শিল্প সাহিত্য

শেক্সপিয়ার’স গ্লোবঃ থিয়েট্রিক্যাল লন্ডনের হৃদস্পন্দন

– কাউসার রুশো

মহামতি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছিলেন গোটা পৃথিবীটাই নাকি একটা রঙ্গমঞ্চ! সেই শেক্সপিয়ারের রঙ্গমঞ্চ ছিলো লন্ডনের গ্লোব থিয়েটার যা বর্তমানে ‘শেক্সপিয়ার`স গ্লোব’ নামে পরিচিত। লন্ডনের থেমস নদীর পাড়ে অবস্থিত এই থিয়েটারটিতে মঞ্চনাটক দেখার পাশাপাশি সুযোগ আছে গাইডেড ট্যুর নিয়ে ঘুরে দেখার। এবার লন্ডনে এসে জানতে পারলাম গ্লোবে  ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ মঞ্চস্থ হচ্ছে। কিন্তু এ যাত্রায় নাটক দেখার সময় মিলবেনা। তাই গাইডেড ট্যুরের টিকেট কাটলাম। অন্তঃত থিয়েটার হলটা তো ঘুরে দেখা যাবে।

লন্ডনের মিলেনিয়াম ব্রীজ পার হলেই দেখা মিলে গ্লোবের। পাশেই টেট মর্ডান আর্ট গ্যালারি। মিলেনিয়াম ব্রীজের এপাশের প্রান্ত থেকে একটু নজর ফেরালে ঐতিহাসিক সেইন্ট পল ক্যাথেড্রাল উকি মারে। ব্রীজ থেকে নেমে গ্লোবের দিকে হাঁটা দিলে কাছে আসতে শুরু করে বিখ্যাত টাওয়ার ব্রীজ। গ্লোবের চারপাশটাই তাই খুব মনোরম।

থিয়েটারের মূল ভবনটাকে বাইরে থেকে দেখতে সাদামাটাই লাগে। গাইডেড ট্যুরের নির্ধারিত সময়ের আগেই ভেতরে ঢুকে গেলাম । একজন গাইড অভ্যর্থনা জানিয়ে আরো কিছু দর্শণার্থীর সঙ্গে আমাদের জড়ো করলো । বললো একটু অপেক্ষা করতে অথবা এই ফাঁকে চাইলে স্মারক উপহারের দোকানটি ঘুরে দেখতে। আমি চট করে গাইডবুক আর ফ্রিজ ম্যাগনেট কিনে নিলাম। কোথাও ঘুরতে গেলে সচারচর এই দুটো জিনিস আমি সংগ্রহে রাখার চেষ্টা করি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাইড ডেকে নিয়ে গেলো আমাদের। কমবয়সী হাসিখুশি এক ইংরেজ তরুণী । প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে পুরো জায়গাটি ঘুরে দেখানোর পাশাপাশি মেয়েটি জানাতে থাকালো গ্লোবের ইতিহাস। তার চমৎকার উপস্থাপনার কৌশলের কারণে মনে হলো ইতিহাস নয় কোন গল্প শুনছি। এ দেশের গাইডদের মধ্যে এ ব্যাপারটা আমি আগেও খেয়াল করেছি।  এরা এত দুর্দান্তভাবে উপস্থাপন করে, মনে হয় কয়েকশো বছরের আগের ঘটনাটা যেন চোখের সামনেই ঘটছে!

লর্ড চেম্বারলেন্স মেন নামে একটি থিয়েটার কোম্পানির সদস্য ছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। এই কোম্পানির হাত ধরেই গ্লোব থিয়েটারের গোড়াপত্তন ঘটে । নিজের দুই ছেলে রিচার্ড আর কাথবার্টকে নিয়ে জেমস বার্বেজ এই থিয়েটারটি পরিচালনা করতেন । তৎকালীন সময়ে শেক্সপিয়ারসহ অনেক প্রথিতযশা নাট্যকারের নাটক তারা মঞ্চস্থ করতেন। সেই সময়ে লন্ডনে ধনীদের বিনোদনের মাধ্যম ছিলো থিয়েটার।  বার্বেজদের কারনে থিয়েটার সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছুতে শুরু করে। বেশ ভালোই চলছিলো তাদের । কিন্তু সমস্যা হলো থিয়েটারের জমিটা বার্বেজদের ছিলোনা। তারা একুশ বছরের জন্য জাইলস এলেন নামক এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছিলেন । মেয়াদ ফুরিয়ে এলে নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানান জাইলস ।  উল্টো থিয়েটারসহ জমি দাবি করে বসেন। এ ঘটনায় বার্বেজরা বিহব্বল হয়ে পড়েন। ততদিনে জেমস মারা গেছেন আর রিচার্ড তার স্থলাভিষক্ত হয়েছেন। সেই সময় কাউন্সিল তাদের আরেকটি নাট্যশালা বন্ধ করে দেওয়ায় আর্থিকভাবেও বার্বেজরা বেশ কঠিন সময় পার করছিলেন।

