বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের টহল
বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের টহল

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শুক্রবার ভোররাতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে অন্তত দু’জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। স্থানীয় সূত্রগুলো অবশ্য বিবিসি বাংলার কলকাতা সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালীকে জানিয়েছে যে ওই ঘটনায় একজন ভারতীয় নাগরিকও মারা গেছেন। বিএসএফ-এর সূত্রগুলো বলছে, পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার সিতাইতে শুক্রবার ভোর তিনটে নাগাদ এই ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার দিক থেকে ভারতের সিতাইয়ের সাতভান্দারির গুঞ্জরীছড়া গ্রামে গরু পাচারের উদ্দেশ্যে প্রায় ৫০ জনের একটি দল প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল বলে বিএসএফ-এর কর্মকর্তারা জানান।

ঘটনাস্থলটি বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ থানা এলাকার বিপরীতে। “পাচারকারীদের মধ্যে একদল গরু পাচারের জন্য তারকাটা বেড়ার ওপর দিয়ে কপিকল লাগানোর কাজ করছিল, আর অন্য দল তাদের পাহারা দিচ্ছিল,” বিবিসি বাংলাকে বলেন বিএসএফের এক কর্মকর্তা। “আমাদের প্রহরীরা দেখতে পেয়ে সাবধান করে এবং প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্রও ব্যবহার করে। কিন্তু পাচারকারীরা পাথর ছুঁড়তে শুরু করে, দা, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে প্রহরীদের আক্রমণ করে,” বলেন ওই কর্মকর্তা। সেই সময়ে জওয়ানরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায় বলে বিএসএফ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়। তবে ওই এলাকায় যে এ ধরণের ঘটনা হতে পারে, সেই তথ্য একদিন আগেই বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডসকে জানানো হয়েছিল বলেও দাবী করছে বিএসএফ। লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, তারা স্থানীয়ভাবে গোলাগুলি ও মানুষের হতাহতের খবর জানতে পেরেছেন। তবে ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের ভূ-খণ্ডে বাংলাদেশের গোড়ল ইউনিয়নের কাছে। তাই বিজিবির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে না জানানো পর্যন্ত তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।

সীমান্তের দুই পারের বিরোধের মূল কেন্দ্রে রয়েছে গরু পারাপার।
সীমান্তের দুই পারের বিরোধের মূল কেন্দ্রে রয়েছে গরু পারাপার

এদিকে, এ ঘটনায় যে ভারতীয় নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে তার বাড়ি কোচবিহারের পূর্ব চামটায় বলে জানা গেছে।

যা জানা যাচ্ছে

নিহত বাংলাদেশি দু’জনের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার মালগাড়া গ্রামে। দু’জনের বয়স ৪০-৪৫ বছরের মধ্যে বলে জানা গেছে। উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মাহমুদুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, “শুক্রবার ভোরে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মালগাড়া সীমান্তের ৯১৭ মেইন পিলারের ৫ নাম্বার সাব পিলারের নিকট এ ঘটনা ঘটে। নিহতদের বাড়ি পাশাপাশি, তাদের আত্মীয়দের সাথে আমার কথা হয়েছে। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে এখনও কিছু জানায়নি।” ওই গ্রামে গিয়ে এক মানবাধিকারকর্মী রেজাউল করিম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে তিনি নিহত ভারতীয় ব্যক্তির দেহ তারকাঁটার বেড়া থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে পড়ে থাকতে দেখেছেন। ওই ব্যক্তির কপালের ঠিক মাঝামাঝি গুলির চিহ্ন দেখেছেন তিনি। সেই ভিডিও বিবিসিকে দিয়েছেন মি. করিম। দুই বাংলাদেশি ব্যক্তির দেহ বেড়া থেকে প্রায় ৪০ মিটার ভেতরে পড়ে ছিল, এটাও দেখেছেন রেজাউল করিম। সীমান্তে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন, মাসুমের প্রধান কিরীটি রায় বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই গুলিচালনা এমন একদিনে হল যেদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব অজয় ভাল্লা কলকাতায় আসছেন বিএসএফ এবং সীমান্ত পরিকাঠামো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বৈঠক করতে।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সাম্প্রতিক নির্দেশ জারি করে সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিএসএফের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। এর আগে সীমান্ত থেকে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বিএসএফ নজরদারি এবং তল্লাশি অভিযান চালাতে পারত। বিএসএফের এলাকা বৃদ্ধি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আর পাঞ্জাব আপত্তি তুলেছে। এই বিষয় নিয়েও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বৈঠকে কথা হবে।

বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত

সীমান্তে চোরাচালান

বিবিসি বাংলার কলকাতা সংবাদদাতা অমিতাভ ভট্টশালী জানান, ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো সিবিআই গত বছর থেকেই দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলে গরু পাচার চক্রের সঙ্গে বিএসএফ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে তদন্ত করছে। বিএসএফের কর্তব্যরত ও প্রাক্তন কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়াও রাজনৈতিক নেতা, কাস্টমস ও পুলিশের একাংশের জড়িত থাকার কথা সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালে কেরালায় বিএসএফের একজন কমান্ডান্ট নগদ প্রায় ৪৭ লক্ষ টাকাসহ ধরা পড়ার পরেই ওই চক্রটির কথা সামনে আসে। তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদস্থ কর্মকর্তারা দাবি করেন যে এরা চুনোপুঁটি, বরং গরু পাচার চক্রের পিছনে বিএসএসফ-এর আরও কয়েকজন সিনিয়র অফিসার জড়িত ছিলেন। এদের কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন, কেউ অন্য নিরাপত্তা বাহিনীতে আছেন।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী।
ভারতীয় একজন সীমান্তরক্ষী

কিন্তু বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে ২০১৬ সালেই বাহিনীর এক অফিসার বিএসএফের মহাপরিচালককে চিঠি লিখে এই পাচার চক্র সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা যে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, সেটাও জানিয়েছিলেন তিনি। “গরু পাচার নিশ্চয়ই অপরাধ। কিন্তু বিএসএফ যখন বাংলাদেশী নাগরিকদের বা ভারতীয় নাগরিকদের গুলি করে মারছে গুরু পাচারের অপরাধে, তাদের নিজেদের বাহিনীর মধ্যে যে সব অফিসারেরা পাচারচক্রের সঙ্গে যুক্ত, তাদের কজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?” প্রশ্ন কিরীটি রায়ের।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা