মতামত

“ আনন্দময় পড়াশোনার” জন্য যা করণীয়

আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি শিক্ষানীতি জাতিকে উপহার দিয়েছে। ১৯৯৭ সালে সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. শামসুল হকের নেতৃত্বে, ২০০০ সালে শিক্ষামন্ত্রী এস কে সাদেকের নেতৃত্বে, তৎকালীন বিআইটি ঢাকা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ড. নজরুল ইসলাম, সদস্য ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদসহ মোট পাঁচজন সদস্য নিয়ে শিক্ষানীতি-২০০০, পরবর্তীতে ২০১০ সালের শিক্ষানীতি- যার নেতৃত্বে প্রথমে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। উল্লেখ্য যে, ২০০০ সালের শিক্ষানীতি সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই কণ্ঠ ভোটে পাশ হয়েছিল। শিক্ষানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যদি কণ্ঠ ভোটে পাশ হয়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ যা হবার তাই হয়েছে।

২০১০ সালের শিক্ষানীতি পাশ হবার আগেই ২০০৯ সালে কোনো শিক্ষানীতিতে, ‘পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা’ (Primary Education completion Examination) সংক্ষেপে পিইসিই বা ভুলভাবে পিএসসি’র কথা উচ্চারিত না থাকলেও কতিপয় আমলার কারসাজিতে তা চালু করা হয়েছিল। এই পিইসিই’র কুফল জাতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে– প্রশ্ন ফাঁস ও নকলের জোয়ারের মধ্য দিয়ে। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল, ‘চলতি বছর সমাপনী পরীক্ষায় ১২০০ ফল প্রার্থীর নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ’, ‘নম্বর জালিয়াতির কারণে শিক্ষা কর্মকর্তাকে শোকজ’, ‘ধারাবাহিক নম্বর জালিয়াতি’ ইত্যাদি খবর। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখের রিপোর্ট বলছে: ‘জেএসসি, জেডিসি ও পিইসি’র ফলাফলে হঠাৎ ছন্দপতন।’ অর্থাৎ এই পরীক্ষার কুফল– যেমন একদিকে অপরাধ প্রবণতার মধ্যে শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে ফেলা অন্যদিকে শিক্ষাজীবনকে অংকুরেই থামিয়ে দেওয়া। এই অকৃতকার্যতার আর একটি প্রধান উপাদান, পাঠ্য বিষয় ইংরেজি। যেহেতু বেশিরভাগ স্কুলে যোগ্য ইংরেজির শিক্ষক নেই; তাই ইংরেজির কারণে শিক্ষাজীবন থামিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। তারপরও কথা আছে, উন্নত দেশসমূহে প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষা ছাড়া দ্বিতীয় ভাষা শেখানো হয় না। অথচ দ্বিতীয় ভাষার কারণে ঐসব শিশুরা ঝরে পড়ছে অবলীলাক্রমে। যতদিন তারা স্কুলে থাকতো ততদিন তারা নানা বিষয়ে কিছু জ্ঞান অর্জন করতে তো পারতো।

এখন শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব অবস্থাটি কি–তা জানার জন্য আমরা পত্রপত্রিকার কিছু শিরোনামের দিকে লক্ষ করতে পারি।

১ এপ্রিল ২০১৮ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর- ‘পাঁচ বছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একজনও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়নি– ২১ হাজার বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই।’ ৮ এপ্রিল ২০১৮ তে প্রকাশিত আর একটি খবর- ‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সরকারি হাই স্কুল : প্রতিষ্ঠান ৩৪০, শিক্ষকের পদ শূন্য ২, ৮৭৫টি।’ ৩ এপ্রিল ২০১৮ তারিখের খবর বলছে– ‘প্রথম দিনে অনুপস্থিত ১৩ হাজার ৭১৮ পরীক্ষার্থী। বহিষ্কার ৮৬।’ ‘দশ বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ জন শিক্ষার্থী। প্রথম দিনের পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ১৩ হাজার ৭১৮ জন পরীক্ষার্থী। অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার করা হয় ৭৯ জন শিক্ষার্থী ও ৭ জন শিক্ষককে।’

এমন হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে শিক্ষাব্যবস্থার অব্যবস্থা বুঝবার জন্য এই সামান্য কটি উদাহরণই যথেষ্ট। এখন গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে যা তুলে ধরেন, তার মর্মকথা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক । পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে– ‘যা কিছু নতুন’– শিরোনামে এক পত্রিকা পয়েন্ট আকারে বলছে- ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চালু হবে নতুন পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে না কোনো পরীক্ষা। * পিইসিই ও জেএসসি বাদ * এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসে * নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাজন থাকছে না * একাদশ ও দ্বাদশে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে।

শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন ‘সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা উপস্থাপন করা হলে তা তিনি অনুমোদন করেন’। ২০২৫ সাল থেকে এই শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য আগামী বছর থেকে কাজ শুরু হবে। আগামী বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং শুরু হবে। ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।’

পিইসিই ও জেএসসি পরীক্ষা সম্পর্কে বলেন, ‘অষ্টম ও প্রাথমিকে পাবলিক পরীক্ষার কথা বলিনি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না এবং প্রতিটিতে সমাপনী পরীক্ষা হবে। সনদ দেওয়ার জন্য পাবলিক পরীক্ষার দরকার নেই। পিইসিই এখনও ক্লাস সমাপনী পরীক্ষা। জেএসসি পাবলিক পরীক্ষা, বছর শেষে প্রতি ক্লাসে মূল্যায়ন হবে। দশম, একাদশ ও দ্বাদশে পাবলিক পরীক্ষার কথা বলেছি, এইচএসসি’র পরীক্ষার রেজাল্ট হবে একাদশ ও দ্বাদশ মিলিয়ে।’

কথার মধ্যে কন্ট্রাডিকসন পাঠক লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই। সে জন্য যে যার মতো করে ব্যাখ্যা করছেন।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন- নতুন শিক্ষাক্রমের বৈশিষ্ট্য হবে, ‘শিশুর জন্য আনন্দময় পড়াশুনা।’ সে কথা তো সবাই বলেন এবং মনেপ্রাণে কামনা করেন। কিন্তু বাস্তবে কি তা ঘটে।

একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং অন্যান্যদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি ‘বিজ্ঞানভিত্তিক একমুখী শিক্ষা’ হঠাৎ বাতিল করে, বহুমুখী নীতি প্রবর্তন করা হলো এবং ৬০০ পৃষ্ঠার বই ৩ মাসে সম্পাদন করে প্রকাশের পর দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠল।

বিজ্ঞানের বই রচিত হয়েছিল ‘এসো নিজে করি’ দিয়ে। প্রথমে শুনে মনে হবে, ভালোই তো- শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে কাজ করে শিখবে। কিন্তু সব শুভ উদ্যোগ তো প্রথমেই নস্যাৎ হয়ে যায়, যোগ্য শিক্ষক, সহজবোধ্য বই এবং ব্যবহারিক ক্লাসের অভাব যদি ঘটে। তা-ই ঘটেছিল। সেই বইগুলো রচিত হয়েছিল প্রথমে ইংরেজিতে। বিদেশিরা দেখার পর তা আবার বাংলায় করা হয়েছিল–কথাগুলো বলেছিলেন তৎকালীন সচিব ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। আর ‘এসো নিজে করি’র মধ্যে কোনো সমাধান দেওয়া হতো না। ব্যাখ্যা বা বর্ণনা বা ক্লু কোথাও থাকত না। তাহলে শিক্ষার্থীরা জানবে কিভাবে?

এইসব প্রশ্নের উত্তরের চাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে- বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান যেনতেন একটি প্রকল্প তৈরি করে বিরাট অংকের ঋণ দিতে চেয়েছে; আর অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঐ প্রকল্প গ্রহণ করেছে কর্তাব্যক্তিরা। তাই, এতে লাভের চাইতে ক্ষতি হয়েছে বেশি। ঠিক একইভাবে বিশ্বব্যাংকের বুদ্ধিতে জোরপূর্বক শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া ছাড়া হাজারও প্রশংসা গেয়ে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে চালু করা হয়েছিল পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি। সৃজনশীল পদ্ধতি যে সৃজনশীল না, এ বিষয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন যাই করুক না কেন, সৃজনশীলতার ৪নং অংশে পাতা ভরে সারাংশ লিখে দেওয়ার বুদ্ধি শিক্ষকরাই দিয়ে দিতেন। পরীক্ষকদেরও নির্দেশ দেওয়া হতো শিক্ষার্থীকে মার্কস দিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ২০১৫ সালে বাঁধ সাধলো এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা, সে বছর এসএসসি-তে গণিতের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র। কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন ঐ শিক্ষক স্বল্পতার কথা এবং সৃজনশীল পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষকদের পরিচিত না করানোর কথা। আবার সব শিক্ষকের ধারণ ক্ষমতা এক না। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহী করে তুলতে সব রকম ব্যবস্থাপনাই দরকার। সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর সময় বলা হয়েছিল; প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও যোগ্য একদল শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাবে, কিন্তু সেটা হয়নি। সৃজনশীল পদ্ধতির ১০ বছর পার হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী অর্ধেকেরও বেশি এখনো ‘সৃজনশীল’ ঠিকমত বোঝেন না। দশ বছরেও অর্ধেক শিক্ষককে ট্রেনিংয়ের আওতায় আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আর এখন তারা স্বপ্ন দেখছেন ‘আনন্দময় পড়াশোনা’। পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি থেকে শিক্ষাকে বের করে এনে পরীক্ষার পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে ‘দক্ষতাভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ চালু করার কথা। সেখানে প্রতি বিষয়ে পূর্ণমান ১০০ নম্বর থাকলেও চূড়ান্ত পরীক্ষার বিষয় ও শ্রেণিভেদে ৪০ থেকে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হবে। আর বাকি নম্বরের শিখন মূল্যায়ন করবেন শ্রেণি শিক্ষকরা। নতুন এ পদ্ধতি চালুর জন্য খোলনলচে বদলে ফেলা হবে বিদ্যমান শিক্ষাক্রমে– ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখানেই মন্তব্য করতে চাই– ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ ১০ বছরেও শিক্ষকদের আত্মস্থ হয়নি। আর ‘আনন্দময় পড়াশুনার’ জন্য এই মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাতে শিক্ষকরা এত অল্প সময়ে ২০২৩ সাল থেকে বাস্তবায়নে কিভাবে দক্ষ হয়ে উঠবেন, এও কি সম্ভব? প্রশ্ন উঠতে পারে, এটা কত কোটি টাকার প্রজেক্ট? এই নতুন প্রজেক্টের ফলে, সৃজনশীল প্রশ্ন-পদ্ধতি চালুর জন্য খরচ হওয়া ৮০০ কোটি টাকা পানিতে যাবে। অতীত অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। –এটাই তো বাস্তবতা।

২০০৪ সালে নেয়া হয়েছিল একমুখী শিক্ষাক্রম। তার মূল্য ছিল পাঁচশত কোটি টাকা। ২১ শে নভেম্বর ২০০৫ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল ঐ একমুখী শিক্ষার জন্য কনসালটেন্টদের ফি বাবদ খরচ ৩৬ কোটি টাকা, ২৬৭ জন শিক্ষা কর্মকর্তার অস্ট্রেলিয়াসহ ৪টি দেশের একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সরজমিন দেখা বাবদ খরচ হয়েছিল ৩২ কোটি টাকা। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বাথরুম ও নলকূপ বাবদ খরচ ১৩৩ কোটি টাকা। ছাত্রী উপবৃত্তির নামে ১৮০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আসবাবপত্র ও যানবাহন খরচ ২২ কোটি টাকা। কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হয়েছে ৫৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদন তৈরি, শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন ও কর্মী খাতে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে ১৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে ২১ কোটি টাকা। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্প থেকে সার্ভিস চার্জ পাবে ১২ কোটি টাকা। এই ঋণের টাকা বাংলাদেশের কোনো উপকার আসুক বা না আসুক; ঋণ দাতাদের একদিকে সুদ হিসেবে লাভ, আবার সার্ভিস চার্জ হিসেবেও লাভ হয়েছে। আর এই টাকা খরচ করতে পারলেই সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, মন্ত্রীদের দারুণ শান্তি। সবাই শতকরার হিসেবে তা পান। তাই উপর থেকে মাঝেমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয় টাকা খরচের। টাকা খরচ না হয়ে চলে গেলে ডিসক্রেডিট হয় কর্মকর্তারা । তাই যেনতেন প্রকারে তা খরচ হয়। এদেশের মেহনতি মানুষের রক্ত নিংড়ানো উপার্জন এভাবেই লুটপাট হয় কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা।

আর তাইতো যেখানে লুটপাট করার সুযোগ নাই সেখানে কাজ হয় না। এবার আমরা সামান্য কিছু দিকে যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখা যাবে ২৬ এপ্রিল ২০১৮ তারিখের দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে ‘শিক্ষক সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সরকারি হাই স্কুল ও কলেজের পাঠদান’। ‘সরকারি হাই স্কুল ও কলেজে আট হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য’। ‘দেশের ৩৩৩টি সরকারি ও ৩২৯টি কলেজে মোট আট হাজারের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য। এর মধ্যে হাই স্কুলে ৩ হাজার ও কলেজে পাঁচ হাজার’। ২০ জুন ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে ‘নীতিমালার বেড়াজালে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’। ২৮ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল– ‘এনটিআরসি’র নিয়োগ বন্ধ’। বরিশাল বিভাগে সহকারী শিক্ষক পদ শূন্য দেড় সহস্রাধিক’।’ ‘মদনমোহন সরকারি ডিগ্রি কলেজে ৪৪ শিক্ষকের পদ শূন্য, লেখাপড়া ব্যাহত; ক্ষুব্ধ পাঁচ লাখ শিক্ষক কর্মচারী’। ‘ মাউশির আঞ্চলিক অফিস মানেই ঘুষের হাট’। ‘পেনশনের টাকা মিলবে কবে- পরিত্যক্ত ভবনে মৃত্যুঝুঁকিতে চলছে চার বছর ধরে পাঠদান’। ‘এমপিও’র জন্য দরকার আরো ১৩শ কোটি টাকা’ : অবর্ণনীয় কষ্টে শিক্ষকরা’ – এমন হাজার হাজার খবর যা শিক্ষাব্যবস্থার জরাজীর্ণ করুণ চেহারাই মেলে ধরে সমাজের কাছে।

১৯৮৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষায় নানা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু সফল হলো না কেন? কি করলে হবে? সহজ কথায় বলা যায়– শিক্ষকের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দিতে হবে এবং দিতে হবে সর্বোচ্চ সম্মান। তাহলে মেধাবীরা এই পেশায় আসবেন। ক্লাসে শিক্ষক ছাত্রের অনুপাত ১ ঃ ২০ হতে হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য এবং ১ ঃ ৩০ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। এলাকার শিশুরা এলাকায় পড়বে। প্রত্যেকটি স্কুলকে সমান সুযোগ দিতে হবে। আকর্ষণীয় করতে হবে। প্রকল্পের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন না। কারণ, যার মধ্য দিয়ে প্রথমে আসে গাড়ি- যা রাস্তায় বাড়ায় যানজট, পরিবেশের করে ক্ষতি। শুধু শিক্ষকের সম্মানজনক বেতন তো না, দিতে হবে সব পেশার সব মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। সমাজের সবার কথা -যেমন কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, শ্রমিকের ভালোভাবে বেঁচে থাকার মজুরি । শুধু আমলা-মন্ত্রী-এমপি ও ধনীকদের কথা ভাবলে সমাজে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার কোনো কিছুই কমবে না।

‘আনন্দময় লেখাপড়ার’ সুযোগ সৃষ্টি করতে চাইলে শিক্ষাব্যবস্থাসহ সমাজের সকল ব্যবস্থার কথাই ভাবতে হবে। নইলে ১৯৮৩ সালের ‘এসো নিজে করি’ তথাকথিত ‘একমুখী শিক্ষা’ ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’র যে-দশা হয়েছে– সে দশাই হবে। চটকদার সুন্দর আদর্শবাদী কথা জনগণ কিছুদিন শুনবে, এমপি-মন্ত্রী-আমলাদের পকেট ভরবে– রাস্তায় এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকরা অনশন করতেই থাকবে। আর শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়ার মান যা আছে তাই থাকবে বা আরও নিম্নগামী হবে।

লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক একতা