বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

(৮)

গত ১৫ আগস্ট ২০২১ ভারত পালন করল স্বাধীনতার ৭৫ তম জয়ন্তী। বাংলাদেশ এ দিনই পালন করল জাতীয় শোক দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭ তম মৃত্যু বার্ষিকী। এই একই দিন আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় – তালিবান কাবুল প্রায় দখল করে সে দেশের উপর তাদের একক কর্তৃত্ব কায়েম করল।

১৬ আগস্ট বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল কাবুল বিমানবন্দরে পলায়নপর গণতন্ত্রকে। তারা আরও দেখল কীভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ গণতন্ত্রের স্বর্গগামী বিমান থেকে ঝরা পাতার মত পড়ে মারা যাচ্ছে আফগানিস্তানের মাটিতে। এভাবেই কি আফগান গণতন্ত্রের বা আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার কবর রচিত হল? তবে এটা হতে পারে আমাদের ভুল ধারণা, কেননা ইতিমধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন তারা আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাননি, গিয়েছিলেন সন্ত্রাসবাদীদের দমন করতে। কিন্তু সেই মিশনই কতটুকু সফল সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ।

১৯৭৯ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে তখন অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল বিশ্ব জুড়ে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আর দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের সমর্থক কমিউনিস্ট পার্টিগুলো অবশ্য এটাকে সমর্থন করেছিল। তবে আফগান জনগণ বাইরের শাসন মেনে নেয়নি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত চলমান এই যুদ্ধে ১৫০৫১ জন সোভিয়েত সৈন্য প্রাণ হারায়, আহত হয় ৪১৬ হাজার। এছাড়াও ১৪৭ টি ট্যাঙ্ক, ১১৮ বিমান, ৩৩৩ হেলিকপ্টার সহ অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণ প্রচুর। যুদ্ধ পরবর্তী আফগান সিনড্রোমে মারা যায় অনেক। অনেকের ধারণা এখান থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের শুরু। এমনিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি যুদ্ধের খরচ চালাতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। আফগানিস্তানে আক্রমণ আরব দেশগুলো ইসলামের উপর আক্রমণ হিসেবে নেয়। সারা বিশ্ব জুড়ে সোভিয়েত বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়। সোভিয়েত জনগণও এই যুদ্ধকে ন্যায় যুদ্ধ বলে মেনে নিতে পারে না। ফলে দেশের ভেতরেও যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব বলিষ্ঠ হয়। এই সমস্ত কিছু এক হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত ভেতর ও বাইরে উভয় দিক থেকে নাড়িয়ে দেয়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য পরবর্তীতে নিজেদের ভুল স্বীকার করে। রাশিয়াও বারবার সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণ ভুল হয়েছিল বলে স্বীকার করেছে। বর্তমানে এমন লোক এদেশে পাওয়া কষ্ট যে কিনা আফগানিস্তান আক্রমণের সমর্থনে দুটো কথা বলবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন সে দেশ থেকে শেষ সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে আসে তার পরেও তিন বছর সেখানে প্রোসোভিয়েত সরকার ছিল। ছিল বিভিন্ন রকমের ইনফ্রাস্ট্রাকচার। রাস্তাঘাট, ব্রীজ, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এটা করেছিল দুই বছর ধরে আর সেটা করার সময় অনেক নির্মাণ কাজও সম্পন্ন করে। তারা পরাজিত হয়ে ফিরে এলেও সেটা পালিয়ে যাওয়া ছিল না। এক কোথায় সেটা ছিল ওয়েল প্ল্যান্ড যেটা আমেরিকা সম্পর্কে বলা যাবে না। মধ্য এশিয়ার দেশগুলিও এক সময় আফগানিস্তানের মতই ছিল। সোভিয়েত ব্যবস্থা কায়েমের পর সেখানে শিক্ষার প্রসার ঘটে, আসে ইলেক্ট্রিসিটি, আসে শিল্প, বিজ্ঞান। যদি পুঁজিবাদী দেশ উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল ও ধনসম্পদ লুট করে নিজেদের অর্থনীতির উন্নয়নে লাগাত, সোভিয়েত ইউনিয়ন সব সময়ই সেসব দেশে শিক্ষার বিস্তারে আর স্থানীয় শিল্প গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিল। অন্তত ছাত্র জীবনে আফগান ছেলেমেয়েদের দেখে সেটাই মনে হয়েছে। তাছাড়া এই যে আমাদের মত সদ্য স্বাধীন দেশ যা সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ গড়তে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচেষ্টা ও অবদান সেটার স্বপক্ষে বলে। আমরা নিজেরাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

