বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৬)

-বিজন সাহা

কবিগুরু বলেছেন
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।

হ্যাঁ, অন্যায় না করাটাই শেষ কথা নয়, অন্যায়কে সহ্য না করা, তার প্রতিবাদ করা, তাকে প্রতিরোধ করা এটা যে কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। গত সপ্তাহে দেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণ নিয়ে লিখেছিলাম। আজ সেই প্রসঙ্গ ধরেই আরও কিছু কথা বলব, বলব এই আক্রমণ কেন শুধু হিন্দুদের উপর আক্রমণ নয়, এ আক্রমণ সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার উপর আক্রমণ। আর তাই আমাদের উচিৎ সকলে মিলে একে প্রতিহত করা।

প্রায়ই বলতে শুনি যারা কোরআন অবমাননা করে, অন্যের বাড়িঘরে আগুন লাগায়, লুটপাট করে, খুন ধর্ষণ করে তারা দুর্বৃত্ত। ইসলামের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সমস্যা হল এদের অনেকেই মসজিদে নামাজ শেষ করে এসব দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়। তাদের যদি ইসলামের কলঙ্ক, দুর্বৃত্ত হয় তাহলে কীভাবে তারা মসজিদে ঢুকে আর আপনারা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেন, ধর্ম অবমাননার জন্য তাদের বিচার দাবি না করেন না।  ধর্মপ্রাণ মুসলমান যদি এদের বয়কট করে, ধর্মকে ব্যবহার করে অসামাজিক কার্যকলাপ করার জন্য এদের বিচার দাবি করে তাহলেই বোঝা যাবে দেশের মানুষ সত্যিকার অর্থেই এসব ঘটনার অবসান চায়। বর্তমানে ধর্মপ্রাণ মুসলমান এসব দায়িত্ব এড়াতে চাইছে আর এদের মৌনতাকে সম্মতি হিসেবে নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ীরা তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে লড়াই ছাড়া শান্তি মেলে না। দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত দুর্বৃত্তদের রুখে দাঁড়ালে আর সমস্ত নিরীহ মানুষের প্রতি উদার হলে সাম্প্রদায়িকতা পালিয়ে যাবে। আপনার উদারতা যেন অশুভ শক্তির হাত শক্তিশালী করে দুর্বলের কষ্টের কারণ না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব একান্তই আপনার। আর এজন্যেই যারা ধর্মের নামে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের প্রতিরোধ করার দায়িত্বও আপনার।

অনেকেই ভাবেন সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ তাকে পাশ কাটিয়ে যাবে। সেটা ততদিন যতদিন দেশে সংখ্যালঘু আছে। কারণ এখন মৌলবাদীদের দরকার আপনার মৌনতা। আপনার মৌনতাকে ওরা সমর্থন হিসেবে নিয়ে একে একে সব সংখ্যালঘুকে ভিটে ছাড়া, দেশ ছাড়া করবে। তারপরও যদি ভাবেন আপনার জীবন আগের মতই থাকবে তবে আপনি ভুল করছেন। তখন আপনার কবিতা থাকবে না, গান থাকবে না, ছেলেমেয়েদের ইচ্ছে মত শিক্ষা দেবার সুযোগ থাকবে না, চাইলেই মনের মত শাড়ি বা গয়না পরার অধিকার থাকবে না। পরতে পারলেও দেখানোর সুযোগ থাকবে না। ছেলেদের থাকবে না ইচ্ছে মত পোশাক পরার অধিকার। হয়ত ভাবছেন ধর্মীয় পোশাকই আপনার জন্য যথেষ্ট। সেটা ঠিক। তবে এখন চাইলে আপনি অন্য কিছু পরতে পারেন, তখন পারবেন না। সামাজিক ভাবে ক্ষতিকর নয় এমন অনেক কিছুই করতে পারবেন না। নিজের খুশি মত বই পড়তে পারবেন না, গান শুনতে পারবেন না, কবিতা লিখতে পারবেন না, সিনেমা দেখতে পারবেন না। আর আপনারা যারা যুগ যুগ ধরে এসব কিছুই আপনার মৌলিক অধিকার বলে মনে করে আসছেন, হঠাৎ করে জীবন থেকে সেসব উধাও হয়ে গেলে বুঝবেন এই ছোটোখাটো জিনিষগুলো আপনার জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ। এখন এসব হয়ত কথার কথা মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে এসব না হলেও জীবন চলে। চলে না। এটাও এক ধরণের বন্দী দশা। যখন সামরিক শাসন আসে অনেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু ক’ দিন। কয়েক দিন বা কয়েক মাসের মধ্যেই ছোটোখাটো বাধানিষেধগুলো বুকের উপর পাথরের মত জেঁকে বসে। আমরা মুক্তির জন্য আকুতি করতে থাকি। কিন্তু ইরান, আফগানিস্তান – এসব দেশের ইতিহাস বলে একবার ঘাড়ে চাপলে এদের নামানো এত সোজা নয়। সামরিক শাসনে সব বলতে না পারার, পরতে না পারার মানসিক কষ্ট তো আপনাদের অপরিচিত নয়। আসলে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে একটা ব্যাপার আছে। যখন আপনি কী খাবেন, কী পরবেন, কী গাইবেন, কী পড়বেন – এ সব নির্ধারণ করার অধিকার আপনার নিজের থাকে না সেটা যে কী রকমের পরাধীনতা সেটা আগে থেকে কল্পনা করাও কষ্ট। এখনও আপনার ক্ষমতা আছে নিজের এই ছোটখাটো স্বাধীনতাগুলো ধরে রাখার। এক সময় সেটা থাকবে না যদি না আজ অন্যদের চলা, বলা, প্রার্থণা করার অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার  হন। আজই সময় প্রতিবাদের, প্রতিরোধের।

 

মরছে তো হিন্দুরা আমার কী এসে যায়
নাম আমার রক্ষাকবচ কেন যাব ঝামেলায়
হিন্দু নিধন যজ্ঞ হিন্দু মুক্ত হবে দেশ
আমরা তো ভাই ভাই মিলেমিশে থাকব বেশ

হিন্দু হারিয়ে গেছে থামেনি তো অভিযান
রাখবে না দাড়ি দেখি ঘাড়ে ক’ টা গর্দান?
কোট প্যান্ট চলবে না, চলবে না শাড়ি আর
সালোয়ার কামিজ পোশাক ইসলামী উম্মার

চলবে না সাহিত্য চলবে না বিজ্ঞান
একটা মাত্র বই সব বিজ্ঞানের বিজ্ঞান
সিনেমা ডিস্কথেকা চলবে না নাচ গান
আজ থেকে শুনবে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত আযান

ভেবে আমি পাই না কো কী হবে এখন উপায়
কোন লাভ হবে কার এরকম বাঁচায়?
হিন্দু, কাদিয়ানী, নাস্তিক, ব্লগার
কেউ নেই কেউ নেই আমার পাশে দাঁড়াবার।

হিন্দু মরলে আমার এসে যায় অনেকটাই
প্রতিবাদ প্রতিরোধের উপযুক্ত সময় এইটাই
এখনই সময় ভাই হাতে হাত রাখবার
চলো ভাই গড়ে তুলি প্রতিরোধ দুর্বার।

 

এখন হিন্দুদের উপর হামলার পরে হচ্ছে লুটপাট আর ধর্ষণ। দুর্বৃত্তরা লুটপাট করার উদ্দেশ্যে নিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করেছে নাকি ধর্মযুদ্ধের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে লুটপাট করেছে? ঘটনা যাই হোক এর মধ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে একদল মানুষ যারা আইনের তোয়াক্কা করে না, যারা জানে ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে যেকোন অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে গেলেও তাদের কিছু হবেনা। এরাই যদি একদিন এই অস্ত্র আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে তখন? বিশ্বাস হয়না? পাকিস্তানের দিকে তাকান, আফগানিস্তানের দিকে তাকান। ব্লাস্ফেমি ল আজ যতটা না ন্যায় প্রতিষ্ঠা করছে তারচেয়ে বেশি অন্যায় ভাবে অপছন্দের লোকের উপর এক হাত নেবার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। আমাদের ৫৭ ধারাও অনেকটা এ পথেই চলছে। ধর্মের নামে যারা বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত তারা সংঘবদ্ধ। আপনারা বিচ্ছিন্ন। ওদের শত্রু তালিকায় হিন্দুরা সবচেয়ে দুর্বল। আপনার ঔদাসীন্যে প্রথমে হিন্দু যাবে তারপর কাদিয়ানি বা শিয়া। দুর্বলরা একে একে শেষ হবে – কেউ হারাবে প্রাণ, কেউ বা দেশ। কিন্তু এই যে হাজার হাজার বিবেক বর্জিত, অসহিষ্ণু সৈন্য তৈরি হচ্ছে তারা তো কোথাও যাবে না, যাবে না তাদের হিংসা, যাবে না রক্তলিপ্সা। তখন তাদের শিকার হবে কে? আপনিই যে হবেন না সেটা কে বলবে? আর যখন আপনার টার্ম আসবে সমবেদনা জানানোর কেউ থাকবেনা। এখনও সময় আছে দুর্বলকে বাঁচিয়ে নিজে বাঁচুন। দুর্বল মেরে ওরা হাত পাকানোর পরে আপনার আর পালানোর পথ থাকবে না। লড়াইটা আপাত হিন্দুদের জন্যে হলেও আখেরে সেটা নিজের জন্যেই হবে। সময় থাকতেই প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। আপনারা সিদ্ধান্ত নিতে যত দেরি করবেন ওরা তত শক্তিশালী হবে।

 

আসলে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে অত্যাচার অনাচার চলছে সেটা যতটা না সাম্প্রদায়িক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক সমস্যা। কেন? শত্রু সম্পত্তি আইন পাকিস্তান আমলের রাজনীতির ফসল। এটা সুযোগ করে দিয়েছে হিন্দুদের ভূমি দখলের। এই স্বাধীন দেশেও ধর্মের আড়ালে ভূমি দখলের অভিযান চলছেই। আর এ জন্যেই সময়ে অসময়ে বিভিন্ন অজুহাতে আক্রান্ত হচ্ছে হিন্দু জনগোষ্ঠী। বর্তমানে দেশে সুস্থ্য রাজনীতি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দেশে রাজনৈতিক দল বলতে যা বোঝায় তা অনেক দিনই নেই। সামাজিক ন্যায় বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই ব্যর্থ। কোন দলই ক্ষমতায় এসে নিজেদের সমগ্র জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরতে পারেনি, সে চেষ্টাও করেনি। দলীয় স্বার্থের ঘোলা জলে ক্ষমতার দখলদার হয়েছে। তাই চেষ্টা করেছে ক্ষমতায় থাকতে থাকতে নিজেদের আখের গোছাতে। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ব্যর্থ কারণ ক্ষমতাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য, মানুষের ভালমন্দ নয়। তাদের সরকার বিরোধী আন্দোলন তাই জনগণের জন্য দুর্বিষহ দুঃখ বয়ে এনেছে। সেটা আমরা দেখেছি ২০১৪ ও ২০১৯ সালে নির্বাচনের আগে ও পরে। আওয়ামী লীগ সেদিক থেকে যথার্থ বিরোধী দল। ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন করলেও সংখ্যালঘুসহ সমাজের বিভিন্ন গ্রুপ মনোবল ফিরে পায়। সমস্যা হল সবাই একসাথে বিরোধী দল হতে পারে না আর সুষ্ঠু ভাবে সরকার চালানোর, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষমতা আর ইচ্ছা বর্তমানে কোন দলেরই নেই। যতদিন না রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের এই দুর্বলতা বুঝে, স্বীকার করে সেটা দূর করার চেষ্টা করবে, যতদিন না তারা সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারবে, যতদিন না তারা দেশের স্বার্থেই শক্তিশালী বিরোধী দলে প্রয়োজনীয়তা বুঝবে ততদিন কারো মুক্তি নেই – না সংখ্যালঘুর না সংখ্যাগুরুর। মনে রাখা দরকার একদল দুর্বৃত্তকারীদের দিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিউনিটি গঠিত নয়। তবে সমস্যা হল ইসলাম, নবীজি আর আল্লাহর সাথে সাথে তাদের জন্য আত্মসমালোচনা ব্যাপারটাও দিন দিন ট্যাবুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আত্মসমালোচনা ও দলীয় গণতন্ত্রের অভাব রাজনৈতিক দলগুলোকে মাফিয়া গোষ্ঠীতে পরিণত করছে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো