চলমান সংবাদ

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে চট্টগ্রামে গণঅনশন ও বিক্ষোভ মিছিল

– বিশেষ ট্রাইব্যুনালে সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের বিচার দাবি

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্তে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন, হামলাকারী ও চক্রান্তকারীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস মোকাবিলায় ব্যর্থ সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ১১ দফা দাবি দিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। দাবি বাস্তবায়নে আগামী ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, পূজামন্ডপে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের প্রতিবাদে শনিবার (২৩ অক্টোবর) চট্টগ্রাম নগরীতে আয়োজিত ‘গণঅনশন ও গণঅবস্থান’ কর্মসূচিতে ১১ দফা দাবি তুলে ধরেন মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত প্রতিরোধে সর্বস্তরের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের আহ্বানে এই কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার সকাল ৬ টা থেকে নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ে গণঅনশন-গণঅবস্থান ও বিক্ষোভ মিছিলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা ও নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা সংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক রণজিৎ কুমার দে। সমাবেশে রানা দাশগুপ্ত ঐক্য পরিষদের দাবিনামা উপস্থাপন করেন। দাবির মধ্যে আছে- সারাদেশে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন, বস্তুনিষ্ঠ-নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক হামলাকারী ও তাদের পেছনে থাকা চক্রান্তকারীদের গ্রেপ্তার করে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করা, সামাজিক গণমাধ্যমে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর পাশাপাশি যারা উসকানি দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের যারা দায়িত্ব পালনে গাফিলতির পরিচয় দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও যেসব সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় এগিয়ে আসেননি, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া হামলার ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির-বাড়িঘর পুনঃনির্মাণ, গৃহহীনদের পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহতদের সুচিকিৎসা ও নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা প্রদান এবং তাদের প্রত্যেকের পরিবারের একজন সদস্যকে সরকারি চাকরি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংগঠিত সাম্প্রদায়িক ঘটনার তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশনের সুপারিশ সম্বলিত রিপোর্ট অনতিবিলম্বে জনসম্মুখে প্রকাশ ও এর সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করা হয়েছে। দাবিতে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারি দলের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের দ্রুত বাস্তবায়নসহ ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। বিক্ষোভ সমাবেশে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘দাবি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় রেখে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ‘চল চল ঢাকায় চল’ স্লোগান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হবে। ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিটি সংগঠনকে পৃথক অথবা ঐক্যবদ্ধভাবে জনসংযোগ ও প্রতিবাদি কর্মসূচি অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদ ঘোষিত ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য শ্যামাপূজা ও দীপাবলি উৎসব বর্জন, সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোয়া ৬টা পর্যন্ত মুখে কালো কাপড় বেঁধে নিজ নিজ মন্দিরে নীরবতা পালন এবং মন্দির ও মন্ডপের ফটকে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী স্লোগান সম্বলিত কালো কাপড়ের ব্যানার টাঙানোর কর্মসূচির সঙ্গে ঐক্য পরিষদের সংহতি ও সমর্থন ঘোষণা করেন রানা দাশগুপ্ত। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আমরা সবাই সমান। আমাদের মধ্যে কোনো বিভক্তির সুযোগ নেই। স্বাধীন দেশে সবার অধিকার সমান। দুর্গাপূজার সময় ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে যারা হামলা করেছে, সন্ত্রাস করেছে তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের দাবির প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানান তিনি। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক রণজিৎ কুমার দে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, জিরো টলারেন্স মুখে বলতে হবে না, বাস্তবায়ন করুন। বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মূলনীতি আছে। সংবিধানের এই চারটি মূলনীতির একটিও এখন আর কার্যকর নেই। এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিল। প্রধানমন্ত্রী, আপনি সেটি রেখে দিলেন কেন? আপনি প্রতিটি উপজেলায় একটি করে আদর্শ মসজিদ করেছেন। একটি মসজিদ করতে ১৫-২০ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এবার উপজেলায় একটি করে মন্দির, একটি করে প্যাগোডা, একটি করে গির্জা বানান। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্পাদক চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্র, মানবিকতা আজ বিপদাপন্ন। অসাম্প্রদায়িকতা হুমকীর সম্মুখীন। দেশে একটি সাম্প্রদায়িক হামলারও বিচার হয়নি। হামলার বিচার করুন। সারাদেশে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। এ আন্দোলন বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শাক্তির বিরুদ্ধে।’ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঐক্য পরিষদের নেতা শ্যামল কুমার পালিত, নিতাই প্রসাদ ঘোষ, স্বভুপ্রসাদ বিশ্বাস, সুভাষ লালা, অঞ্জন কুমার দাশ, লিটন দাশ, পরিমল চৌধুরী, দীপঙ্কর চৌধুরী কাজল, বিজয়লক্ষ্মী দেবী, অশোক কুমার দাশ, রাধারাণী দেবী, সুচিত্রা গুহ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী, জাসদ নেতা ইন্দু নন্দন দে, অ্যাডভোকেট চন্দন তালুকদার, চট্টগ্রাম নগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য এবং জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার দেব। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম জেলা যুব ঐক্য পরিষদের সভাপতি রুবেল পাল। সমাবেশ শেষে নগরীর আন্দরকিল্লা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় গিয়ে শেষ হয়।

# ২৩.১০.২০২১ চট্টগ্রাম #