বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৯)

-বিজন সাহা

এই তো সেদিন পৃথিবীর মেহনতী মানুষ অক্টোবর বিপ্লবকে স্মরণ করল। বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক দলগুলো এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করেছে, একে অন্যেকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রগতিশীল বলে পরিচিত মানুষ স্ট্যাটাস দিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। ৭ নভেম্বর ১৯১৭ রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে  ঘটেছিল গত শতাব্দীর তো বটেই, মানব ইতিহাসের অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনে এই প্রথম সমাজের লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষ নিজের হাতে নিজের ভাগ্য তুলে নিয়েছিল। মানব সভ্যতার ইতিহাসে শুরু হয়েছিল এক নতুন অধ্যায়। প্যারি ক্যমিউন যেমন উদ্বুদ্ধ করেছিল বলশেভিকদের, ঠিক তেমনি পরবর্তী প্রায় সত্তর বছর রুশ বিপ্লব দেশে দেশে আশা জাগিয়েছে মানুষের মনে, স্বপ্ন দেখিয়েছে শেকল ছেঁড়ার, নিজের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নেবার।

১৯৮৩ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি তখন আন্দ্রোপভ ক্ষমতায়। ব্রেঝনেভের স্ট্যাগনেশনের পরে নতুন গতি পেয়েছে সমাজ। এ যেন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার মত। সবার মধ্যে এক ধরণের ভয়, বিশেষ করে যারা কাজে ফাঁকি দিয়ে দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের মধ্যে। আর এই লাইনে দাঁড়ানোর কারণ ছিল দেশে রুচিসম্মত নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রীর অভাব। যেহেতু দেশে থাকতেই বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম, আর ছোট বেলা থেকেই রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা, চেষ্টা করতাম যতটুকু সম্ভব দেশটাকে বুঝতে, দেশের মানুষকে বুঝতে। মনে পড়ে, এখানে আসার আগে যখন জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই, উনি বলেছিলেন

– ভাল মন্দ মানুষ সব জায়গায় আছে, ভালদের সাথে মেলামেশা করো, মন্দদের এড়িয়ে চলো।
– “ও দেশে মন্দ মানুষ নেই” – এটা ছিল আমার জবাব।

জ্যাঠামশাই এর উত্তরে কিছুই বলেন নি, তবে মনে মনে হয়তো হেসেছিলেন। বিদেশে না গেলেও বয়সের সাথে সাথে মানুষ অনেক অভিজ্ঞতাই অর্জন করে যেটা বই পড়ে হয় না। জীবনের অভিজ্ঞতা নির্মম কিন্তু সত্য। আর সেটা বুঝতে খুব বেশী সময় লাগেনি আমার। দেখেছি দেশের মতই রুশ দেশও ভাল মন্দ সব ধরণের মানুষে ভরা। বিপ্লব করে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলানো যায়, সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করে মানুষকে ডিগ্রীধারী করা যায়, কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা তার অভ্যেস বদলানো যায় না। মানব সভ্যতার ইতিহাস তো তার ভাল থাকতে, ভাল খেতে, ভাল পরতে চাওয়ার ইতিহাস। আর এই চাহিদা, এই লোভই তাকে যুগের পর যুগ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে নতুন কিছু করার। এমনকি আজও উন্নত দেশগুলোতে, যেখানে মানুষের নুন্যতম চাহিদাগুলো একপ্রকার মিটে গেছে, সেখানেও মানুষ একটা নতুন আই-ফোনের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করে, একটা নতুন মডেলের গাড়ির জন্য রাতের ঘুম হারাম করে। এটা অভাব নয়, এটা স্বভাব। যুগ যুগ ধরে অর্জিত স্বভাব। এটা কি বিপ্লব করে বদলানো যায়?

