বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা

-বিজন সাহা

(১১)

একবার মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে নববর্ষের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের নববর্ষ পালনের উপর একটা প্রবন্ধ পড়া হয়। সেখান থেকেই আমার মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জন্ম নেয়। প্রথমত কেন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় নববর্ষ পালন করা হয়? দ্বিতীয়ত কেন ইসলামে চান্দ্র বর্ষ প্রাধান্য পায়। তবে এসব বলার আগে আমরা বর্ষ বা পঞ্জিকা নিয়ে কিছু কথা বলব।

অন্য প্রাণীদের কথা বলতে পারব না, তবে মানুষ সব সময়ই ছিল জানার জন্য উৎসুক। নিজের অস্তিত্বের জন্যই তাকে বিভিন্ন বিষয়ে উৎসাহী হতে হয়েছে। অবশ্য প্রাণীদের উপর বিভিন্ন ডকুমেন্টারি মুভি দেখে অথবা গৃহপালিত বিভিন্ন পশুকে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা তাদের অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার প্রতি আগ্রহের প্রমাণ পাই। বিশ্বাস হয় না? ছোট্ট বিড়াল বা কুকুরকে উলের গোলা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। মানুষ তার শারীরিক গঠনের কারণেই অন্যান্য প্রানীর থেকে অনেক অসহায়। চারপেয়ে প্রানী যত স্থিতিশীল, দু পা নিয়ে মানুষ ততটা স্থিতিশীল নয়। আবার অন্যান্য প্রায় দু’পেয়ে প্রাণী যেমন বানর বা শিম্পাঞ্জীর মত সে ততটা ক্ষিপ্র নয়। তাই সেই আদিম যুগে গহীন অরণ্যে বিভিন্ন হিংস্র প্রাণীর মধ্যে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে ব্যবহার করতে হয়েছে মস্তিষ্ক, জানতে হয়েছে প্রকৃতিকে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি করতে হয়েছে যাকে বলে রণনীতি, রণকৌশল।

তার এই সংগ্রামে সে সাথী করেছে আকাশের চাঁদ, তারা আর সূর্যকে। কেন? অনেক উপরে বলে তারা দৃশ্যমান। তাই বলা চলে ঐতিহাসিক ভাবেই নক্ষত্র ছিল মানব সভ্যতার অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নক্ষত্র ছিল নাবিকদের জন্য পথ প্রদর্শক। ঋতু নির্ণয়েও তারাদের ভুমিকা ছিল অগ্রণী। পুরাকালে অধিকাংশ জ্যোতির্বিদদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তারারা অনেক দুরের এক স্বর্গীয় গোলকে আটকানো আছে এবং তাদের অবস্থান অপরিবর্তনীয়। নিজেদের কাজের সুবিধার্থে জ্যোতির্বিদগণ তারাদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করতেন। এই গ্রুপগুলোকে বলা হত তারামণ্ডল বা নক্ষত্রমণ্ডল। এই নক্ষত্রমণ্ডলের সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান ও গতিবিধির উপর ভিত্তি করে রচিত হত পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার যার মাধ্যমে কৃষিকার্য নিয়ন্ত্রণ করা হত। পরবর্তী কালে যখন ধর্মের আবির্ভাব ঘটে তখন নক্ষত্র ধর্মীয় আচার আচরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে শুরু করে।

মানুষ সেই আদি যুগ থেকেই বিশেষ করে সূর্য ও চাঁদের গতিবিধি দেখে সময় সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছে। দিনের পর রাত আর রাতের পর দিন তাকে আভাস দিয়েছে যে সব কিছুই একেবারে শেষ হয়ে যায় না, ফিরে আসে। যেহেতু অবস্থানের কারণে পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদের গতিবিধি সহজেই অনুমেয় তাই মনে হয় প্রথমে পক্ষ বা মাস গননা শুরু হয়েছিল চাঁদকে দিয়েই। পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত যে চক্র সেটা দিনের পর রাত আর রাতের পর দিনের মতই তাকে আবার শিক্ষা দেয় ঘটনার পুনরাবৃত্তির। তারপর এক সময় সে দেখে ঋতু পরিবর্তন, নতুন করে শীত বা বসন্ত আসা। আর এসব দেখে দেখেই সে তৈরি করে পঞ্জিকা। বিশেষ করে সে যখন কৃষিকাজ শুরু করে তখন এই পঞ্জিকা হয় তার জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। হয়তো ঘটনার এই পুনরাবৃত্তি থেকেই তার ধারণা হয়েছে পুনর্জন্মের।

মানুষ চাঁদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রেখে এক সময় পঞ্জিকা তৈরি করল সেটা তাকে সময় সম্পর্কে, জোয়ারভাটা সম্পর্কে ধারণা দিল। কিন্তু দেখা গেল ফসল ফলানোর জন্য চাঁদের উপর নির্ভরশীল পঞ্জিকা ঠিক কাজ করছে না। কারণ ফসলের জন্য মানুষ ঋতুর উপর নির্ভরশীল আর সেটা পৃথিবী ও সূর্যের পারস্পরিক গতিবিধির উপর নির্ভর করে। এ ব্যাপারে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের এক ঘটনা বলা যায়। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে সৌর পঞ্জিকা চালু ছিল। বাংলা বাদেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় যে পঞ্জিকা সেটা সূর্যের সাথেই জড়িত যদিও অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠান হত চান্দ্র পঞ্জিকার হিসেবে। ভারতে মুসলিম শাসনের সাথে আসে হিজরি ক্যালেন্ডার। কিন্তু সম্রাট আকবর বুঝতে পারেন যে কৃষিপ্রধান দেশে হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী খাজনা আদায় করলে প্রজাদের সমস্যা হয়, কেন না তারা খাজনা দিতে পারে ফসল ঘরে তোলার পর। আর ফসলের সব কিছুই জড়িত ঋতু ও সৌর ক্যালেন্ডারের সাথে। ফলে তিনি হিজরি সালের শুরুকে স্টারটিং পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে এক সৌর ক্যালেন্ডার তৈরি করেন যা প্রথম ৯০০ বছর চান্দ্র বছর হিসেবেই চলেছে আর ৯০০ হিজরি সাল, মানে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে হিজরি ক্যালেন্ডার চাঁদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চললেও আকবর প্রণীত ক্যালেন্ডার চলে সূর্যের তালে তালে। আজ আমরা যে বাংলা ক্যালেন্ডারের কথা বলি সেটাই সম্রাট আকবর রচিত সেই ক্যালেন্ডার।

তবে এটা তো গেল সেদিনের কথা। প্রাচীন যুগে বিভিন্ন সভ্যতায়ই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার ছিল। ব্যাবিলন, অ্যাসিরিয়া, মিশর সহ বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যাতায় ক্যালেন্ডারের ব্যবহার দেখা যায়। তা দেখা যায় ভারতীয় ও চৈনিক সভ্যতায়। রোমান সাম্রাজ্যে তো ক্যালেন্ডারের ব্যবহার রীতিমত ছিল। জুলাই আর আগস্ট মাসের নামকরণ হয় রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার ও অগাস্টাসের নামানুসারে। খেয়াল করলে দেখব শেষের কতগুলো মাস সংখ্যার সাথে জড়িত। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর আসলে সাত, আট, নয়, দশ। এ থেকে বোঝা যায় সে সময় বছর শুরু হত মার্চ মাস থেকে। আমরা জানি বছরে  চারটি বিশেষ দিন আছে। বসন্ত (২১ – ২৩ মার্চ) ও শরত (২১ – ২৩ সেপ্টেম্বর) একুইনক্স যখন সারাবিশ্বে দিন ও রাত সমান মানে ১২ ঘণ্টা করে হয়। আরও আছে গ্রীষ্ম (২১ – ২৩ জুন) ও শীত (২১ – ২৩ ডিসেম্বর) সলিস্তিস যখন উত্তর গোলার্ধে যথাক্রমে দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ হয়। দক্ষিণ গোলার্ধের ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টোটা। তাই অনেক আগে কোন কোন দেশে বছরের শুরু হত ২১ মার্চ। তবে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রের গতিবিধির উপর নজর রাখা হত যতটা না কৃষি কাজের জন্য তার চেয়ে বেশি তাদের দেবতাদের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকার জন্য। মিশরে এটা বিশেষ উন্নতি লাভ করে। তাদের বিশেষ ক্যালকুলেশনের পরিণতিতে দিন ও রাতকে সমান বারোটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। আজকে আমরা যে ২৪ ঘণ্টার দিনরাতের ধারণা ব্যবহার করি সেটার জন্ম প্রাচীন মিশরেই। উল্লেখ্য যে প্রাচীন ভারতে দিনরাতকে ৮ ভাগে বিভক্ত করা হত। প্রতিটি ভাগকে বলা হত প্রহর। আর একটি দিনের ব্যাপ্তি ছিল অষ্টপ্রহর। প্রাচীন মিশরেই চান্দ্র আর সৌর পঞ্জিকার বিকাশ ঘটে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ক্যালেন্ডার সূর্য ও চন্দ্রের গতিবিধির উপর ভিত্তি করে করা হলেও শুধুমাত্র ইসলামিক ক্যালেন্ডার চান্দ্র। কেন? আমার মনে হয় এটা পুরোপুরি আরব দেশের আবহাওয়ার সাথে জড়িত। ধর্মীয় আচার আচরণ পালনের সাথে সাথে ক্যালেন্ডারের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল কৃষিকার্যে সাহায্য করা। কারণ এক সময় পৃথিবী ছিল কৃষি প্রধান আর রাজকোষের ভালোমন্দ এর সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। কিন্তু মরুভূমির কারণে আরব দেশে চাষাবাদ হত না। আরবেরা ছিল যাযাবর বা ব্যবসায়ী। আর এসবের জন্যে তাদের কাফেলা নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হত। দিনের বেলায় মরুতে প্রচণ্ড গরম বলে রাতই ছিল এসব যাত্রার জন্য উপযোগী সময়, তাই চাঁদই ছিল তাদের আলোর উৎস, পথের দিশারী। হয়তো এ কারণেই প্রাক ইসলামী যুগ থেকেই সেখানে চান্দ্র পঞ্জিকা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মনে হয় আরবের মরুভূমিতে রাত মানে চাঁদ ও তারার এই বিশেষ ভূমিকার কারণেই ইসলামের পাতাকায় চাঁদ তারা শোভা পায়। ঠিক একই কারণে সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন এলাকার মানুষের লোককথা ভিন্ন। কিন্তু স্বাভাবিক বুদ্ধি বলে যেহেতু কী পৌরাণিক কাহিনী, কী বৈজ্ঞানিক গবেষণা – সবার উদ্দেশ্য একই বাস্তবতা বর্ণনা করা, সেটা আর যাই হোক এলাকা ভিত্তিক হওয়া উচিত নয়। সে মতবাদ বা থিওরি এমন হওয়া চাই যা কিনা জাতি, ধর্ম, দেশ, কাল নির্বিশেষে সবার জন্যই সত্য হয়। আর একমাত্র বিজ্ঞানই পারে সর্বজন ও সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য কোন তত্ত্ব দিতে যা কোন ডগমা বা অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হবে না, বরং নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো গ্রহণ করবে। তাই জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানাটা খুব জরুরী।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া