিত ছিলেন তার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে। অক্টোবর ২০১০ সনে বাসদ (খালেক) থেকে পদত্যাগ করা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ফেব্রুয়ারী ২০১৩ পর্যন্ত আব্দুল্লাহ সরকারের অবস্থান নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য উল্লেখিত স্মারক গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মাহমুদর রহমান মান্না – রংধনু রাজনীতিবিদ দাবী করে থাকেন আব্দুল্লাহ সরকার নাগরিক ঐক্যে যোগ দিয়েছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্না আব্দুল্লাহ সরকার স্মৃতি সম্পর্কে লিখেছেন ” জীবনের শেষদিকে জনাব আব্দুল্লাহ সরকার সামাজিক সংগঠন নাগরিক ঐক্যের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। যে দলের জন্য বলতে গেলে তিনি জীবনের প্রায় সমস্তটা সময় বায় করেছেন। সেই দলের সাথে তীব্র মত পার্থক্য হয় , নেতৃবৃন্দকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন তিনি এবং শেষ পর্যন্ত দল ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন। আগেই বলেছি , সমস্ত সম্পত্তি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়ে ছিলেন। তিনি নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা ছিলেন। ” ( স্মরাক গ্রন্থ – পৃষ্টা ২৮) মান্নার এই দাবীর প্রেক্ষিতে আব্দুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদ নিরব থাকার মধ্য দিয়ে ধোঁয়াশা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সহায়তা করেছে।

মান্নারা কেন আব্দুল্লাহ সরকারকেও কাছে টানতে চান?

জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি আপোষ করেন নি। ফিরিয়ে দিয়েছেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের প্রলোভন প্রস্তাব। মৃত্যু পথযাত্রী দলকে সংষ্কারের দাবী থেকে কখনো সরে আসেন নি। মত বিরোধ না মিটিয়ে বাসদ (খালেক) এর সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এসব কিছুই একজন আপোষহীন মানুষের চিত্র।

ছয় / সাত বার দল বদলকারী মান্নার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রয়াত আব্দুল্লাহ সরকার মান্নাদের প্রচারণায় ও খেলার বস্তু হয়ে পড়ে । আব্দুল্লাহ সরকার মান্নার সাথে আছে এ দিয়ে বাসদ রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ও মোহমুক্ত অনেকের সরাসরি অথবা নৈতিক সমর্থন পাওয়ার প্রত্যাশাই মান্নাকে আব্দুল্লাহ সরকারকে পণ্য করে থাকতে পারে। নাগরিক ঐক্যের কে কখন কোন পদ পদবীতে আছেন তার কোন হদিস নেই। মাহমুদুর রহমান মান্নার ঘোষণা একমাত্র দলিল! আব্দুল্লাহ সরকার কিছু লিখে যান নাই তাই মাহমুদুর রহমান মান্নার দাবীকে যুক্তি প্রমান দিয়ে খণ্ডন করার কোন পথ নেই।

আব্দুল্লাহ সরকার স্মারক গ্রন্থে এক বিপ্লবীর অন্তিম যাত্রা নামে স্মৃতি কথা লিখেছেন সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ পৃষ্টা ৪৯। জাসদ ও বাসদের জন্মলগ্ন থেকে জড়িত ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮১ সালে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের দেশ ব্যাপী লাগাতর কর্ম বিরতির অন্যতম নেতা ছিলেন। সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সেন্টার -এসডিসি নামের একটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন। তিনি আব্দুল্লাহ সরকারকে সেই সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সংগঠন গড়ে উঠার প্রস্তুতি সভা গুলিতে সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসাবে মেনে নিতে সদস্যদের কেউ কেউ দ্বিমত পোষণ করলে আব্দুল্লাহ সরকার নিজেকে প্রস্তুতির উদ্যোগ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ লিখছেন ” তিনি [ আব্দুল্লাহ সরকার ] এটাও স্পষ্ট করেছিলেন যে একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সম্ভব। এই বিশ্বাস তাঁর এখনও দৃঢ় এবং এই অঙ্গীকারের প্রতি তিনি বিশ্বস্ত থাকতে চান ” সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ আব্দুল্লাহ সরকার এই বক্তব্যের সময় কাল হিসাবে ” শেষ বারের মত অসুস্থ হওয়ার কিছু দিন আগে ” উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ সুলতান উদ্দিন এর বক্তব্য পারিপার্শ্বিকভাবে প্রমান করে আব্দুল্লাহ সরকার মার্ক্সবাদের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। তবে মাহমুদর রহমান মান্নার ঢোল মাদলের কাছে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদর বক্তব্য নিষ্প্রভ।

বামপন্থীদের বিচ্ছিন্নতার যুগে আব্দুল্লাহ সরকার

বাংলাদেশের তাবৎ বামপন্থীদের ক্ষেত্রে প্রায় সমান ভাবে প্রযোজ্য জন সম্পৃক্তার অভাব অভিযোগটি জোরালো ভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। এই অভিযোগের অন্যতম কারণ এই দল গুলির ভাঙ্গন। অন্য কারণ গুলির অন্যতম হচ্ছে দলীয় কর্মসূচীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং সেই সব কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণের অনীহা। বামপন্থীদের কর্ম উদ্যোগের অভাব নেই তারপরেও যেন কোথায় কিছুর ঘাটতি রয়েছে। আব্দুল্লাহ সরকার সম্ভবত বামপন্থী বৃত্তের বাইরে গিয়ে এলাকার মানুষদের সংগঠিত করে ১৯৮৯ সালে মেঘনার ভাঙ্গন রোধে হাইম চরের সর্বস্তরের মানুষকে সংগঠিত করে ঢাকায় অনশন সহ রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করেছিলেন। মেঘনার ভাঙ্গন রোধের কর্মীসূচিতে ঢাকাতেও বিভিন্ন মহলের সংহতি -সমর্থন  সফল ভাবে আদায় করেছিলেন। এই কর্মসূচী মেঘনার ভাঙ্গন ও হাইম চর  জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়েছিল।

আব্দুল্লাহ সরকারের আরেকটি উদ্যোগ শহীদ কাইয়ুম পাঠাগার শুরুর উদ্দ্যোগে। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে সকল পর্যায়ে আবেগী বক্তব্যের অভাব নেই। তবে শহীদ স্মৃতি, শহীদের নামের তালিকা ,  গণহত্যার স্থান,  গণ হত্যার শিকারদের তালিকা প্রস্তুতের রাজনৈতিক কর্মীসূচি বামপন্থীদের মধ্যে নেই। বামপন্থীদের অনুপস্থিতে  পাঁচ দশকের সকল ক্ষমতাসীনরা দলীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাবহার ও রাজনৈতিক পণ্য করেছে। শহীদ কাইয়ুম পাঠাগার বামপন্থীদের বিচ্ছিন্নতা অবসানের ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও সারা দেশের বামপন্থী কর্মীদের কাছে কর্মের দিক নির্দেশনা ছিল।

বিধান চ্যাটার্জীর খোলা চিঠি আত্ম হত্যা

বিধান চ্যাটার্জী ভারতের স্যোসালিষ্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ রাজকমিটির নেতা ছিলেন । দলীয় আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিন দশক তিনি দলের সাথে জডিত ছিলেন বিধান চ্যাটার্জী। দলীয় আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিধান চ্যাটার্জী কোনঠাসা হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ১০ এপ্রিল ২০০৮ সনে বিধান চ্যাটার্জী আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর জন্য এসইউসিআই নেতৃবৃন্দকে দায়ী করে সুইসাইড নোট লিখে যান। ১০ এপ্রিল ২০০৮, কোলকাতার সকল গণমাধ্যম্যের সংবাদ শিরোনাম এসইউসিআই এর পশ্চিম বাংলার রাজ্যকমিটির নেতা বিধানের আত্মহত্যার সংবাদ। বিধানের আত্মহত্যার নোটটি অন্য দশটি আত্মহত্যা নোট থেকে ভিন্ন। বিধান আত্মহত্যার জন্য এসইউসিআই নেতৃবৃন্দকে সরাসরি দায়ী করেছেন। বিধান কোলকাতায় অবস্থিত এসইউসিআই এর কমিউনে থাকতেন। বিধান চ্যাটার্জীর কোন অভিযোগের সরাসরি উত্তর দেওয়া থেকে এসইউসিআই বিরত থেকেছে। দলের মুখপত্র —- ১৫ এপ্রিল ২০০৮ সংখ্যায় বিধান চ্যাটার্জীর অভিযোগগুলোকে কুৎসা ও মিথ্যাচার বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু, পত্রিকায় বিধান চক্রবর্তীর মৃত্যুও বিষয়কে বর্ণনার নাম করে রাজরীতির নানা কথা বলা হয়েছে। এসইউসিআই এর সাথে সিপিএম এর নৈতিক পার্থক্যের বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বিধান চ্যাটার্জী উত্থাপিত কোন প্রশ্ন সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও উল্লেখ নেই। শুধুমাত্র উত্থাপিত বিষয় মিথ্যা হিসেবে নাকচ করেও দেওয়া হয়েছে। কোন যুক্তি প্রমাণ দিয়ে অভিযোগগুলোকে নাকচ করা হয়নি। তিন দশকের রাজনৈতিক সাথী বিধান চ্যাটার্জীর মৃতদেহ সৎকারের দায়িত্ব থেকে দল মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

এসইউসিআই এর কমিউনগুলো অমানবিক আচরনের জন্য শিবদাস ঘোষের জীবদ্দশাতেই পরিচিতি লাভ করে। এই অমানবিক আচরনের পরিচিতি অবশ্যই শিবদাস ঘোষকে কেন্দ্র করেই। এসইউসিআই এর কমিউনে প্রথম দিকে কোন মহিলার রাত্রিযাপন করার নিয়ম ছিল না। কোন একদিন শিবদাসের স্ত্রী তার শিশু সন্তানকে নিয়ে শিবদাসের সাথে দেখা করতে আসেন। হঠাৎ করে প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। কমিউনে সভা বসে শিবদাসের স্ত্রী ও শিশু সন্তানের থাকার অনুমতি মেলে। কিন্তু বিধিবাম। এবার শিবদাস নিজে বেঁকে বসেন। শিবদাস পূর্বনির্ধারিত নীতি অনুযায়ী তার স্ত্রী এবং শিশুকে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে কমিউন ছাড়তে বাধ্য করেন। এর পরের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। শিবদাসের স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে শিবদাস ও দলের সাথে সকল পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। উল্লেখ্য, পরবর্তীতে এসইউসিআই এর কমিউনে মহিলাদের থাকার বিষয়ে নীতি শিথিল করা হয়।

——–

সহায়ক গ্রন্থ তথ্য সূত্র :

 

১. আব্দুল্লাহ সরকার স্মরাক গ্রন্থ ,-কমরেড আব্দুল্লাহ সরকার স্মৃতি সংসদ। ঢাকা ২০১৪ ।

২.জয়নাল আবেদীন, শিবদাস ঘোষ জাসদ-বাসদ রাজনীতি ও ভাঙন প্রসঙ্গ, খড়িমাটি প্রকাশন, চট্টগ্রাম ।

৩. বিপ্লবী দলের মতবাদিক সংগ্রাম , অন্ধ অনুকরণ বাদ ও কোটারী প্রসঙ্গে – প্রকাশ কাল ১ জানুয়ারী ১৯৮৪। প্রকাশক বাসদ- মাহবুব ।

৪. Daily Star – September 02, 2010. Dhaka.

৫. The Indian Express, April 21, 2008