বিজ্ঞান প্রযুক্তি

জগদীশচন্দ্র বসু – প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী

– প্রদীপ দেব

জগদীশচন্দ্র বসু (ফাইল ছবি)

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ইওরোপ আমেরিকার উন্নত গবেষণাগারে যখন ব্যাপক গবেষণা-যজ্ঞ চলছিল,  সেই সময় ভারতের বিজ্ঞান-মরুতে গবেষণার ফল ফলানোর জন্য একাই লড়ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। আমরা আজ যে বিজ্ঞান-গবেষণার পথে খুব আস্তে আস্তে হলেও হাঁটতে শুরু করেছি, সেই পথ অর্ধ-শত বছরের কঠিন পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। ১৯০৯ সালের শেষের দিকে ইতালির গুগ্লিয়েল্‌মো মার্কনি আর জার্মানির কার্ল ফার্ডিন্যান্ড ব্রোনকে যখন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো – সারাবিশ্ব জানলো যে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ বাঙালী বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বেতার তরঙ্গ নিয়ে মৌলিক গবেষণা শুরু করেন মার্কনিরও অনেক আগে এবং ১৮৯৫ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম কৃত্রিম মাইক্রোওয়েভ উৎপাদনে সাফল্য লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের পাশাপাশি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত করেন জগদীশচন্দ্র। উদ্ভিদও যে উদ্দীপনায় সাড়া দেয় – এ তথ্য জগদীশচন্দ্র বসুর আগে কেউ উপলব্ধি করেননি, প্রমাণ করতে পারেননি। বহুমুখী বিজ্ঞানের সাধক জগদীশচন্দ্র বিশ্ববিজ্ঞানীর আসরে যথোপযুক্ত আসন অর্জন করেছিলেন অনেক সাধনা, সংগ্রাম ও পরিশ্রমের বিনিময়ে। ১৯২৭ সালে লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস জগদীশচন্দ্রকে গ্যালিলিও  এবং নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী হিসেবে উল্লেখ করেছে। আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে “জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য প্রদান করেছেন, তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।”

জগদীশচন্দ্র বসুর পৈত্রিক বাড়ি ছিল পুরাতন ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরে। তাঁর বাবা ভগবানচন্দ্র ছিলেন বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামের সম্ভ্রান্ত বসু পরিবারের সন্তান। তিনটি কন্যার পর ভগবানচন্দ্র ও বামাসুন্দরী দেবীর চতুর্থ সন্তান জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর, ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ শহরে ইংরেজ সরকার তখন প্রথম ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেছে। ভগবানচন্দ্র ছিলেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। জগদীশচন্দ্রের জন্মের কয়েক বছর পর ডেপুটি মেজিস্ট্রেট হয়ে ফরিদপুরে চলে আসেন ভগবানচন্দ্র। ফরিদপুরেই কাটে জগদীশচন্দ্রের শৈশব এবং কিছুটা কৈশোর।

পাঁচ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের। ফরিদপুরে তখন দুটো স্কুল – একটি ইংরেজি মাধ্যম এবং অন্যটি বাংলা মাধ্যম। জগদীশচন্দ্রকে ভর্তি করানো হলো  বাংলা স্কুলে। ১৮৬৯ সালে ভগবানচন্দ্র সহকারী কমিশনার হয়ে বর্ধমানে বদলী হয়ে যান। এদিকে জগদীশচন্দ্রের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি করানো হলো জগদীশচন্দ্রকে। কিন্তু প্রথম দিনই স্কুলে সহপাঠীরা তাকে ‘গাঁইয়া’বলে ক্ষেপাতে লাগলো। সহপাঠীদের সাথে মারপিট করতে হলো তাকে। তিন মাসের মাথায় হেয়ার স্কুল ছেড়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হতে হলো জগদীশচন্দ্রকে। ১৮৭৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু হলো জগদীশ বসুর। ১৮৭৭ সালে জগদীশচন্দ্র এফ-এ পাশ করেন দ্বিতীয় বিভাগে। এরপর ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে সাধারণ মানের বি-এ। ইতোমধ্যে তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। বাবাকে ঋণমুক্ত করার উপায় খুঁজতে শুরু করলেন জগদীশচন্দ্র। ঠিক করলেন ইংল্যান্ডে গিয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবেন। চাকরি পেলে আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর বাবা চান না যে তাঁর ছেলে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি করুক। আই-সি-এস অফিসার হবার চেয়ে অনেক ভাল ডাক্তারি পড়া। বাবা ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চাইলেও বাধ সাধলেন মা। ‘কালাপানি’পার হয়ে ছেলে বিলেত যাবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বামাসুন্দরী দেবী। কিন্তু জগদীশচন্দ্র যাবেনই। বাবার আর্থিক অবস্থা ফেরানোর জন্য, ঋণ শোধ করার জন্য তাঁকে বিলেতে যেতেই হবে। মা-কে বোঝালেন। শেষপর্যন্ত বামাসুন্দরী দেবী শুধু যে রাজী হলেন তা নয়, নিজের গয়না বিক্রি করে ছেলের বিদেশ যাবার টাকা জোগাড় করার ব্যবস্থা করলেন।

১৮৮০ সালে জগদীশচন্দ্র ডাক্তারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অন্তর্ভুক্ত একটা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু একদিন অ্যানাটমির ক্লাসে মাথাঘুরে পড়ে গেলেন। শব ব্যবচ্ছেদের পরিবেশ সহ্যই হলো না তাঁর। শরীরও খারাপ। এ অবস্থায় শারীরবিদ্যার অধ্যাপক তাঁকে পরামর্শ দিলেন – চিকিৎসাবিজ্ঞান বাদ দিয়ে অন্য কোন বিষয়ে পড়াশোনা করার। একটা বছর নষ্ট হলো জগদীশচন্দ্রের। পরের বছর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। কেমব্রিজে তিন বছর পড়াশোনার পর ১৮৮৪ সালে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও বোটানির সমন্বয়ে ন্যাচারাল সায়েন্সে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন জগদীশচন্দ্র। কেমব্রিজের রেজাল্টের ভিত্তিতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি ডিগ্রি লাভ করলেন জগদীশচন্দ্র। সেই সময় এরকম ব্যবস্থা ছিল। লেখাপড়া সম্পন্ন করার উপযুক্ত প্রমাণপত্র দাখিল করলে তা ডিগ্রির জন্য গৃহীত হতো।

লন্ডনে থাকার সময় পোস্টমাস্টার জেনারেল ফসেটের সাথে সৌহার্দ্য হয় জগদীশচন্দ্রের। ফসেট তখনকার ভাইসরয় লর্ড রিপনের কাছে একটা চিঠি লিখে জগদীশচন্দ্রের হাতে দিলেন। দেশে ফিরে এসে লর্ড রিপনের সাথে দেখা করলেন জগদীশচন্দ্র। ফসেট চিঠিতে লর্ড রিপনকে অনুরোধ করেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের জন্য একটা অধ্যাপনার চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। লর্ড রিপন জগদীশচন্দ্রকে প্রেসিডেন্সি কলেজে চাকরি দিতে সম্মত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে পাঠালেন শিক্ষাবিভাগের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফ্‌টের কাছে। এতে বিরক্ত হলেন স্যার ক্রফ্‌ট। ভারতীয়দের প্রতি তাঁর মনোভাব খুব একটা সম্মানজনক ছিল না। কিন্তু লর্ড রিপনের সুপারিশ তাঁর কাছে আদেশের সমতুল্য। স্যার ক্রফ্‌ট জগদীশচন্দ্রকে বললেন – “ইম্পেরিয়াল এডুকেশান সার্ভিসে কোন চাকরি খালি নেই, ইচ্ছে করলে প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে পারেন।” প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসের বেতন ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের বেতনের দুই-তৃতীয়াংশ। জগদীশচন্দ্র জানতেন যে ইম্পেরিয়াল সার্ভিসে কোন ভারতীয়কে নিয়োগ দেয়া হয় না। ভারতীয়দের জন্য শুধুমাত্র প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসই বরাদ্ধ। স্যার ক্রফ্‌ট যে ইচ্ছে করেই তাঁকে অপমান করছেন তা বুঝতে পেরে জগদীশচন্দ্র প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে এলেন। কিছুদিন পরে লর্ড রিপন গেজেটে জগদীশচন্দ্রের নাম দেখতে না পেয়ে খবর নিয়ে সব জানলেন। তখন স্যার ক্রফ্‌ট বাধ্য হয়ে ১৮৮৫ সালে ইম্পিরিয়াল সার্ভিসের অধীনে প্রেসিডেন্সি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে জগদীশচন্দ্র বসুকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেন। কিন্তু প্রথম মাসের বেতন নিতে গিয়ে দেখলেন অস্থায়ী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবার কারণে তিনি বেতন পাচ্ছেন সমমানের পদের জন্য ব্রিটিশরা যত পাচ্ছেন তার এক তৃতীয়াংশ। এই বৈষম্য মেনে নেয়া সম্ভব হলো না জগদীশচন্দ্রের পক্ষে। তিনি বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। পর পর তিন বছর তিনি বিনা বেতনে কাজ করে গেলেন। সংসারে ঋণের বোঝা ক্রমশ ভারী হচ্ছিলো। কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপোষ করার কথা তিনি ভাবতেও পারেননি। ১৮৮৮ সালে তাঁকে স্থায়ী পদে নিয়োগ দেয়া হয় এবং আগের তিন বছরের পুরো বেতন এক সাথে দেয়া হয়। পরিবারের আর্থিক সমস্যা মিটে গেলো।

১৮৯৪ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর ছত্রিশতম জন্মদিনে বিজ্ঞানের সেবায় আত্মনিবেদন করার ঘোষণা দিলেন জগদীশচন্দ্র। এর আগপর্যন্ত তাঁর গবেষণা ছিল কিছুটা বিক্ষিপ্ত, কোন গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়নি। ১৮৯৫ সাল থেকে শুরু হলো জগদীশচন্দ্রের নিরলস গবেষণা।

জগদীশ বসুর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। বিদ্যুৎচৌম্বক তরঙ্গ সম্পর্কিত পদার্থবিদ্যা, জড় ও জীবের সাড়ার ঐক্য, এবং উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কিত গবেষণায় পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ। ১৮৯৫ সালে উইলহেল্‌ম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কারের পর পদার্থবিজ্ঞানে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পথ খুলে যায়। পরমাণু-বিজ্ঞান, বেতারে বার্তা পরিবহন, তেজষ্ক্রিয়তা, অ্যাটমিক নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত যুগান্তকারী আবিষ্কার এসময় বৈজ্ঞানিক মহলে বিরাট প্রভাব ফেলে। এসময় জগদীশ বসু অদৃশ্য বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মাধ্যমে সংকেত বার্তা প্রেরণের গবেষণায় বেশ সাফল্য লাভ করেন। হেন্‌রিখ হার্ট্‌জ, ও গুগ্লিয়েল্‌মো মার্কনির সমসাময়িক জগদীশ বসুই হলেন বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি ১৮৯৫ সালে সর্বপ্রথম সাফল্যের সাথে মাইক্রোওয়েভ উৎপাদন করেন এবং তার ধর্মাবলীও নির্ধারণ করেন। রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের রিমোট সেন্সিং সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেন জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে। এর ক’দিন পরে জগদীশ বসু কলকাতার টাউন হলে ৭৫ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তুপে আগুন জ্বালাতে সমর্থ হন নিজের উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশানের সাহায্যে।

