কবি শাহিদ আনোয়ার স্মরণে শিল্প সাহিত্য

কবিতা: নার্স  ■কবি: শাহিদ আনোয়ার

– শোয়েব নাঈম

কবিতার নায়ক শাহিদ আনোয়ারের ক্লেশিত মনের সৃজনী প্রক্রিয়াতে একটি লাইনের থেকে আরেক প্রতিকূল অসম্পন্ন প্রণয় লাইনের দূরত্ব হচ্ছে দীর্ঘপ্রসারিত কিলোমিটারের সমান, কিন্তু অদৃশ্য তলদেশে কবিতার প্রতিটি লাইনের মানসিক যন্থণার মধ্যে আছে মিলিমিটার সমান নিবিড় সম্পর্ক। বেদনা-বিদীর্ণ-বিভেদ, একটি থেকে আরেকটির তিন চুয়ানি আস্তরণ পার হয়ে হয়ে যন্ত্রণার ক্ষরণে বিকশিত হয়েছে ‘নার্স’ কবিতাটি (‘কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে’- গ্রন্থভুক্ত একটি কবিতা)। বিমিশ্র পরস্পর বিরোধী প্রতিক্রিয়ায়, ব্যথার ব্যাক্তিরূপদানে নার্স-স্বরূপ চরিত্র সৃষ্টি করে, স্বরবৃত্ত মাত্রায় ম্যাটাফর পরিব্যাপকে কবিতাটি বিনির্মিত হয়েছে। সমগ্র কবিতাটিতে পরিবেষ্টিত আছেন যে নার্স, তিনি উপস্থিতকালে তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় উপশমের অনুরূপ এক সূর্যোদয়…her eyes that is sunrise, কিন্তু তার চাহনির তীব্র বিসর্জনে আছে আশার পরিত্যাজ্য টলটলায়মানতা। এই কবিতার প্রতিটি অনুচ্ছেদ হচ্ছে যন্থণার পুনরাবৃত্তির অনুবর্তন, মানসিকভাবে যতখানি ধারণ করতে অক্ষম তারচেয়ে বেশি বিরক্ত প্রকাশ এবং ভাবমূলক ভাষার বিন্যাসে আছে ব্লেডের মতো ধারালো ও রক্তাক্ত। প্রতিটি লাইন পাঠে যতটা অনাড়ম্বর মনে হয়, কিন্তু নিবিড়পাঠে তারচেয়ে অধিক অনাবৃত করে মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত জটিলতা।

৫টি রচনাশৈলী অনুচ্ছেদগাঁথা এই কবিতার হরিজেন্টাল লাইন থেকে ভার্টিকাল লাইনে অধিকতর ইঙ্গিতধর্মী অনুপ্রবেশ আছে।

যেমন—

প্রতিটি অনুচ্ছেদের প্রথম লাইনের প্রথম এবং দ্বিতীয় শব্দে দৃষ্টি দিলে (সিরিঞ্জ ভরা, রক্তক্ষরণ বাঁধতে, ঘুম তাড়ানী, শিরায় এ, বাঁচতে চাওয়ার) এসব যন্ত্রণাধর্মী শব্দের উদ্ভবে কবিতার স্থানটি বিচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যনিবাসী একটি হাসপাতালয় মনে হয়। আর প্রতিটি অনুচ্ছেদের তৃতীয় শব্দের দিকে দৃষ্টি দিলে (দুঃখ, এসে, দৃষ্টি, কোন, প্রার্থনাকে) এসব শব্দের উল্লেখকে ঐক্যবদ্ধ করলে মনে হয় হাসপাতালভিন্ন অন্য কোথাও স্বগতোক্তিতে আলাপ করছে।

প্রতিটি অনুচ্ছেদের শেষ লাইনে ‘তবু’ অব্যয় পদ বৈশিষ্ট্যে প্রয়োগ না হয়ে কবিতায় অলঙ্কারিক চিত্রকল্প হয়েছে।

৫টি অনুচ্ছেদের প্রথম লাইনে সাদা পোশাক পরিহিতা শেষ শব্দ ডিউটিরত ‘নার্স’-এর পুনরাবৃত্তিতে কবিতাটির ম্যাটাফরিক ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়েছে।

হরিজেন্টাল লাইনে প্রতিটি অনুচ্ছেদের প্রথম লাইনে কবিতার বহিরঙের বিষয় না হয়ে কবির কল্পনাশক্তির অন্তর্গত চিত্রকল্প হয়েছে। ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য দানের উদ্দেশ্যে এই সকল চিত্রকল্প কবিতায় ইন্দ্রীয়ধর্মী অধিকস্তর অনুভূতিতে প্রকাশ করেছেন। যেমন—

মনঃপীড়াঃ ‘সিরিঞ্জ ভরা দুঃখ দিলে’ ;

আঘাতঃ’রক্তক্ষরণ বাঁধতে এসে রক্ত ঝরাও’;

ইনসোমনিয়াঃ ‘ঘুম তাড়ানী দৃষ্টি মেলে ঘুম

পাড়ালে’ ;

বিষণ্ণতাঃ  ‘শিরায় এ কোন রক্ত দিলে,

মিলছে নাতো’;

পরিত্রাণঃ’বাঁচাতে চাওয়ার প্রার্থনাকে উপড়ে নিলে’….

প্রত্যেক অনুচ্ছেদে কমনভাবে উল্লেখ থাকা

‘শুভ্র নার্স’ শব্দদ্বয় বিশেষণ-বিশেষ্য মধ্যেকার দ্বান্দ্বিকতায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি চরিত্র। যেটি একটি প্রগাঢ় ধূসরধর্মী রুপক। কবিতার এই রূপকার্থের ভিতরে কবি নিজেকেই অন্তরালে রেখেছেন। এই কবিতার রহস্যজনক রূপক চরিত্র ‘নার্স’ হচ্ছেন স্বয়ং কবি, যিনি অতি মানসিক যন্ত্রণার পাশ্বপ্রতিক্রিয়ায় ম্যাটাফরে নিজেই নিজের সাথে সমগ্র কবিতায় স্বগোক্তিতে রোগ ও নিরাময়ের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন।

৫টি অনুচ্ছেদধর্মী ‘নার্স’ কবিতায় হরিজেন্টাল এবং ভার্টিকাল ডিরেকশনে চিত্রকল্প, রুপকের মৌলিক উদ্ভবে ও প্রয়োগে সূচিত করেছেন কবি শাহিদ আনোয়ার আধুনিক কাব্য নির্মাণে অনুপম স্বকীয় এবং অসাধারণ প্রক্রিয়া। হরিজেন্টাল এবং ভার্টিকাল এই দুই অভিমুখে কবিতা সৃষ্টি বাংলা কাব্যসাহিত্যে বিরল প্রয়োগের কবিতা খুব কমই আছে। এই কাব্যবৈশিষ্ট্যে উদ্ভাবনক্ষমে এই কবিতা যেমন সমকালে এবং অনাগতকালে প্রথম সারিতে যেমন থাকবে, তেমনি সমকালীন এবং উত্তরসূরীদের জন্য কবি শাহিদ আনোয়ার কাব্যশক্তিতে অবশ্যই-পাঠ্য কবি হয়ে বাংলা কাব্যসাহিত্যে অতিউজ্জ্বল অবস্থানে চিলকাল থাকবেন।

শোয়েব নাঈম, কবি ও প্রান্ধিক