সোভিয়েত আমলে ৭ই নভেম্বর ছিল দেশের প্রধান উৎসব। ছুটির দিন। কলকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গা থেকে দলে দলে মানুষকে নিয়ে যাওয়া হতো ডেমনস্ট্রেশনে। আমিও যেতাম রেডস্কয়ারে। তবে আমাদের বিদেশীদের যতটা আগ্রহ ছিল, সোভিয়েত বন্ধুদের মধ্যে তেমনটা দেখতাম না। কমসোমল থেকে পাঠানো হত, যেতো – অনেকটা অনিচ্ছা নিয়েই। সবাই যে তেমন তা নয়, তবে অনেকেই। তখন নভেম্বরে বরফ পড়ত। শীতকে উপেক্ষা করে যেতাম সেই ডেমনস্ট্রেশনে। মনে হত আমরাও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। বাসে করে নিয়ে যাওয়া হত জুবভস্কী বুলভারে, ঠিক প্রগতি প্রকাশনের সামনে। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে এঙ্গেলসের স্ট্যাচুর সামনে দিয়ে লেনিন লাইব্রেরী হাতের ডান দিকে রেখে ঢুকতাম রেড স্কয়ারে। হাতে থাকত রঙ বেরঙের বেলুন, কখনও “মহান অক্টোবর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” শ্লোগান লেখা ব্যানার। লেনিনের সমাধির উপর দাঁড়িয়ে থাকা সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের প্রতি হাত নাড়াতে নাড়াতে বাজিলিক চার্চের পাশ দিয়ে নেমে যেতাম মস্কো নদীর ধারে। ঐ সময় প্রায় একই রকম আড়ম্বরের সাথে পালিত হত মে ডে। বসন্তের উষ্ণ আবহাওয়ায় এই ডেমনস্ট্রেশনে লোক হত আরও বেশী। আর ৯ ই মে বিজয় দিবসের মুল অনুষ্ঠান ছিল বিভিন্ন পার্কে, যেখানে আমরা দল বেঁধে যেতাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের অভিনন্দন জানাতে আর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে। এখন, নতুন রাশিয়ায় বিজয় দিবস পালন করা হয় অনেক বড় করে – এটা আজ সত্যিকারের মানুষের উৎসব, জাতীয় উৎসব – যেখানে ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় আসে যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলো স্মরণ করতে, যারা রক্ত দিয়ে পৃথিবীকে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে রক্ষা করেছে – তাদের প্রতি সম্মান জানাতে।

আজ খুব মনে পড়ছে সেই ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বরের কথা। মাত্র দু মাস আগে এসেছি এ দেশে। যদিও এর মধ্যেই অনেক কিছু দেখেছি, অক্টোবর বিপ্লব দিবস ছিল আমাদের জন্য নতুন। সারা শহরের রাস্তাঘাট লাল পতাকায় সাজানো। কোথাও কোথাও আলোও জ্বালানো হয়েছে। বড় ভাইয়েরা আগেই বলেছিলেন সাল্যুতের বা ফায়ার ওয়ার্কের কথা। সবাই অপেক্ষা করছি রাত দশটা কখন বাজবে। তার আগে থেকেই সবাই জড়ো হয়েছি ক্রেস্তের ওখানটায়, দুই আর তিন নম্বর ব্লকের মাঝামাঝি। ঠিক দশটায় শুরু হোল সাল্যুত বা আতশবাজী। কামানের গোলার মত আলোর পিণ্ড উঠে গেল উপরে, আর তারপর চারিদিক উদ্ভাসিত করে রঙ্গিন বৃষ্টি হয়ে নেমে এল পৃথিবীর বুকে। আমরা সবাই আনন্দে “হুররে হুররে” বলে চিৎকার করতে লাগলাম। মনে আছে সেই দিন হামিদ ভাই বলেছিলেন, “অক্টোবর বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে কত যে বাজী পুড়বে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারব না।“ ২০১৭ সালে বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাজী পোড়েনি। সেটা কী তখন কল্পনা করতে পেরেছিলাম। আরও মনে পড়ছে আমাদের ইয়ারমেট জয়নালের কথা। হোস্টেলে ফিরে দেখি ও বেডের নীচে শুয়ে আছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় বলল, গোলার শব্দে ও ভেবেছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঘটনাটা হাস্যকর মনে হলেও সে সময়ে সোভিয়েত – অ্যামেরিকান সম্পর্কের উত্তাপ ভালো করেই মনে করিয়ে দেয়।

অনেক দিন থেকেই ৭ই নভেম্বর এ দেশে কাজের দিন। তবে নভেম্বরকে স্মরণ করতেই হোক আর যে কারণেই হোক, এখন এখানে পালন করা হয় ৪ নভেম্বর – জাতীয় ঐক্য ও সংহতি দিবস নামে, মিনিন আর পঝারস্কীর ১৬১২ সালে পোলিশদের বিরুদ্ধে অভ্যুথানের স্মৃতি স্মরণ করে। তবে ২০১৭ সালের কথা অন্য। শত হলেও শত বর্ষ। প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিপ্লবের উপর হয়েছে টক শো, বিভিন্ন বিশ্লেষণমূলক অনুষ্ঠান। কেউ হয়েছে বিপ্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখী, কেউবা পৃথিবীর বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য অক্টোবর বিপ্লবকে করেছে দায়ী। কেউবা লেনিনকে দেখছে জিনিয়াস স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে, কেউবা জার্মান চর রূপে। কারো কাছে স্তালিন মহানায়ক, কারো কাছে হিটলারের মতই খল। তবে আমার মনে হয় এর পেছনে কাজ করছে পশ্চিমা দুনিয়া আর তাদের অনুসারীদের হীনমণ্যতা। কারণ গত শতকের প্রায় প্রতিটি যুগান্তকারী ঘটনাই ঘটেছে লেনিন, স্তালিন আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে। একদিকে যেমন লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বের বুকে এক নতুন ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, যা কিনা সমগ্র মানব জাতিকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, অন্য দিকে স্তালিনের নেতৃত্বেই বিশ্ব ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। শুধু ইউরোপ কেন সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ পেয়েছে তাদের চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নই পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে প্রথমে কৃত্রিম উপগ্রহ আর এর পরে মানুষ পাঠিয়েছে মহাকাশে। এ সবই ছিল পশ্চিমা বিশ্বের গালে বড় রকমের চপেটাঘাত। আর তাই এত দিন পরেও তারা ইতিহাস নতুন করে লিখতে উঠেপড়ে লেগেছে।

আজ শুধু বামেরা কেন, অনেক দক্ষিনপন্থী অর্থনীতিবিদরাও স্বীকার করে মার্ক্সের অবদানের কথা। মার্ক্সবাদ এখনও পুঁজিবাদী অর্থনীতির সেরা বিশ্লেষণগুলোর একটা। এর অ্যাকাডেমিক মুল্য অপরিসীম। তবে এটাকে বাস্তবায়নের জন্যে লেনিন যে পথে চলেছেন সেটাই জন্ম দিয়েছে স্তালিনের। ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে বা সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পায়নে অপিরিসীম ভুমিকা থাকা সত্বেও মিলিয়ন মিলিয়ন নির্দোষ প্রানের দায় কি স্তালিন এড়াতে পারবে? তবে এর জন্য যতটা না সমাজতন্ত্র দায়ী তার চেয়ে বেশী দায়ী মানুষের ক্ষমতার প্রতি চিরায়ত লোভ। সমাজতন্ত্রের আগেও এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বাইরেও প্রচুর একনায়ক ছিল যাদের হাতে লেগে আছে কোটি মানুষের রক্ত। আইনস্টাইনের সূত্র ধরে যেমন অ্যাটম বোমা তৈরি করা যায়, তেমনি আনবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও গড়ে তোলা যায়। আর এটা নির্ভর করে লক্ষ্যের উপর অথবা সুত্রকে বাস্তবে রূপ দেয়ার নীতিমালার উপর। এ জন্যে তো আর সুত্রকে দোষ দেয়া যায় না। তবে এটা বলা যায় সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী লেনিন, কী স্তালিন, কী মাও সবাই কমবেশি ভুল করেছেন আর সে জন্যেই বিপ্লবের মাত্র শতবর্ষ পরে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে অতীত কালে কথা বলছি। লেনিন যেমন তার ভাই আলেকজান্ডারের সন্ত্রাসবাদী পথকে ভুল বলে বলেছিলেন “আমরা অন্য পথে যাবো”, মনে হয় বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরও লেনিনের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হবে “আমরাও অন্য পথে যাবো।”

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো