বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫)

– বিজন সাহা

বিগত বছরগুলোতে পূজা শুরু হয় মূর্তি ভাঙ্গার উৎসব দিয়ে। এবারও ব্যতিক্রম ছিল না। এসব ব্যাপারে কনসিস্টেন্সি ঈর্ষণীয়। পূজায় তাণ্ডব নিয়ে যেসব পোস্ট চোখে পড়ল তার প্রায় সবগুলোতেই সংখ্যালঘুদের কথা বলা হয়েছে, বলা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণের কথা। তাতে ক্ষোভ আছে, আছে সমবেদনা, আছে সহমর্মিতা। তবে একটা জিনিসের অভাব চোখে পড়ার মত। কেউ বলছে না যে আক্রমণ হয়েছে মানুষের উপর, পরাজিত হয়েছে মানবতা। লঙ্ঘিত হয়েছে মানুষের নাগরিক অধিকার। কেন? তাহলে কি বুঝতে হবে হিন্দু মরলে মুসলমান হিসেবে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি, মানুষ মরলে মানুষ হিসেবে সেটা পারি না? আর তাই ঐক্য নয় বিভেদের মাধ্যমে আমরা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি? এটা আমাকে আশির দশকে এরকম শিরোনাম মনে করিয়ে দেয় – একজন পুলিশ ও দুই জন মানুষ।

এসব ঘটনার প্রতিবাদে অনেকেই কালো প্রোফাইল ব্যবহার করছেন। আমি করিনি। অনেকেই প্রতিবাদস্বরূপ পূজা বন্ধ করার দাবি করেছেন। আমি করিনি। কেন? মৌলবাদ আমার শত্রু। আমি আমার হাসিমুখ দেখিয়ে, ভাল থেকে শত্রুর আনন্দ একটু হলেও মাটি করতে চাই। ওরা তো এ দেশ থেকে পূজা নির্বাসন দিতে চায়। পূজা করাই হবে তার সঠিক প্রতিবাদ।
আমাদের অনেকেই প্যারিসসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে সন্ত্রাসী আক্রমণে আহতদের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। আজ যা ঘটছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের উপর যেসব আক্রমণ ঘটে সবই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ। হ্যাঁ, সন্ত্রাসবাদী। কেননা লক্ষ্য একটাই – আতঙ্ক সৃষ্টি করে এদের দেশ ছাড়া করা। আর এই আক্রমণের শিকার কোটি কোটি মানুষ। হ্যাঁ, ১৭ কোটি বাংলাদেশির ৮% – সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি দেশে জনসংখ্যা এক কোটির কম। এত বিশাল এক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন, কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার কেউ (আমি এথনিক্যালি ইউরোপিয়ানদের কথা বলছি) কি বাংলাদেশের এইসব হতভাগ্য মানুষের সমর্থনে কিছু বলেছে? কেন? কারণ সরকার একে বলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সংখ্যাগুরুরা এটাকে বিপথগামী পাকিস্তানপন্থীদের আক্রমণ বলে নিজেদের কাঁধ থেকে দায়িত্ব সরিয়ে ফেলে। আর আমরা যারা এ ঘটনায় ব্যাথিত হই, প্রতিবাদ করি, তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক, বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে আসতে চাই না। প্রিয়া সাহার উদাহরণ এখনও সবার মনে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।

২০১৪ সালে নির্বাচনের পরে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হলে অপেক্ষা করেছিলাম মস্কোর বন্ধুরা কিছু বলে কিনা সেটা দেখতে। এর আগে আমরা একসাথে শাহবাগের পক্ষে বলেছি, মিটিং মিছিল করেছি। তাই অন্যায়ের প্রতিবাদ আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। নাইন ইলেভেনের পরে স্থানীয় মুসলিমদের উপর আক্রমণের খবর পেয়ে ফোন করে ওখানকার বন্ধুদের খোঁজ খবর নিয়েছি। কিন্তু ২০১৪ সালে কেউ জানতেও চায়নি দেশে আত্মীয় স্বজন কেমন আছে? (ব্যতিক্রম আহসান আর মিজান) এখানে আমরা কিছু করতে পারি কিনা? পরে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাইকে জড়ো করে প্রতিবাদ লিপি দিয়েছি দূতাবাসে। অনেকেই জানতে চেয়েছে কেন তাদের বলা হল না। বলেছি ঘরে যখন আগুন লাগে প্রথম বালতি জল নিজেকেই ঢালতে হয়। আর বলেছি – আমার প্রতিবাদ আমি হিন্দু বলে নয়, মানুষ বলে। ঠিক যেভাবে প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের আক্রমণের প্রতিবাদ করি, রোহিঙ্গাদের উপর বার্মিজদের আক্রমণের প্রতিবাদ করি, ভারতে বা ইয়েমেনে বা বিশ্বের যেখানেই মানবতা বিপন্ন হয় তখনই এ নিয়ে কথা বলি। হিন্দুদের উপর এখন যে আক্রমণ হচ্ছে সেটা মানবতার উপর আক্রমণ। যেখানেই মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় সেখানেই যেকোনো প্রগতিশীল, যেকোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষের উচিৎ তার প্রতিবাদ করা। আমি সেখান থেকেই এর প্রতিবাদ করছি।