এমন টালমাটাল সময়ে অভিনব এক বুদ্ধি আঁটলেন বার্বেজ ভ্রাতৃদ্বয় । জাইলস তখন নিজের গ্রামের বাড়িতে ক্রিসমাসের ছুটি কাটাচ্ছেন। এই সুযোগে বার্বেজরা এক দিনের মধ্যে নাট্যশালার কাঠগুলো খুলে লুকিয়ে ফেলেন ব্রিডওয়েলের এক গুদামঘরে। তারপর সবাই মিলে খন্ড খন্ড থিয়েটারকে থেমসের ওপারে নিয়ে গেলেন। আগের চেয়েও বড় করে গড়ে তুললেন নতুন মঞ্চ । নাম দিলেন গ্লোব থিয়েটার। ১৫৯৯ সাল থেকে শুরু হলো গ্লোব থিয়েটারের যাত্রা। পরবর্তী ১৪ বছর সগৌরবে চলতে থাকে গ্লোবের কার্যক্রম। এখানেই প্রথম মঞ্চায়ন হয় শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, ওথেলো, কিং লিয়ার এর মত জনপ্রিয় নাটকগুলোর ।

১৬১৩ সালের ২৯ জুন গ্লোব থিয়েটারের জন্য একটি অশুভ দিন। ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুরো গ্লোব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শেক্সপিয়ারের অল ইজ ট্রু নাটকের তৃতীয় মঞ্চায়ন চলছিলো। একটি দৃশ্যের জন্য ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে হত। সেই গুলি থেকেই দুর্ভাগ্যক্রমে আগুন লেগে যায়। ধোঁয়া দেখে সবাই প্রথমে ভেবেছিলো এটি বুঝি নাটকেরই অংশ! ঘটনা যখন বুঝা গেলো ততক্ষণে সবাই পড়িমরি করে ছুটছে। সৌভাগ্যক্রমে কেবল একজন দর্শক সামান্য আহত হলেন। কিন্তু কাঠের তৈরি মঞ্চ পুড়ে অঙ্গার হলো।

পরের বছর জুনেই গ্লোব আবার যাত্রা শুরু করলো । এর প্রায় ত্রিশ বছর পর, ১৬৪২ সালে গোড়া পিউরিটানরা ধর্ম আর নৈতিকতার ধোঁয়া তুলে, লন্ডনের সব নাট্যশালায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। আর সব থিয়েটারের মত গ্লোবও তখন বন্ধ হয়ে যায়।

আমরা যে গ্লোব থিয়েটারটি দেখলাম তা মূলত যাত্রা শুরু করে ১৯৯৭ সালে । নতুন আঙ্গিকে থিয়েটারটি নির্মাণ করা হলেও চেষ্টা করা হয়েছে পুরনো নকশার মত করেই বানাতে। গাইড মেয়েটি জানালো চারশো বছরের পুরনো নকশা আর নথি খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তারপরও মোটামুটি যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার আলোকেই পুরনো গ্লোবের কাছাকাছি করে বানানো হয়েছে। নতুন গ্লোব থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ নাটক ছিলো ‘হেনরি দি ফিফথ’।

গাইড মেয়েটি আমাদের মূল মঞ্চ আর দর্শকের জন্য নির্ধারিত গ্যালারি ঘুরিয়ে দেখালেন। মূল মঞ্চে ঢুকে দেখতে পেলাম নাটকের মহড়া চলছে। এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী সংলাপ আওড়ে যাচ্ছেন আর তাদেরকে পরিচালনা করছেন এক নারী নির্দেশক। মনে মনে ভাবলাম এদের মধ্য থেকেই হয়তো বেরিয়ে আসবে আগামী দিনের জাঁদরেল কোন অভিনয়শিল্পী।

গ্লোবের সঙ্গে বাংলাদেশেরও সম্পর্ক আছে। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিককে কেন্দ্র করে গ্লোব থিয়েটার ‘নাট্য অলিম্পিক’ নামে একটি নাট্যোৎসবের আয়োজন করে। শেক্সপিয়ারের ৩৭টি নাটকের ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় মঞ্চায়ন হয় লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী এই থিয়েটারে। বাংলা ভাষায় একমাত্র নাটকটি মঞ্চায়ন করে বাংলাদেশের ঢাকা থিয়েটার। রুবাইয়াৎ আহমেদের রূপান্তরে আর নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনায় শেক্সপিয়ারের দি টেমপেস্ট নাটকের মঞ্চায়ন করেন তারা । গ্লোব থিয়েটারও নাটক নিয়ে বাংলাদেশে ঘুরে গেছে।  উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ৪৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বভ্রমণের অংশ হিসেবে, ২০১৫ সালের ১৫ জুলাই  শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় তারা ‘হ্যামলেট’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন।

ইংরেজদের নাট্যচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী। লন্ডন মূলত এই নাট্যচর্চার তীর্থভূমি। রথী মহারথী ইংরেজ অভিনয়শিল্পীরা থিয়েটার থেকেই উঠে এসেছেন । চলচ্চিত্র-টেলিভিশনে কাজের পাশাপাশি তারা সমান তালে মঞ্চেও কাজ করে যান। তাই থিয়েটারের কদর এই দেশে এক চিলতেও কমেনি। আর থিয়েটারচর্চার মধ্যমণি হয়ে থাকে এই গ্লোব। সর্বাকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার নামটি যেখানে জুড়ে আছে, হৃদয়তো সেখানে কম্পিত হবেই। #

কাউসার রুশো, ভ্রমণপিয়াসী ও চলচ্চিত্রপ্রেমী