শিল্প সাহিত্য

বুলবুল

– কাওসার পারভীন

কাছে-দূরে অসংখ্য ফানুস। বুড্ডিস্ট  টেম্পলের আকাশ আমার দৃষ্টির সীমানায়।  রূপকথার এই আকাশ আর স্কুলে-যাবার বয়সের লক্ষ্মীপুজো ও প্রবারণা পূর্ণিমার মুহূর্তের মাঝামাঝি দুলছে মন।  এক এক করে শৈশবের-তারুণ্যের চেনা মুখ ভেসে আসছে  !   মিতু দি সিনিয়র হলেও, আমার আত্মার বন্ধু ছিলেন, তার সর্বক্ষণের আদরের বোন  ও বন্ধু ছিলাম আমি – সব বিশেষ গল্প আমার জন্যে তোলা থাকতো। ইলেভেন-ক্লাসে  পড়ার সময় তাঁর সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়া হয়েছিলো, কি গভীর পুলক ছিলো  তাতে। বাড়িতে যে কোনো নিমন্ত্রণ হলে, আমি মিতুদির নিমন্ত্রিত।  আহা সে দিনগুলো !  রমা দি আমাকে শিখিয়েছিলেন শরতের প্রিয় গান “আমার নয়ন ভোলানো এলে” ।   সবাই প্রিয় মানুষ,  একেক জনের সাথে একেক রকমের মিষ্টি মায়ার টান  ছিলো ।  মায়ের কলিগ  চিত্রা দি’  অনেক ভালোবাসতেন। ভীষণ সুন্দর ও সরল নিপা দিদিকে দেখতে প্রিয়দর্শিনী শ্রীমতি গান্ধীর মতো মনে হতো। ওদের বাড়ির একটা গানের আসরের কথা আমার স্মৃতিতে অবিনশ্বর হয়ে রয়েছে।  ও বাড়ির স্বাদু খাবার আমাদের বাড়িতে আসতো বছরে কয়েকবার, আর আম্মার জন্যে উপহার অবধারিত  ছিলো  প্রতি বছর।  

বুলবুল আমার এক ক্লাস জুনিয়র ছিলো।  ওর বাসায় আমার বিশেষ দাওয়াত থাকতো।  লুচি-পায়েস, নাড়ু, ও আরো অনেক কিছুর আয়োজন থাকতো আমার জন্য – একেবারেই আলাদা আদর ছিলো আমার  ওর বাসায় । একসাথে স্কুলে-আসা-যাওয়া,ব্যাডমিন্টন খেলা আর গল্প চলতো নিয়মিত, বুলবুল আমি দুজনই মা-বাবার আহ্লাদী কন্যা, দু’জন একটু জেদি ছিলাম যদিও, আমরা কখনো ঝগড়া করিনি। উস্তাদজী মিহির লালা আমাকে তালিম দিয়ে ওদের বাসায় যেতেন, দু’জনকে একসাথেও  তালিম দিয়েছেন।  দুজনই ধর্ম-বিষয়েও  মনোযোগী ছিলাম যে যার নিয়মে।  

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রণজিৎ বাবু, নিরঞ্জন বাবু, মায়ের শিক্ষক হরিপদ স্যার ওঁদের জন্য অন্যরকম মায়া –  শ্রদ্ধেয় ‘গুরু’ হিসেবে পেয়েছি।   শৈশবের গভীর-কালো-চুলের প্রবীণ হোমিওপ্যাথ দাদু, দক্ষিণ ভারতের বাবার নিউরোসার্জণ, সমগ্র শহর কাঁদিয়ে সেদিন বিদায় নেয়া ডাক্তার, প্রিয় দাদা  – এঁদের গভীরভাবে আপন ভেবেছি – স্বপ্নেও বিভাজন মনে ঠাঁই পায়নি ।   
 
শৈশবের অস্পষ্ট স্মৃতিতে থাকা মিষ্টি বিক্রি করা দাদু, আরও সহস্র নাম ভাবনার বিস্তারে আলো ছড়াচ্ছে।  কত মুখচ্ছবি রয়েছে স্মরণে-বিস্মরণে।   বাবা-মা-আমার অগুণতি প্রিয়জন, বন্ধু ও আত্মার কাছের মানুষ আছে বিভিন্ন বিশ্বাসে, দেশে-ভিনদেশে – নাম বলে শেষ হবে না। 

বিহ্বল হয়ে প্ৰথমবার নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি । পরীক্ষা করছি, যাচাই করছি। এভাবে কখনো ভাবিনি আগে।   
 
– না, একবিন্দুও কালি নেই কোথাও, কোন পক্ষে।  প্রতিটি সম্পর্ক স্বচ্ছ।  আকাশটার মতো আলোকিত। 
 
আশি-নব্বইয়ের সময়টা নিয়ে ভাবছি । শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা নগর-গাঁ নির্বিশেষে পরিবারগুলো  এ নিয়মে বাঁধা থাকতো।  
 
আব্বার বন্ধু সহযোদ্ধাদের অনেককে সামাজিক সংকটে সবাই মিলে ভাবতে দেখেছি।  মেয়র, বিভিন্ন মতাদর্শের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ একসাথে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হামলা ও বিভিন্ন বিষয়ে’ সমন্বিত হয়ে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে ও কাজ করতে দেখেছি।  বাবরি মসজিদের সংকটে  আব্বাকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো থাকতে দেখেছি ।  একদিন কোর্ট থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন, এমন সময় একদল মানুষ ছুটে আসে আক্রমণের উন্মত্ততা নিয়ে।  আমাদের কাছাকাছি  হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান পরিবারের বাস।    আব্বা  তখন মধ্যবয়স্ক !  কিন্তু আওয়াজ কানে আসার সাথেই প্রচন্ড তিব্রতায় ছুটে গেলেন একা।  মাথায় পাগলামি ভর করা  মানুষগুলোর সামনে ভয়ে অন্য কেউ যায়নি।  সুতীব্র কণ্ঠস্বর ও সাহসী একটা দৃঢ় অবস্থান থেকে কথা বলতে, প্রশ্ন করতে থাকলেন আব্বা। নিজের কথা না-ভেবে, বিশাল বাহিনীর সামনে দাঁড়ালেন।  ওদের মানসিক শক্তি আব্বার সামনে স্তিমিত হলো,  চুপ করে সরে গেলো। 

সুন্দর ও সত্য উন্মোচন করায় অবিচল থাকতে হবে।  শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম কতৃত্ব, ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব, অহংকার,  লোভ, ভূ-রাজনৈতিক জটিল খেলায় ‘খাণ্ডবদাহন’ ক-ত-বা-র হয়েছে !  আস্থায় মরচে পড়ছে।  হতবিহ্বল ভরসার জায়গা। এর মাঝেই আমাদের পথ খুঁজতে হবে।  অভিমান ও বেদনা সারিয়ে এগিয়ে যাবার কাজ করবো – নির্মোহ সত্য খুঁজবো।  ভয়, জিঘাংসা, দর্শনগত তফাৎ – কঠিন কিছু প্রশ্ন রয়ে যাবে !  এছাড়া কিছু বেপথু ছিলো, থাকবে। আইনের সাহায্য বাড়িয়ে, পার্থক্য নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা, স্পেস রাখা ও সম্মান করার পাঠ নিতে হবে। অসীম সাধনার কাজ!   তবুও এগিয়ে যাবার কাজ শুরু করতে হবে!   –  “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।”  –  বিশ্বে পাশে দাঁড়ানোর মানুষ ছিলো, থাকবে।  
প্রভাত ফেরিতে আজানের পর পর বেরুতে হবে, শাড়ি পরতে আমার সময় লাগতো।  সরু করিডোর দিয়ে যে রুমে আমি ঘুমাই, ভোরের আগেই জানালার কাছে এসে বুলবুল আমাকে ডেকে তুলতো।  কালো-পাড়-সাদা-শাড়ি কালো ব্যাজ সব রেডি ।  চাকরি-সংসার-মাতৃত্ব মিলিয়ে বন্ধু, সাহিত্য-সংস্কৃতি বাদ পড়ে, আর ফেরা হয়না সেখানে।  বুলবুল অন্য কোনো দেশে আছে।  যোগাযোগ হয়নি ।  

দু’বছর বয়স থেকে আমার ছেলেকে কি ভেবে জানিনা  ‘বুলবুল’ ডাকতাম, স্বতঃস্ফূর্তভাবে শব্দটা মনে আসতো – এখনও মাঝে মাঝে ডাকি।  কৈশোরের সই অবচেতনের আড়ালে আছে বলে হয়তো ‘শব্দটি’ স্মৃতি-বিস্মৃতির মাঝে সেতু তৈরী করছিলো।