বর্তমানে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটা জোকে পরিণত হয়েছে। অনেকটা ধর্ষণ করে মিলনের মত। শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য নয় নিজেদের বিবেকের জন্য হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ (হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি এদের এক স্বল্প অংশ এই আক্রমণে জড়িত) মানুষের উচিৎ এর প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা আর বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে আনা। ভুলে যাবেন না মাত্র কয়েক বছর আগেও আমেরিকা আর ইউরোপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা দিতে চেয়েছিল। তাদেরও জানা দরকার মৌলবাদের আসল রূপ। যারা ভাবেন দেশের সমস্যা বাইরে নেওয়া কেন, তারা অনেকেই ঘরে বৌয়ের উপর নির্যাতন করে বাইরে নারীর অধিকার রক্ষার সৈনিক সাজার মনোভাব পোষণ করেন। যখন সমস্যা আছে, সেটার সমাধানই আসল কথা। কিন্তু সমস্যা সমাধান করতে হলে আগে সেটাকে স্বীকার করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গাল ভরা নামের ভেতর  সমস্যাকে লুকিয়ে রাখলে তার সমাধান কোনদিনই হবে না। বাইরের মানুষ আপনার দুর্বলতার কথা জানলে তাতে যতটা সম্মান খোয়া যাবে তার চেয়ে বেশি অর্জন হবে সমস্যা সমাধান করলে। উদাহরণ? একসময় আমরা ছিলাম তলাবিহীন ঝুড়ি। সবার কাছে গেছি সাহায্যের হাত পেতে আর সেই সাহায্য নিয়েই আজ এই পর্যায়ে এসেছি। এখন আমরা অনেকের জন্যই উদাহরণ। তাই বিষয়টা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলা দোষের কিছু নেই। এটা তো গোপন কিছু নয় যে প্রশাসনের এক অংশের গাফিলতির বা অনিচ্ছার বা সক্রিয় অংশগ্রহনের কারণেই এসব ঘটে। তবে অন্য এক অংশ এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক বলেই মনে হয়। এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হলে যেকোনো প্রশাসনই বাধ্য হবে বিষয়টার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে। তাছাড়া এসব ঘটনার আন্তর্জাতিক রূপ এজন্যেই দেওয়া দরকার যে এদের ফান্ডিং হয় বাইরে থেকে। আন্তর্জাতিক ভাবে প্রতিরোধ না করলে, ফান্ডিং বন্ধ না করলে এসব সমস্যার সমাধান অলমোস্ট অসম্ভব। তাছাড়া সন্ত্রাসবাদ আজ আন্তর্জাতিক সমস্যা। সেদিক থেকে হলেও নাগরিক সমাজ, সরকার সবাইকে এর প্রতি আন্তর্জাতিক কমিউনিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে আর সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

অনেকে হয়তো এখনও ভাবেন এটা হিন্দুদের সমস্যা, আমাদের তাতে কী? আচ্ছা একটা অবস্থা কল্পনা করুন। আপনাদের অধিকাংশ মানুষের পরিচিত হিন্দু আছে। সে স্কুলে হোক, কর্মক্ষেত্রে হোক। যদি তা না  থাকে তো আপনাদের অনেকেই ভারতে চিকিৎসা করতে যান। যদি সেটাও না থাকে বিভিন্ন ডিভাইস যে ব্যবহার করছেন দেখবেন সেসব যারা তৈরি করেছেন তাতে দু একটা হিন্দু নাম আছে। সেটা গুগল হোক, ফেসবুক হোক। এক কথায় আধুনিক বিশ্বে অনলাইন অথবা অফলাইন তাদের সাথে আপনার দেখা হবেই। এখন ভেবে দেখুন এদের মধ্যে কোন লোকটা আপনার ক্ষতি করেছে? এমনকি আপনার প্রতিবেশি হিন্দু সে আপনার কী ক্ষতি করেছে? আপনার জমি দখল করেছে? আপনাকে চাকুরীচ্যুত করেছে? একটু গভীর ভাবে ভাবলে দেখবেন ঐ পাশের বাড়ির অথবা দূরের হিন্দু নয়, যে লোক আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে সেই আপনার বেশি ক্ষতি করেছে। কেননা এখন আপনার প্রতিবেশি মাথা নীচু করে থাকা কোন ভীত হিন্দু হবে না, হবে প্রভাবশালী মুসলমান যাকে আপনি ভয় করবেন। পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস ভুলে গেলেন? আমাদের ঘাড়ে চড়েই পাকিস্তানের জন্ম, অথচ তারাই আমাদের, আমার আপনার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল।

বাংলাদেশে রাজনীতিতে ভাটার সময় চলছে। রাজনীতি জীবিত না মৃত সেটাই প্রশ্ন। এখনও যে মরেনি সেটা জানাতে মাঝে মধ্যে সরকারি দলের বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। বিরোধী দল গৃহহারা মাঠ ছাড়া। বর্তমান পরিস্থিতে বাম দলগুলো অন্তত শুধু বিবৃতি দিয়ে নয় সত্যিকার অর্থেই হিন্দুদের পাশে দাঁড়াতে পারত। এরকম ছোট ছোট গোষ্ঠী যারা অস্তিত্ব সংকটে আছে তাদের সম্মিলিত যেকোনো উদ্যোগ শুধু তাদের নিজেদের জন্যে নয়, পরিণামে দেশের জন্য, দেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভাবতে পারেন কমিউনিস্টরা কেন হিন্দু সমস্যায় জড়াবে? আবারও বলছি সমস্যা হিন্দু সমস্যা নয়, সমস্যা মানবিক, সমস্যা নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার। পার্টি কংগ্রেসের আগে এটা অন্তত পার্টিকে কিছুটা হলেও সক্রিয় করত। দ্রব্যমূল্য, তেল গ্যাস – এসবের জন্য লড়াই ভাল, তবে আরও ভাল মানুষের জীবন বাঁচানো। আজ মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে হিন্দুদের পাবেন, কিন্তু তারা যেদিন নাই হয়ে যাবে সেদিন কাকে নিয়ে লড়াই করবেন? এটা শুধু সিপিবি নয় একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী যেকোনো শক্তির জন্যই প্রযোজ্য।

ইদানিং একটা জিনিস প্রায়ই চোখে পড়ে। শুক্রবার নামাজের পরে শুরু হয় বিভিন্ন তাণ্ডব। তা সে হিন্দু পল্লীতেই হোক আর বামপন্থীদের মিটিং, মিছিল বা অফিসে আক্রমণই হোক। কিন্তু সবাই তো আর এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে নামাজে যায় না, অনেকেই যায় ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। আপনি মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন একান্তই ধর্মীয় বিবেচনায় আর ওরা এটাকে নিজেদের শক্তি হিসেবে, সমর্থন হিসেবে দেখে। সত্যিকারের ধার্মিক কি নিজেকে ভুল ভাবে ব্যবহার করতে দেবে? ভাবার সময় এসেছে আপনি কার পেছনে, কার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করবেন।  আমার মনে পড়ছে আশির দশকের ঘটনা। আমাদের কলেজে এক নতুন শিক্ষক এলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করা বেশ কিছু শিক্ষককে তিনি নামাজ পড়তে ডাকলেন। একসময় শুনি তারা সবাই জামাতে যোগ দিয়েছেন। এটা বলছি এজন্যেই যে আপাত দৃষ্টিতে যেকোনো আমন্ত্রণ খুব নিরীহ মনে হলেও একসময় সেটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। আজ ফেসবুক যেমন বন্ধুর বন্ধু এই আলগোরিদম ব্যবহার করে অন্যদের ফ্রেন্ড অফার করে একসময় জামাতের কর্মী আপনাকে নামাজ পড়তে ডাকত। তাদের উদ্দেশ্য যত না নামাজ পড়ানো তার চেয়ে বেশি আপনাকে তাদের বলয়ে আনা। আপনাকে নিজেদের কর্মী করতে না পারলেও ওরা কিন্তু আপনাকে দেখিয়ে আপনার বন্ধুদের দলে ভেড়ায়। সমস্যা আপনার নামাজ পড়ায় নয়, পরোক্ষভাবে ওদের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ায়। আর এভাবেই একদিন আপনি মসজিদে না যাওয়ার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছেন। দেশে তো আপনারা এক ইস্যুতে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে আন্দোলন করেন। নামাজ সেভাবেই পড়ুন। যে মসজিদে ধর্মের পাশাপাশি রাজনৈতিক আলোচনা হয় সেখানে যাবেন না। আপনার ধর্ম বিশ্বাস যেন উগ্রবাদী ধর্ম ব্যবসায়ীদের পুঁজি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো