মতামত

কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নেওয়া এক প্রবাদপ্রতিম প্রগতির পরিব্রাজক

– রবি শংকর সেন নিশান

রবি শংকর সেন নিশান (ফাইল ছবি)

উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রথমকালের ঘটনা। বর্তমান চট্টগ্রামের সন্দীপ উপজেলার সন্তান কমরেড মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে বাংলায় কমিউনিস্টরা সবে কাজ শুরু করেছে। তাঁদের মুখপাত্র “লাঙল” পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কমরেড মোজাফফর আহমেদ, কমরেড শামসুদ্দীন হোসেইন, কমরেড আব্দুল হালিম, কাজী নজরুল ইসলাম, কমরেড হেমন্ত সরকার, কমরেড সরোজ মুখার্জি প্রমুখের নেতৃত্বে সেসময় কমিউনিস্টরা বাংলায় শক্তি সঞ্চয় করেছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি করা নিষিদ্ধ থাকায় তারা কাজী নজরুল ইসলাম-এর নেতৃত্বে “স্বরাজ লেবার পার্টি” গঠন করে তার মাধ্যমেই সংগঠিত হতে থাকেন।

কমিউনিস্টদের প্রথম সম্মেলন হবে কানপুরে। এই বিষয়েই আলাপ করতে কমরেড শামসুদ্দীন হোসেইন দেখা করেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। সেখানেই কবিগুরু পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর মার্কসবাদী ভাতৃ-পৌত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। ডাকনাম সৌমেন। কবিগুরু সৌম্য বলে তাঁকে ডাকতেন। সৌমেনের ঠাকুরদা ছিলেন দার্শনিক, কবি ও গণিতবিদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বজেষ্ঠ্য ভাই। সৌমেন প্রেসিডেন্সিতে ছাত্ররত অবস্থাতেই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। শামসুদ্দিন হোসেইনের মাধ্যমে যোগাযোগ ঘটে কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সাথে। কমরেড রায়ের অনুপ্রেরণায় কমরেড মোজাফফর আহমেদের তত্ত্বাবধানে শুরু হলো কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর যাত্রা।
“লাঙল” পত্রিকাটাই কমিউনিস্ট পার্টির সেসময়কার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিলো। নজরুলের সাথে যৌথ টিমে কাজ করছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ। তাঁর প্রচেষ্টায় সেসময় যুক্ত হন অনেকেই। এসময় তাঁর হাত ধরে উঠে পার্টির সাথে যুক্ত হলেন পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নামকরা কমিউনিস্ট নেতা কমরেড সুধাংশু দাশগুপ্ত, অধ্যাপক কমরেড অমিয় দাশগুপ্ত, কমরেড সুধীন কুমার প্রমুখ।
কমিউনিস্ট আন্দোলনকে উৎসাহ দিতে “লাঙল” পত্রিকাকে আশীর্বাদ স্বরূপ সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিজের একটি দুই লাইনের কবিতা লাঙল-এ ছাপাতে দেন।
“জাগো, জাগো বলরাম, ধরো তব মরুভাঙ্গা হল
প্রাণ দাও , শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।”
‘লাঙলে’র প্রচ্ছদপটে কবিগুরুর ঐ আশীর্বচন সবসময়ই থাকত।
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া কবি বলেছিলো”- ৮০ দশকের শুরু থেকে এখনো পর্যন্ত বহুল প্রচারিত এই অপপ্রচারটা একদমই মিথ্যে। বরং তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জেনে বিস্মিত হবেন যে বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের একদম গোড়ায়, একদম শিকড়ে প্রোথিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের অতুলনীয় অবদান। এই বিষয়ে অন্যদিন আলোকপাত করবো।
এরই মধ্যে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’র বাংলা অনুবাদ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম সেই অনুবাদ “লাঙল” পত্রিকায় ছাপান।
১৯২৬ সালে তিনি বেঙ্গল পেজেন্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন।
কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর কানপুরের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য এর আগেই তাঁর পিতা কবি ও সাহিত্যিক সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বিদেশে গিয়ে আরো বৃহত্তর পরিসরে কমিউনিস্ট আন্দোলনে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। তিনি রাশিয়ার মস্কোতে কমিউনিস্টদের ৬ষ্ঠ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেখানে মার্কসবাদের উপর তাঁর পাণ্ডিত্য ও যুক্তিবাদী বক্তব্য অত্যন্ত প্রশংসিত হয়। পরবর্তীতে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ গ্রহণ করেন। জার্মান থেকেই তিনি “নারায়ণ” ছদ্মনাম নিয়ে শুরু করেন বই লেখার কাজ। ১৯৩০ সালে ‘বিপ্লব বৈশাখী’ নামে একটি বই লেখেন সৌমেন্দ্রনাথ। সুদূর বার্লিন থেকে প্রকাশিত এই বইতে ভারতে বিপ্লব প্রচেষ্টার রূপরেখা এবং সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। সেই বই ভারতে এসে পড়তেই টনক নড়ে সরকারের। ইন্ডিয়া কেন্দ্রীয় সরকারকে এই বিষয়ে সচেতন করে চিঠি লেখে বেঙ্গল প্রাদেশিক সরকার। কিছুদিনের মধ্যেই বাজেয়াপ্ত করা হয় বইটি। শুধু তাই নয়, এরপর সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার উপর কড়া দৃষ্টি রাখতে শুরু করে গোয়েন্দা বিভাগ। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ (১৯৩১) ‘লাল নিশান’ (১৯৩২) বই দুইটি প্রকাশিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করা হল। ততদিনে তিনি অবশ্য সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সংঘ ‘কমিন্টার্ন’ ত্যাগ করেছিলেন।
কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর (ফাইল ছবি)

লেখার পাশাপাশি তিনি নাৎসিবাদি হিটলারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জার্মানিতে তিনি “স্পেনসার” ছদ্মনাম নিয়ে নিজের কার্যক্রম চালাতে থাকেন। পরে হিটলার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে জার্মানিতে তিনি গ্রেফতার হন। বেশকিছু দিন মিউনিখ জেলে কারাবাস করার পর তাঁকে জার্মানি সরকার বের করে দেয়। তিনি আবার ভারতে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। যে লেখকের বই ভারতে ঢুকতে বাঁধা দিতে গলদঘর্ম হতো ব্রিটিশ সরকারের সেই লেখক নিজেই এখন এসে হাজির হলেন ভারতবর্ষে। এসেই কলম ধরলেন। সবগুলো বই-ই নিষিদ্ধ হলো। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘বন্দী’ এবং ‘চাষীর কথা’। কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়ের পর তাঁর লেখা বই-ই বেশি নিষিদ্ধ হয়েছে ভারতবর্ষে। এখন সবগুলোর কপিও পাওয়া যায়না। চট্টল বীর সূর্য সেন ও পাঞ্জাবের চন্দ্র শেখর আজাদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাঁদের নিয়েও রচনা ছিলো তাঁর। সেসবই নিষিদ্ধ।

ততদিনে বাংলা সহ সমগ্র ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন আরো অগ্রসর হয়েছে। কোলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই কবিগুরুর প্রত্যক্ষ অভিভাবকত্বে নেপু ঠাকুরের ঘরে স্থাপিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগ কেন্দ্র। সোভিয়েত হতে ঘুরে এসে রবীন্দ্রনাথ কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আবদুল হালিমের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ মদদপুষ্ট হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সোভিয়েত বিরোধী অপপ্রচারের জবাবে লিখলেন “রাশিয়ার চিঠি”। বইটিতে কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকলেও কমিউনিস্ট সংগ্রামের খুবই সহায়ক হয়েছিলো। নব নব চিন্তার যুবকেরা নিজ থেকেই পার্টিকে খুঁজে নিচ্ছিলেন। এর মধ্যেই বিদেশ হতে ফিরলেন কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুনরায় পার্টিতে যোগদান করার আগে সাংগঠনিক কাঠামো ও নানা মতাদর্শগত বিষয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁর সেই মতামত পার্টিতে গ্রহণ করা হয়নি। এতে করে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। পার্টি থেকে বারংবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি আর সাড়া দেননি। একপর্যায়ে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই ১৯৩৪ সালের ১লা আগস্ট একটি পার্টি গঠন করেন। নাম দেন “রেভ্যুলেশনারী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া”, সংক্ষেপে আরসিপিআই। তবে মূল পার্টি থেকে সেই পার্টিতে আর কেউ যোগদান করেছেন বলে জানা যায়নি।
১৯৪০ সালে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘ইম্পেরিয়ালিস্ট ওয়ার অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ নামক বইকে কেন্দ্র করে আবার আলোচনায় আসেন। সেই বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বিজনকুমার দত্ত, নাম দিয়েছিলেন ‘যুদ্ধবিরোধী কেন’। আর সুবীরকুমার দাশগুপ্ত ছিলেন প্রকাশক। তিনজনকেই ২৪ পরগনার অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মামলার মূল আসামী হিসেবে শাস্তির মেয়াদ ৬ মাস। অন্য দুজন, অর্থাৎ বিজনকুমার দত্ত এবং সুবীরকুমার দাশগুপ্তের শাস্তির মেয়াদ ৩ মাস। এছাড়াও প্রায় নানা সময়ে কমরেড সৌমেন ৮ বছর কারাবন্দী ছিলেন।
কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর – এর গঠিত নতুন পার্টির কাজে তাঁর পিতামহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। কমরেড আবদুল হালিমের সাথে আলাপরত সময়ে এই বিষয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে নতুন পার্টি অল্পদিনেই বিশ্ব পরিমন্ডলে পরিচিতি লাভ করে। প্রকৃত পক্ষে কমরেড এম এন রায়ের পর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পরিমন্ডলে কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর-ই উপমহাদেশীয় কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে বহুল পরিচিত ছিলেন। কিন্তু নিজ ভূমে পার্টিটা তেমন প্রসার পায়নি।
ভিন্ন পার্টি গঠন করেও কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সকল রকমের কার্যক্রম সমান তালে চালাতে থাকেন। তাঁর পার্টি প্রথমে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বললেও পরে পার্লামেন্টারী রাজনীতির পক্ষে মত দেয়। ৬০-৭০ দশকে কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার সাহিত্য জগতে প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলেন৷ তাঁর দল নানা নির্বাচনে জয় লাভ করে সরকারের অংশ হিসেবেও থেকেছে। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও গণচীনের রাষ্ট্রে শক্তিশালী হতে থাকা আমলাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিলেন। ৫০ দশকে তাঁর সোভিয়েত সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ৯০ দশকে এসে সঠিক প্রমাণিত হয়।
১৯৭৪ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর এই মহান বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলটি এখন নেতৃত্বহীন অবস্থায় খুবই দুর্বল। কিন্তু তাও টিকে আছে। তাঁর সকল সৃষ্টিকর্ম এখন আর সহজে পাওয়া যায়না। উপমহাদেশের মূলধারার কমিউনিস্ট – বামদলগুলো কমরেড এম এন রায়ের মতোই কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে চর্চা করতে অতটা আগ্রহী নয়। তবে এসবে উপমহাদেশের সমাজতান্ত্রিক জগতের দুই নক্ষত্রের তেমন কিছু গরিমা কমেনা। কিন্তু এতে করে হারিয়ে যেতে বসেছে ঠাকুরবাড়ির সাথে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সম্পৃক্ততার ইতিহাস। এই সুযোগে রবীন্দ্রনাথ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রাণান্তকর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনেকেই।
নিভৃতচারী মহান বিপ্লবী – প্রগতির পরিব্রাজক কমরেড সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর সংগ্রামী স্মৃতির প্রতি আনত শ্রদ্ধাঞ্জলী
লেখক,  যুব ও শিশু-কিশোর সংগঠক