চলমান সংবাদ

মোঃ ফরহাদ কিভাবে ‘মোঃ ফরহাদ’ হলেন? ২য় পর্ব

– এম. এম. আকাশ

কম্রেড মোঃ ফরহাদ (ফাইল ছবি)

ষাট দশকের ঝঞ্ছামুখর সময়ের নক্ষত্র মোঃ ফরহাদ

১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর ছাত্র রাজনীতি প্রথমে কিছুদিন স্তিমিত অবস্থায় থেকে আবার ধীরে ধীরে নানারকম ছদ্মনামের আড়ালে কর্মতৎপরতা শুরু করে। সে সময় ‘অগ্রগামী’, ‘যাত্রিক’, ‘অগ্রদূত’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি নামের আড়ালে ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগ প্রভৃতি সংগঠনের কর্মীরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে কাজ শুরু করেন।
সে সময় ছাত্রদের মধ্যে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যা ছিল খুবই কম। মোহাম্মদ ফরহাদ মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালেই পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। ১৯৫৯ সালের শেষদিকে ঢাকায় গঠিত হয় মাত্র তিনজন ছাত্র সদস্যকে নিয়ে পার্টির ছাত্র শাখা। এই তিনজন সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ, আব্দুল হালিম এবং আহমেদ জামান। ছাত্রজীবন শেষে আব্দুল হালিম শিক্ষকতায় এবং আহমেদ জামান ডাক্তারী শিক্ষায় নিয়োজিত হন। মোঃ ফরহাদ ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত থেকে যান পার্টি ও ছাত্র আন্দোলনের গোপন যোগসূত্র হিসাবে। এই সমগ্র সময়টাই তাকে আত্মগোপনে থেকে পার্টির পক্ষ থেকে ছাত্র আন্দোলনকে দিক নির্দেশনা দিতে হয়েছিল। সে সময়কার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত সাংবাদিক বজলুর রহমান লিখেছেন,
“ ‘যে পারে সে এমনি পারে, পারে সে ফুল ফুটাতে।’ মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন অনেকটা তেমনি। হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের মানুষটি। বন্ধুরা ‘টেক’ নাম দিয়েছিল ‘ছোটলোক’ বা ‘লিটলম্যান’। অনলবর্ষী বক্তাও ছিলেন না তিনি, ছাত্র রাজনীতিতে জনপ্রিয়তার যা একটা বড় উপাদান। তবু তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। সবার নেতা। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি এড়িয়ে চলতে চাইতেন বোধ করি পার্টির গোপন কাজের স্বার্থে, কিন্তু কর্মীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই নেপথ্য নায়ক। ছাত্র সংগঠনে বড় পদ তিনি কখনো অধিকার করেন নি। ৬২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন পুনর্গঠিত হলে তিনি সবার পীড়াপীড়িতে সভাপতি হতে রাজী হননি পার্টির নির্দেশে, তবে তেমন চোখে পড়ার মতো নয় বলেই হয়তো কোষাধ্যক্ষের পদটি গ্রহণ করেছিলেন। তবু সবাই জানতো ছাত্র ইউনিয়নের মূল নেতা তিনিই, তাঁর কথাই শেষ কথা।” [বজলুর রহমান, “প্রথম দেখা শেষ দেখা”, মোহাম্মদ ফরহাদ নিবেদিত রচনাগুচ্ছ, জ্ঞান প্রকাশনী, মে, ১৯৮৮, পৃ: ৩০]।
এই “তাঁর কথাই শেষ কথা” কথাটি আমাদের মনে খটকা জাগাতে পারে। তাহলে কি ছাত্র গণসংগঠন ছিল পার্টির ক্রীড়নক মাত্র। আমাদের মনে হতে পারে যে মোঃ ফরহাদ পার্টির “ঈযড়ংবহ ষবধফবৎ” ছিলেন বলেই ছাত্র ইউনিয়নে তার অপরিসীম প্রভাব ও কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি মোটেও সেরকম ছিল না। তিনি এমন কতকগুলি বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন যে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন শুধু নয়, ছাত্র লীগ সহ অন্যান্য সহযোগী ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছেও তার একটি স্থায়ী সম্মান ও শ্রদ্ধার আসন গড়ে উঠেছিল। তাই তার নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্ব ছিল না। ছিল অর্জিত নেতৃত্ব। বিভিন্ন সময়ে তরুণ ফরহাদের যেসব গুণের কথা তার তদানীন্তন কমরেডরা বর্ণনা করে গেছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নীচে তুলে ধরছি-:
১। অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা।
২। চমৎকার বিশ্লেষণী শক্তি।
৩। অপরিসীম ধৈর্য ও অধ্যবসায়।
৪। কোন কিছুর পেছনে লেগে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা।
৫। যে কোন কাজের নিখুঁত পরিকল্পনা প্রণয়ন।
৬। খুঁটি-নাটি বাদ না দেওয়া।
৭। কর্মীদের প্রতি অপরিসীম দরদ ও ভালবাসা।
৮। গান-গল্প ও কবিতার প্রতি ভালবাসা।
এবং
৯। অসম্ভব পরিশ্রমের ক্ষমতা।
উপরোক্ত গুনাবলীর তালিকার দিকে যখন আমরা তাকাই তখন মাত্র ৪৯ বছরের ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরে মোহাম্মদ ফরহাদের অর্জিত সাফল্যের মাত্রা নিয়ে আমাদের মনে আর কোন প্রশ্নের অবকাশ থাকে না। হয়তো আরেকটু কম কাজ করলে, আরেকটু বেশি বিশ্রাম নিলে তিনি আরেকটু বেশী দীর্ঘসময় বেঁচে থাকতেন। তাঁর অন্যতম সহযাত্রী কমরেড মতিউর রহমান তাই দুঃখ করে লিখেছেন,
“ষাটের দশকের ছাত্র-গণআন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনায় সরাসরি তদারকি করা, দিনরাত নিয়মিত খোঁজখবর রাখার জন্য কমরেড ফরহাদ বহু সময়েই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সি-ফাইড, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হলের ৩২১ ও নজরুল ইসলাম হলের ৪১নম্বর রুম এবং ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে মহসিন হলের একটি কক্ষে থেকেছেন। সাহসের সাথে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে কাজ করার ফলেই সে সময়গুলিতে আন্দোলনের উপর পার্টি প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।—এভাবেই দশকের পর দশক ধরে তিনি অব্যাহতভাবে গড়ে তুলেছিলেন পার্টিকে একটু একটু করে। এসব কিছুর সাথে সাথে অস্বাভাবিক রকমের শক্ত ধাতের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়কালে অস্বস্তি ও অসুস্থাতায় ভুগতে শুরু করলেন। আর তাই, ‘বিপ্লবের জন্য আরো পাঁচটি বছর কাজ করে যাবার’ অদম্য ইচ্ছেও তাঁর পূরণ হলো না। এ দুঃখ আমরা রাখবো কোথায়?” [মতিউর রহমান, “তাঁর আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা”, প্রাগুক্ত, মে ১৯৮৮, পৃ: ১৮]

অকাল প্রয়াত কিন্তু “আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা”- এ থেকেই ব্যক্তিটির চরিত্র আমরা অনেকখানি বুঝে নিতে পারি। কিন্তু প্রায়ই আমাদের একটি ধারণা হয় যে বিপ্লবীরা বোধহয় নিষ্ঠুর, কর্কশ, মায়া-মমতাহীন মানুষ। পাথর দাবীর সব্যসাচীর মত ভ্রুক্ষেপহীন আদর্শবাদী। এ ধরণের কিছুটা কঠোরতা মোহাম্মদ ফরহাদের চরিত্রের মধ্যে নিশ্চয়ই হয়তো ছিল কিন্তু তার দরদী মানবিকতার বিষয়েও আমরা অনেকের কাছে অনেক কিছু শুনেছি। বিশেষ করে বহু সার্বক্ষনিক কর্মীর নাড়ির খবর তিনি রাখতেন এবং তাদের প্রয়োজনীয় দুঃখ লাঘব এবং সুখ বৃদ্ধির প্রতি নিয়ত খেয়াল রাখতেন। এরকম মানবিকতার খুঁটি নাটি বহু গল্প মোহাম্মদ ফরহাদকে ঘিড়ে আমাদের পার্টির মধ্যে আছে এবং আজো তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরিত হয়। আমি আমাদের পুরানো প্রজন্মের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব রণেশ দাশগুপ্তের লেখা থেকে একটি ছোট্ট উধৃতি নীচে তুলে ধরছি-:
“এই সঙ্গেই আমরা মনে রাখবো, ফরহাদ তেভাগা আন্দোলনের জন্য খ্যাত দিনাজপুরে জন্মেছেন ও বড় হয়েছেন। তারপর ’৬০-এর দশকে গণঅভ্যুত্থানের সময় শ্রমিকশ্রেণীর সংস্পর্শে এসেছেন অন্তরঙ্গ হিসেবে। পার্টির এবং জাতীয় নেতারূপে তাঁর চোখ খোলা ছিল সমস্ত সংগ্রামী নারী ও পুরুষের পরিবারবর্গের ও সমস্যার প্রতি। সম্প্রতি রংপুরের প্রবীণ কৃষক কর্মী কমরেড জিতেন দত্ত ৭৮ বছর বয়সে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি হলে ফরহাদ তাঁর বাসা থেকে ভাত-ডাল রান্না করে পাঠিয়েছেন জিতেনদার জন্য”। [রণেশ দাশগুপ্ত, “বাংলাদেশের কমিউনিস্ট ও জাতীয় নেতা ফরহাদ: শ্রদ্ধার্ঘ”, প্রাগুক্ত, মে, ১৯৮৮ পৃ: ২৫]
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় কমরেড রমেন মিত্রের (বিপ্লবী ইলা মিত্রের জীবনসঙ্গী) বাসায় মোহাম্মদ ফরহাদকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কমরেড মণি সিংহ। মণি সিংহ সেই সময় যে ভাষায় কমরেড ফরহাদকে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তার একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু উজ্জ্বল বর্ণনা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী। দিলীপ চক্রবর্তী লিখেছেন,
“মণি সিংহ বললেন, এস তোমাকে তোমার এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। এর নাম কবির আহমেদ।
ছোটখাট চেহারার এক যুবক শুকনো চেহারা অথচ চোখগুলি অসম্ভব তাজা, মুখে মিষ্টি হাসি। এক লাফে উঠে এসে হাতে হাত লাগিয়ে এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিলেন। যেন আমাদের মধ্যে কতদিনের পরিচয়।
মণি সিংহ বললেন, কবির আহমেদ আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। ষাটের দশকের বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের বীজ এবং ফসল।
—-মণি সিংহের কথায় ফরহাদ যেন একটু লজ্জা পেলেন, হাতে হাতে রেখেই বললেন, বড় ভাই আমার একটু বেশি প্রশংসা করেছেন।”
(দিলীপ চক্রবর্তী, “কবির আহমেদ ও কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ”, প্রাগুক্ত, মে ১৯৮৮, পৃ: ৭০)
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, মোঃ ফরহাদের গোপন টেক্ নাম ছিল কবীর আহমেদ।

চলবে . . .

লেখকঃ রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পড়ুনঃ মোঃ ফরহাদ কিভাবে ‘মোঃ ফরহাদ’ হলেন? ১ম পর্ব