কবি শাহিদ আনোয়ার স্মরণে শিল্প সাহিত্য

শান্ত নীরব ধীমান শাহিদ আনোয়ার

– অশোক সাহা

জীবনের শেষ লগ্নে ছোট ভাই কবি ইংরেজীর শিক্ষক শাহিদ আনোয়ার ব্রেইন স্ট্রোক করে বেশ কষ্ট পেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে । ওর সহযোদ্ধা জীবন সাথী অধ্যাপক শেলিনা শেলী শেষতক লড়াই করেছে আরো কয়টা দিন নিজের প্রিয় মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য । শাহিদকে চিনি সত্তর দশকের শেষ থেকে। আমরা সে সময়টায় পঁচাত্তরোত্তর বৈরী সময়ে আমাদের ছাত্র ইউনিয়নটা সম্মানজনক ভাবে দাঁড় করাবার কষ্টকর কাজটায় যুক্ত ছিলাম । ছাত্র ইউনিয়ন নিয়ে শাহিদের মনে ছিল নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা । আমাদের অফিস ছিলনা । দারুল ফজল মার্কেটের দ্বোতালার বারান্দায় বসে কাজকর্ম সারতাম । একদিন শাহিদকে আমার সাথে বসিয়ে দেয় আমাদের উৎপল । সম্ভবত সাথে ছিল আলকরনের জয়নালও ছিল। শাহিদ নানা ধরনের রাগ ক্ষোভ অভিমান জিজ্ঞাসা নিয়ে ভদ্র ভাবে নিরুত্তাপ কন্ঠে আমার সাথে বেশ কিছুক্ষন কাটালো । আমার কথা বা আলোচনা ওর মনে ধরলো কিনা সে বৈঠকে বুঝতে পারিনি । পরে এক সময় দেখলাম শাহিদ আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল সমাবেশের নিয়মিত একজন হয়ে গেলো । ফিরিঙ্গী বাজারের কবিরাজ বিল্ডি এ ওদের বাসা ছিল । ওর দেখাদেখি ওর ছোট ভাই মাঈনুও ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হয়ে যায় । আমার কাছে ভালই লাগতো । ছাত্র ইউনিয়নে কোন চটক ছিলনা । নেতিবাচক কোন ধরনের অপসংস্কৃতিও ছিলনা । আশা স্বপ্নের গন্তব্য ছিল বহু দূর । ছটফট মন নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করা কঠিন । অসীম ধৈর্য লাগে । আমাদের শাহিদ শান্ত শিষ্ট ধৈর্যশীল চুপচাপ ছিল । নিজের মত করে চলতো । নিজেকে নিয়ে অতো বাহুল্যতা প্রদর্শন করতো না । আমাদের সমাজ বিচারে এটা একটা ভাল গুন । এক সময় দেখি রাজপথের ঝাঁজালো মিছিল স্লোগানে অংশ নিয়েও ছড়া কবিতাও লিখছে । কবিতা ছড়া লিখা একটা কঠিন অধ্যায় লাগে আমার কাছে । বিশেষ একটা যোগ্যতা লাগে । যে কেউ চাইলেই এটা পারে না । বিশেষত আমি দেখেছি আমার কিছু ছোট ভাই পঁচাত্তর খুনের পর থেকে সামরিক স্বৈরাচারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বিমূর্ত কথামালায় বা ব্যঙ্গ করে সাহসী ছড়া কবিতা লিখতো । আমাদের শাহিদ ছিল সেই বৈরী সময়ের একজন সাহসী লিখিয়ে । চুপচাপ নীরব শাহিদ । অথচ মনটা সাহসে পূর্ন । সে সময়টায় দেখতাম শাহিদ সহ আমার আরো বেশ কতক সাহসী সহযোদ্ধা ভাইবোন বিক্ষুব্দ মনের ভাব প্রকাশ করতো ছড়া কবিতা দিয়ে । এখনো সবাই লিখে যাচ্ছে । অনুষ্ঠান করে চলছে শিল্পকলায় বা অন্য কোথাও । সবাই আমাদের শাহিদের সহযাত্রী সহযোদ্ধা । সংগ্রামের পথচলায় শাহিদ একসময় আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হবার যোগ্যতা অর্জন করলো । পার্টির সংগ্রাম সংগঠনে সময় দিতো । তিনটা কাজ শাহিদ একসাথে করে যেতো । কলেজে ইংরেজী পড়ানো । পত্রিকায় কাজ, সময়ে রাত জেগে । আমাদের শাহিদকে কখনো কোথায় কোন বাড়াবাড়ি অনৈতিক সুবিধাবাদী আত্মম্ভরি হতে দেখিনি । আমার আদর স্নেহ ওর জন্য সব সময় ছিল । একটা সময়ে শাহিদ ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে । জীবনের কাছে হারতে হয়েছে । স্ট্রোক করার পর দৌড়ে দৌড়ে দেখতে গেছি । আর কিছুই করতে পারিনি প্রিয় শাহিদের জন্য । করোনার ছোবলে কবলিত সময়ে আমার বোন শেলিনা শেলী অসমসাহসী যুদ্ধ করে যতদিন পেরেছে শাহিদকে বাঁচিয়ে রেখেছে । কোন বিরক্তি কখনো দেখিনি । জীবন সাথী হিসেবে শেলী অসাধারন দায়িত্ব পালন করেছে ।

লেখক, সাধারন সম্পাদক, সিপিবি, চট্টগ্রাম জেলা