১৮৯৫ সালে জগদীশচন্দ্রের চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল এর জার্নাল, রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস, এবং  ইংল্যান্ডের ‘The Electrician’ জার্নালে। ১৮৯৬ সালে জগদীশচন্দ্র তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক সফরে যান ইউরোপে। সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ তরঙ্গ পরিমাপক যন্ত্রটি। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতায় দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্যার জে জে থমসন, অলিভার লজ, লর্ড কেলভিন প্রমুখ পদার্থবিজ্ঞানী। প্রথম বক্তৃতাতেই জগদীশচন্দ্র পৃথিবীবিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেন। জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক বক্তৃতার সাফল্যে পরাধীন ভারতের বাদামী বর্ণের মানুষের বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে ইংরেজদের তাচ্ছিল্যবোধ ও অবজ্ঞার ভাব কিছুটা হলেও বদলে গেলো। লন্ডন ইউনিভার্সিটি জগদীশ বসুকে ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান করলো। ১৮৯৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় ফিরলেন জগদীশচন্দ্র।

প্রথম ইউরোপ সফর শেষে কলেজে ফিরে এসে একটা গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করা তো দূরে থাক – পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। নিজের বেতনের টাকা দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের কাজের জন্য একটা ল্যাবরেটরি দাঁড় করিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু অনুদানের জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখার পর যে উত্তর পেলেন তা এরকম: “ডক্টর বসু এখন মাসে পাঁচশ টাকা মাইনে পান। কোন নেটিভ সরকারি চাকুরের মাসে পাঁচশ টাকায় পোষাচ্ছে না বলাটা নেহায়েৎ বোকামি।”পদে পদে অপমানের উদাহরণ আরো অনেক আছে।

কিন্তু কিছুতেই দমে গেলেন না জগদীশচন্দ্র। ইউরোপ সফরের সাফল্য তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বিদ্যুৎ তরঙ্গ নিয়ে তিনি নতুন উদ্যমে গবেষণা শুরু করলেন। ১৮৯৭ সালে তাঁর তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় লন্ডনের রয়েল সোসাইটি থেকে। ১৮৯৯ সালে গবেষণায় তিনি জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণস্পন্দনের অনুরূপ সাড়া প্রত্যক্ষ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন প্রাণীদের মত জড়বস্তুও বাইরের উত্তেজনায় সংবেদনশীল। জড় ও জীবের এই গোপন ঐক্য সম্পর্কে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের কাছে প্রকাশের একটা সুযোগ এসে পড়লো। ১৯০০ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জগদীশ বসু দ্বিতীয় বারের মত ইউরোপে গেলেন। বাংলা ও ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্যারিসে পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জড়বস্তুর সংবেদনশীলতা বিষয়ে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করেন।

১৯০১ সালের মে মাসে রয়েল ইনস্টিটিউটের শুক্রবারের সান্ধ্য অধিবেশনে জগদীশচন্দ্র “The response of inorganic matter to mechanical and electrical stimulus” শীর্ষক প্রবন্ধে যান্ত্রিক ও তড়িৎ উদ্দীপনার প্রতি উদ্ভিদ ও প্রাণীর ‘সাড়া’ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষণের বর্ণনা দেন। এর আগেই সম্পূর্ণ নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং দেশীয় উপাদানে তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে জগদীশ বসু একটা বৈদ্যুতিক সংবেনশীল যন্ত্রের মডেল তৈরি করেছিলেন। গ্যালেনা বা লেড সালফাইড ব্যবহার করে যন্ত্রটির নাম দিয়েছেন ‘গ্যালেনা ডিটেক্টর’। জগদীশচন্দ্র তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফলে দেখালেন যে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনায় বস্তুর সাড়া দেওয়া ক্ষীণ হয়ে যায় – যাকে বস্তুর ‘অবসাদ’ বলা যায়। এ অবস্থায় আলো বা বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ প্রয়োগ করলে বস্তু পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে, কিন্তু পরিবাহিতাসহ আরো কিছু বৈশিষ্টের মান কিছুক্ষণ উঠানামা করে। তিনি প্রস্তাব করলেন যে কোন অত্যুজ্জ্বল বস্তু থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলে কিছুক্ষণ যাবৎ যে উজ্জ্বল বস্তুটি একবার দেখা যায় আবার অদৃশ্য হয়ে যায় বলে মনে হয় – তার কারণ চোখের রেটিনার পরিবাহিতা ধর্মের স্পন্দন। জগদীশবসুর আগে এরকম করে কেউ চিন্তা করেননি।

১৯০১ সালে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। প্রবন্ধগুলোতে আলোক ও অদৃশ্য বেতার তরঙ্গের সদৃশ ধর্ম নিয়ে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল আলোচিত হয়েছে। ১৯০২ সালে লিনিয়ান সোসাইটিতে বক্তৃতা দেন জগদীশচন্দ্র। ‘সাড়া’ মাপার যন্ত্র ‘রেসপন্স রেকর্ডার’  তৈরি করার পদ্ধতি বর্ণনা করলেন জগদীশ। যন্ত্রটা অনেকটা কম্পিউটারের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের মত। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সংবেদনশীলতা মাপার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে এই যন্ত্র। ১৯০২ সালের মে মাসে রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস-এ প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান সংক্রান্ত শেষ গবেষণাপত্র “On electromotive wave accompanying mechanical disturbance in metals in contact with electrolyte”। তারপর  তাঁর গবেষণা পুরোপুরি উদ্ভিদ ও প্রাণির শারীরবৃত্তীয় ধর্মাবলী পরীক্ষার দিকে মোড় নেয়। জগদীশ বসুকে আমরা পেলাম পৃথিবীর প্রথম বায়োফিজিসিস্ট হিসেবে। তিনি উদ্ভিদের শারীরবৃত্ত সম্পর্কে গবেষণা করেছেন পদার্থবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়ে। এই পদ্ধতির বিস্তৃত প্রয়োগে উদ্ভিদের প্রাণচক্র ও শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা জগদীশ বসুকে চিনলাম উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে।

১৯০২ সালে প্রকাশিত হলো জগদীশচন্দ্রের প্রথম বই “Response in the living and non-living”। ১৯০৩ সালে জগদীশচন্দ্র বসু সি-আই-ই (Companionship of the Indian Empire) উপাধি লাভ করলেন। ১৯০৬ সালে তাঁর দ্বিতীয় বই “Plan response: as a means of physiological investigations” প্রকাশিত হয় লংম্যান গ্রিন কোম্পানি থেকে। পরের বছর প্রকাশিত হলো তাঁর তৃতীয় গ্রন্থঃ “Comparative Electro-Physiology: A Physico-Physiological Study”।

১৯১১ সালে দিল্লীর দরবারে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে জগদীশচন্দ্রকে সি-এস-আই (Companionship of the star of India) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-এস-সি ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯১৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আরো দু’বছর বাড়ানো হয় তাঁর চাকরির মেয়াদ। সে বছর প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ গ্রন্থঃ “Researches on irritability of plants”। ১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন তিনি। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ইমেরিটাস প্রফেসর পদে নিয়োগ করেন। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘নাইট’ উপাধি দেয় জগদীশচন্দ্রকে। তাঁর নামের আগে যোগ হলো ‘স্যার’।

১৯১৭ সালের তিরিশে নভেম্বর স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর ৫৯তম জন্মদিনে প্রতিষ্ঠিত হলো বসু বিজ্ঞান মন্দির। উদ্বোধনী বক্তৃতার শুরুতেই স্যার  জগদীশচন্দ্র ঘোষণা করলেন “আমার স্ত্রী ও আমি এই গবেষণাগারের জন্য সর্বস্ব দান করছি”। জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু নিঃসন্তান ছিলেন।  আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের সবকিছু তাঁরা দান করেছিলেন বাঙলার বিজ্ঞান প্রসারের জন্য।

১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে জগদীশচন্দ্র তাঁর “Life movements in Plants” নামে বৃহৎ বইটি চার খন্ডে প্রকাশ করেন। ১৯১৯-২০ সালে পঞ্চম বৈজ্ঞানিক সফরে আবার ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। ১৯২০ সালের শুরুতে স্যার জগদীশচন্দ্রকে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ দেয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কমিটির কয়েকজন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের ফলাফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ফলে একটি কমিটি গঠন করা হয় যাঁরা জগদীশচন্দ্রের যন্ত্র পরীক্ষা করে দেখলেন।

গাছের বৃদ্ধির হার শামুকের গতির চেয়েও দু’হাজার গুণ কম। একটি সাধারণ গাছ এক সেকেন্ডে এক ইঞ্চির এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ বাড়ে। অর্থাৎ এক লক্ষ সেকেন্ড বা প্রায় আটাশ ঘন্টায় এক ইঞ্চি বাড়ে। এই অতিধীর চলনের গতি লিপিবদ্ধ করার জন্য খুবই সংবেদী যন্ত্রের দরকার যা আবিষ্কার করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ‘ম্যাগনেটিক ক্রেস্কোগ্রাফ’ যন্ত্রের সাহায্যে গাছের বৃদ্ধিকে দশ লক্ষ গুণ বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে গাছের বৃদ্ধির সূক্ষ্ম তারতম্য হিসেব করা সহজ হয়। ১৯২০ সালের ৪ঠা মে রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা জগদীশচন্দ্রের ক্রেস্কোগ্রাফ পরীক্ষা করে দেখলেন যে জগদীশচন্দ্র তাঁর যন্ত্রের ব্যাপারে কিছুই বাড়িয়ে বলেন নি। এর কয়েকদিন পর ১৩ই মে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্য জগদীশচন্দ্রের নাম চূড়ান্ত করা হলো। ১৯২০ সালের ২০শে মে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফেলোশিপ দেয়া হলো স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে।

১৯২২ সাল থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় জগদীশচন্দ্রের। সেগুলো যথাক্রমে: The ascent of Sap (১৯২২), Physiology of photosynthesis (১৯২৪), Nervous mechanism of plants (১৯২৬), Plan autographs and their revelation (১৯২৭), Motor mechanism of plants (১৯২৭), Collected physical papers (১৯২৭), Wrowth and troic movements of plants (১৯২৯)।

১৯২৬ সালে ব্রাসেল্‌স-এ জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন বেলজিয়ামের রাজা। তিনি জগদীশচন্দ্রকে ‘কমান্ডার অব দি অর্ডার অব লিওপোল্ড’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯২৭ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন জগদীশচন্দ্র। ১৯২৮ সালের ৩০শে নভেম্বর সত্তর বছর পূর্ণ হয় জগদীশচন্দ্রের। সে উপলক্ষে ১লা ডিসেম্বর বসু বিজ্ঞান মন্দিরে সম্বর্ধনা দেয়া হয় জগদীশচন্দ্রকে। বাংলার বিখ্যাত সব ব্যক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। ভিয়েনার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন তিনি এ বছর। ১৯২৯ সালে ফিনল্যান্ডের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি তাঁকে সদস্যপদ দেয়। ১৯৩০ সালে জার্মান অ্যাকাডেমি ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ তাঁকে মেম্বারশিপ প্রদান করে। ১৯৩৩ সালে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এবং ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে জগদীশচন্দ্রকে।

১৯৩৭ সালে্র শেষের দিকে  উচ্চরক্তচাপে ভুগছিলেন এবং শরীর ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল জগদীশচন্দ্রের। ২৩শে  নভেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান উপমহাদেশের বিজ্ঞান গবেষণার জনক স্যার জগদীশচন্দ্র বসু।

লেখকঃ  প্রদীপ দেব, শিক্ষক ও গবেষক, মেডিকেল রেডিয়েশান ডিপার্টমেন্ট, আর-এম-আই-টি ইউনিভার্সিটি।

তথ্যসূত্র

১। এম এন সাহা, বায়োগ্রাফিক্যাল মেমোরিজ অব ফেলোজ অব দি রয়েল সোসাইটি (১৯৪০),

২। ডি পি সেনগুপ্ত, জগদীশচন্দ্র বোস- দি ম্যান এন্ড হিজ টাইম (২০০৯)।

৩। প্রদীপ দেব, জগদীশচন্দ্র বসু, মীরা প্রকাশন (২০১৫)।