বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা

-বিজন সাহা

(১০)

কিছুদিন আগে বলেছিলাম যে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো ইউনিভার্সাল বা সর্বজনীন। যদিও ইনিশিয়াল ও বাউন্ডারি ভ্যালুর উপর নির্ভর করে এসব সমীকরণের বিভিন্ন সমাধান হতে পারে, তবে এতে করে তত্ত্বের সার্বজনীনতা ক্ষুণ্ণ হয় না। পদার্থবিদ্যার সূত্র মানেই প্রকৃতির নিয়ম। তাই বলা যায় যে প্রকৃতি সার্বজনীনতায় বিশ্বাস করে।  আর যেহেতু মানুষ প্রকৃতির অংশ তাই মানুষের তৈরি সেই আইনগুলোই সত্যিকার অর্থে মঙ্গল বয়ে আনে যা প্রকৃতির নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রকৃতিকে দেখে, প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ বাঁচার জন্য বিভিন্ন আইন তৈরি করেছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে শুধু মানুষই নয়, বিভিন্ন প্রানীও বিভিন্ন রকমের আইন মেনে চলে। আর তারা এটা করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। এটাও তারা করে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়েই। প্রাণী জগতের জীবনযাপনের উপর তৈরি বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখে আমরা এসব সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারি।

এক সময়, যখন রাষ্ট্র ছিল না, আর রাজার শাসন বলতে ছিল শুধু কর আদায় আর শাস্তি দেওয়া, তখনও কিন্তু মানুষ নিজেদের উদ্যোগেই বিভিন্ন আইন তৈরি করেছে। আসলে দু জন মানুষও যখন এক সাথে চলতে চায় তারা কিছু নিয়ম মেনে চলে, মেনে চলতে হয়। সবাই যদি যে যার মত চলে তাহলে সেটা এক সাথে চলা হয় না, একা একা চলা হয়। এই যে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পেশায় কাজ করে সেটাও এক সামাজিক চুক্তি। ধরুন একটা দ্বীপ রাষ্ট্র। যদি সেখানে সবাই ডাক্তার হতে চায় কে ফসল ফলাবে, কে চুল কাটবে, কে ঘর বানাবে, কে ছাত্রদের পড়াবে? যেহেতু আমাদের জীবনে অনেক কিছুই দরকার এবং সবাই সব কিছু পারে না বা সবাই সব কিছু ভাল পারে না বা শুধু সময়ের অভাবেই সবাই সব কিছু করতে পারবে না, সেক্ষেত্রে একটা মতৈক্যে পৌঁছুতেই হবে আর কাজ ভাগাভাগি করে দিতে হবে। এভাবেই পরবর্তীতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ইনস্টিটিউশন। গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র। তবে কথাটা হল যেহেতু সমাজের বা দেশের সবাই এই চুক্তি দ্বারা পরস্পরের সাথে আবদ্ধ, স্বাভাবিক ভাবেই সেই চুক্তি, যেটা আসলে আইন, সবার ক্ষেত্রেই সমান ভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। ছোট কালেক্টিভে কোন কাজে সবার সম্মতির কথা ভাবা যেতে পারে, কিন্তু বড় কালেক্টিভে সেটা সম্ভব নয়। কেননা সব সময়ই কারও না কারও দ্বিমত থাকবেই, ফলে কোন দিনই কোন সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। আর সে কারণেই সংখ্যা গরিষ্ঠের মত নিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সবার জন্যই প্রযোজ্য আর এখান থেকেই আসে সবার জন্য আইনের সমান প্রয়োগের কথা। এটা যেকোনো কালেক্টিভের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। যখনই কোন কালেক্টিভ বা দেশ এই সত্য থেকে সরে দাঁড়ায় সেটা তাৎক্ষনিক ভাবে সরকার বা প্রশাসনকে বিশেষ কোন সুযোগ সুবিধা দিলেও সিস্টেমে যে ক্ষতের সৃষ্টি করে সেটা দীর্ঘকালীন। এটা সিস্টেমের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে, পরিণামে সিস্টেমকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এর ফলে কোন কালেক্টিভ বা সিস্টেম ফিজিক্যালি যেমন ধ্বংস হতে পারে (যেমন হয়েছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে), তেমনি কোন কালেক্টিভ তার চরিত্র বদলিয়ে ভিন্ন সত্ত্বায় পরিণত হতে পারে (যেমন হয়েছে ভারত আর বাংলাদেশ মৌলবাদের উত্থানের কারণে)।

তাই আজ যখন আমাদের দেশে কোন ঝুমন দাশ, কোন পরীমনি সিলেক্টিভ আইনের শিকার হয় আমদের এ নিয়ে ভাবা দরকার। আমাদের প্রতিবাদ করা দরকার যখন ব্লগার, সংখ্যালঘু, নাস্তিক বা অন্য কেউ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নামে অন্যায় অভিযোগের শিকার হয়। এটা শুধু মানবিক কারণেই নয়, এটা করা দরকার জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য। তবে এসব করতে গিয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এখানে বর্তমানের ঘটনা একটু বিস্তারিত বলা দরকার।

ফেসবুক ভরে গেছে পরীমনির পক্ষের আর বিপক্ষের মানুষের কথায়। পরীমনিকে চিনি না, তার নাম আগে কোন দিনই শুনি নি। তাই কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা – সেটা নির্ধারণ করা সত্যিই কঠিন। আর তার কারণ আজকে প্রায় সবাই সামান্য লাভের জন্য, লাইম লাইটে আসার জন্য সত্য মিথ্যা সব ধরণের কথা বলতে, মামলা করতে সদা প্রস্তুত। সমস্যা কি পরীমনিকে নিয়ে? মানে এই সে সবাই পরীমনির পক্ষে বা বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছে – সেটা কী পরিমনির জন্য? তার আগে প্রশ্ন করুন কেন এরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়। কেন গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ মেয়ে পরীমনি হয় সে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাজার হাজার গল্প উপন্যাস লেখা আছে। তাই এ নিয়ে বলা শুধু কাগজের অপচয়। এমন কি কেন এই অবস্থার তৈরি হয় সেটাও সবার জানা। হ্যাঁ, দেশে আইনের অপপ্রয়োগ। সেটা ঝুমন দাশের ক্ষেত্রেই হোক, পরীমনির ক্ষেত্রেই হোক আর অন্য কারও ক্ষেত্রেই হোক। আইনের দেবীর চোখ থেকে অনেক আগেই পর্দা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাই তিনি আজ সবাইকে সমান চোখে দেখেন না (আসলে সমান ভাবে সবার উপস্থিতি এড়িয়ে যান না) – কাউকে কাউকে বিশেষ ভাবে দেখেন। এই সিলেক্টিভ বিচার ব্যবস্থা পরীমনির জন্য নয়, দেশের জন্য ক্ষতিকর আর তার মানে আমার, আপনার, তার, তাদের সবার জন্য ক্ষতিকর। ভাবছেন একদিন আপন পর হবে আর তখন খুব কষে তাদের পেছনে বেত্রাঘাত করা যাবে। তবে সেটা কোন সমাধান নয়, দুর্বল মানুষের মানসিক হস্ত মৈথুন। তবে এই যে হাইপ, এই যে পক্ষে বিপক্ষে হাজার লেখালেখি সেটা কিন্তু পরীমনির জন্য নয়, তাকে নিয়ে প্রায় কেউ ভাবছে না, ভাব ধরছে আর তার ঘাড়ে ভর করে নিজেরা জনপ্রিয়তা লাভ করার চেষ্টা করছে। এখানে পক্ষ বিপক্ষ নেই, সবাই নিজের পক্ষে, এই সুযোগে হরিলুটের বাতাসা কতটা কুড়িয়ে নেওয়া যায় সেই চিন্তায় ব্যস্ত। সত্যের, আইনের শাসনের জন্য লড়াই হলে পরীমনির সাথে সাথে ঝুমন দাশ আর নিরীহ দেবতারাও স্পটে আসত। যদি বার বার পরীমনি নাটক দেখতে না চান আইনের শাসনের জন্য লড়াই করুন। কারণ এই নাটকে হারলে বা জিতলে হারবে বা জিতবে শুধুই পরীমনি আর ফলাফল যাই হোক ন কেন – দেশ হারবে সব অবস্থায়ই। তাই এসব ব্যাপারে আমাদের কথা বলা দরকার। তবে সেটা করতে হবে যুক্তি দিয়ে, আবেগ অবশ্যই থাকবে তবে সেটা যেন যুক্তিকে হার না মানায়। সেটাও পরীমনিকে দিয়েই ব্যাখ্যা করব।

সেদিন দেখলাম অনেকেই নিজেদের “রাতের রানী” হিসেবে ঘোষণা করছেন। ব্যাপারটা বেশ চোখে লাগল। কেন? যদি ভুল না করি এর শুরু মনে হয় ষাটের দশকে যখন জন কেনেডি নিজেকে বার্লিনার বলে ঘোষণা দেন। এরপর ১৯৯৯ বেলগ্রেড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোর বোমা হামলার শিকার হলে অনেকেই নিজেকে আমি বেলগ্রেড বলে ঘোষণা দেন। এরপর আসে শারলি। ইদানীং যেকোনো ধরণের সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রতিবাদে যারা সন্ত্রাসের শিকার তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে এটা বলা হয়। সেক্ষেত্রে যারা পরীমনির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে চান, তার পাশে দাঁড়াতে চান তারা যদি “আমি পরীমনি” লিখতেন সেটা অনেক বেশি যৌক্তিক হত। পরীমনিকে রাতের রানী উপাধি কিন্তু তার শত্রু পক্ষ দিয়েছে। এটা তারা করেছে পরীমনিকে হেয় করতে। সমাজের চোখে পরীমনির নেগেটিভ ইমেজ তৈরি করতে। তাই নিজেকে “রাতের রানী” ঘোষণা দিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো হয় নাকি তার শত্রুদের অভিযোগের ভিত্তিকে শক্তিশালী করা হয় সেটা ভেবে দেখা দরকার।

আবার সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে আমরা মনে হয় আবেগের কাছে যুক্তি বিসর্জন দিচ্ছি। যেমন বিভিন্ন পোস্টারে দেখছি –

পরীমনির মুক্তি চাই। পরীমনির জন্য ন্যায় বিচার চাই।

আমার মনে হয় একই পোস্টারে দুটো বাক্য সাংঘর্ষিক। আমরা অবশ্যই পরীমনির জন্য ন্যায় বিচার চাইব। আমাদের বিশ্বাস ন্যায় বিচারে তিনি মুক্তি পাবেন।

তবে সরকার যেমন তার আসামী নির্বাচনে সিলেক্টিভ আমরাও যদি সেভাবে আমাদের সমর্থন প্রকাশে সিলেক্টিভ হই, তা না আমরা, না দেশ কেউই থাকবে না। তাই আমরা যদি শুধু নারী বলে নারীবাদী বা নারীবাদ বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরীমনির, সংখ্যালঘু বলে ঝুমন দাশের পক্ষে বা বিপক্ষে বলি তাহলে ব্যক্তি পরীমনি বা ঝুমন দাশের লাভ বা ক্ষতি হলেও দেশের লাভ হবে না। দেশ ব্যাধিমুক্ত হবে তখন যখন বিচার ব্যবস্থা হবে অবজেক্টিভ। তাই পরীমনি আর ঝুমন দাশের ন্যায় বিচারের পাশাপাশি আমাদের দাবি হবে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া