কিন্তু আমেরিকা কী রেখে গেল? গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে কোন পজিটিভ ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। এমনকি ক্ষমতা থেকে তালিবানদের বিতাড়ন আর তার জায়গায় মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন সেটাও কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কাদের কাছে গ্রহণযোগ্য? বিদেশি শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও দেশের মানুষের এক বিরাট অংশ এই পুতুল সরকারকে গ্রহণ করেনি। তাই রাজনৈতিক ভাবে আফগানিস্তান কখনই স্থিতিশীলতা পায়নি। কিন্তু আজ যাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে তারা পালাল সে তালিবান কি তাদের তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নয়? সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করতে গিয়ে তারাই তো এক সময় ধর্মের উন্মাদনা আর অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তালিবান আর আল কায়েদা গঠন করেছিল। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অনেক পরে তাদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকেই জন্ম নেয় ইসলামিক স্টেটের মত মধ্যযুগীয় সংগঠন। এর ফলাফল কী? আফগানিস্তান সহ সারা বিশ্ব কয়েক শ বছর পিছিয়ে গেল। সারা বিশ্ব কেন? কারণ তালিবান, ইসলামিক স্টেট এসব সংগঠনের যেকোনো সাফল্যই দেশে দেশে এদের নতুন নতুন অনুরাগী তৈরি করে। এরা নিজ নিজ দেশে আফগান স্টাইল বিপ্লব না হলেও শাসন কায়েম করতে চায়, জাতীয় পর্যায়ে না পারলে স্থানীয় বা পারিবারিক পর্যায়ে সেটা করে। ভিয়েতনামে আমেরিকা রেখে গিয়েছিল নাপাম বোমায় ঝাঁঝরা করা পোড়া মাটি। আফগানে কি আফিমের আদিগন্ত ভূমি আর স্বপ্ন হারানো অসহায় মানুষ? গত বিশ বছরে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করলেও আফগানিস্তানে আমেরিকার রাজনীতি আফগান জনগণের মঙ্গলের জন্য ছিল না, ছিল আল কায়েদা নিধন যজ্ঞ। আমেরিকা তালিবানদের সাথে যে চুক্তি করেছে সেটা নিজেদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে, আফগান জনগণের স্বার্থ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে। এটাই মনে হয় সবচেয়ে জঘন্য দিক।

একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনে জাগে। এখন ইউরোপ আমেরিকার বহু দেশে প্রচুর পরিমাণ সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ কাজ করে। এমনকি নতুন রাশিয়া থেকেও প্রচুর লোক সেখানে যায় কাজ করতে, ঘর বাঁধতে। এরা সবাই সোভিয়েত বা রুশ শিক্ষায় শিক্ষিত। এ দেশের পুঁজিবাদ বিরোধী প্রোপ্যাগান্ডা শুনে বেড়ে ওঠা। কিন্তু এদের কয় জন আমেরিকা বা ইউরোপকে পেছনের দিকে টানে? কয়জন সেখানে নিজেদের শাসন কায়েম করতে চায়? কিন্তু একই কথা কি বলা যাবে এশিয়া, আরব বিশ্ব বা আফ্রিকা থেকে যাওয়া লোকদের সম্পর্কে? এদের অনেকেই দেশের মৌলবাদী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে দেশ ত্যাগ করে আর একবার স্বপ্নের দেশে যেতে পারলে সেখানে ইসলামী শাসন কায়েম করতে উঠেপড়ে লাগে। কারণটা কি?
শিক্ষায়। আমাদের সব দেশ সেকুলার শিক্ষা দিতে আগ্রহী নয়, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ে তুলে না, ফলে এখান থেকে টেকনিক্যাল শিক্ষা নিয়ে বিদেশে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করলেও অনেকেই মানসিক ভাবে নিজেদের বদলাতে পারে না। আর পারে না বলেই সেসব দেশে শারিয়াতী আইন চায়, নিজ দেশের মৌলবাদী দলগুলোকে দু হাতে সাহায্য করে।

এখানে আরও একটা ব্যাপার উল্লেখ করা দরকার। সিআইএর হিসেব মতে কম পক্ষে তিন মাস তাদের গড়া সরকারি সৈন্য বাহিনী তালিবানদের মোকাবেলা করতে পারত। কেন হয়নি? খবরে প্রকাশ তালিবানরা সরকারি বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ অফিসারদের ঘুষ দিয়ে কিনে নেয়। এটা আমাকে পলাশীর কথা মনে করিয়ে দেয়। আমেরিকাও সাদ্দামের সৈন্যদের টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিল। তারও আগে সবে মাত্র নতুন ভূমিতে পদার্পণ করা ব্রিটিশেরা ইন্ডিয়ানদের কিনেছিল মদের বিনিময়ে। তখন ডলার ছিল না। এখন তালিবান কি আমেরিকার শীল আর নোড়া দিয়ে আমেরিকারই দাঁতের গোঁড়া ভাঙল? কিন্তু প্রশ্ন হল কোথায় তারা পেল এই টাকা? আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার মত টাকা? নাকি সিআইএ যুদ্ধ বা রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য গোপনে তালিবানকে এই টাকা দিয়েছে? আর সেটা যদি সত্য হয় তালিবানের হাতে যে সব আফগান মারা যাবে তাদের রক্তে আমেরিকার হাতও কি রঞ্জিত হবে না? তাই আমেরিকা যদি সত্যিকার অর্থেই অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ চায়, তাকে মিশাইলের পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষা নিয়ে আসতে হবে, নিজের স্বার্থে নয়, যে দেশে যাচ্ছে সেই দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে সেখানকার সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে আঁখেরে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বই লাভবান হবে।

ইদানীং কালে আমেরিকায় তাদের অতীত পাপ স্বীকার করার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিএলএম আন্দোলন সে ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেছে। বর্তমান প্রশাসনও তাদের অতীতের ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করছে না। আশা করি একদিন তারা স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের উপর করা অত্যাচারের জন্যও ক্ষমা প্রার্থী হবে। একদিন হিরশিমা, নাগাসাকি আর ভিয়েতনামের জন্য অনুশোচনা করবে। আর তালিবান, আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট এসব তৈরির জন্যও ভুল স্বীকার করবে। কারণ যত দিন না মানুষ বা দেশ তার ভুল স্বীকার করে ততদিন সে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে পারে না, করলেও সেটা সফল হয় না। অতীত তাকে পিছু টানে।

 

একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আফগানিস্তানের দুর্ভাগ্যের শুরু ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আক্রমণের মধ্য দিয়ে। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নও কিন্তু তাদের দক্ষিণ সীমান্ত রক্ষার কথাই বেশি করে ভেবেছিল। আর তাদের স্বভাবসুলভ অভ্যেস অনুযায়ী তারা সে দেশে সমাজতন্ত্র গড়তে চেয়েছিল। এক্ষেত্রে তারা ভুলে গিয়েছিল আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক ট্র্যাডিশনের কথা। এর আগে আফগানিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না, সেখানে মেয়েরাও স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে  পড়াশুনা করত। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন যদিও সেখানে সমাজতন্ত্র আনতে চেয়েছিল সেটা অন্তত সেই সময়ের আফগান সমাজের বৃহৎ অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। আর সেকারণেই আফগানিস্তানের বর্তমান করুন পরিনতির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। অন্যদিকে আমেরিকা যেটা করেছিল তা হল সমাজতন্ত্রকে হঠাতে ধর্মীয় মৌলবাদের ব্যবহার। আমরা যাই বলি না কেন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র – এরা একই সমতলে কাজ করে, এরা মানুষের কথা বলে, মানুষের শক্তির কথা বলে। ধর্ম, ধর্মীয় মৌলবাদ একেবারে ভিন্ন আদর্শের প্রতিনিধি, এরা বাই ডেফিনিশন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এমনকি আধুনিক মানবতাবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। আর এখানেই আমেরিকার ভুল। তারা তালিবান ও আল কায়েদার মাধ্যমে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে জয় লাভ করলেও দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সমস্ত বিশ্বকেই বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমেরিকা সে অর্থে গণতন্ত্র আর মানবতার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

অনেকের ধারণা আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার পলায়নে রাশিয়া খুব খুশি। আমার সেটা মনে হয়নি। হ্যাঁ, আমেরিকার পরাজয়ে তারা খুশি তবে পলায়নে নয়। ধরুন আপনার প্রতিবেশি আপনার শত্রুর কাছে বাসা ভাড়া দিল বা আপনার শত্রু আপনার পাশের বাড়ির দখল নিল। সে যদি চলে যায় আপনি নিঃসন্দেহে খুশি হবে। কিন্তু সে যদি সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে যায় আপনার খুশি হবার সময় থাকবে না, আপনি ভাববেন কীভাবে আগুন নেভানো যায় সেটা নিয়ে, কেননা পাশের বাড়ির আগুন আপনার বাড়িতেও আসতে পারে। তাই আফগানিস্তানকে তালিবানদের (উল্লেখ্য যে তালিবান রাশিয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন) হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ায় রাশিয়া খুশি নয়, চিন্তিত।

 

আমার বিশ্বাস উদ্দেশ্য ভাল না হলে কোন কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করা যায় না। প্রশ্ন করতে পারেন গণতন্ত্রের প্রসার ও বিকাশের মত উদ্দেশ্য কি খারাপ হতে পারে? আমার মনে হয় উদ্দেশ্য যত না গণতন্ত্রের বিকাশ তার চেয়ে বেশি এ অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তার। কিন্তু তর্কের খাতিরে কেউ জিজ্ঞেস করতেই পারেন পুঁজিবাদ খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েই বিজ্ঞানের সাথে সমঝোতা করে চলেছে আর সেই বিজ্ঞানের হাত ধরে হয়েছে শিল্প বিপ্লব, টেকনোলোজি পেয়েছে নতুন জীবন। সেটা কি করে? কারণ বিজ্ঞান বাধ্য হয়ে এই আঁতাতে গেলেও তার লক্ষ্য সব সময়ই ছিল মানব কল্যাণ। এখনও বিজ্ঞান মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যেই ভ্যাকসিন তৈরি করে, কিন্তু পুঁজিপতি আর রাজনীতিবিদ সেখানে খোঁজে অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক স্বার্থ। কিন্তু যখনই বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে শুধু পুঁজি আর রাজনীতি এসব করতে গেছে তখনই সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বিগত দিনগুলোতে আমেরিকা যে সব দেশেই গণতন্ত্রের বিকাশে অস্ত্রে শান দিয়েছে – তা সে আফগানিস্তান হোক, ইরাক হোক, লিবিয়া বা সিরিয়া হোক, সব জায়গা থেকেই গণতন্ত্র পালিয়েছে। এসব দেশ রক্তের বন্যায় ভেসেছে আর হয়েছে মৌলবাদের অভয়ারণ্য। একই ঘটনা আমরা দেখব অনেক এক্স সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে। উদ্দেশ্য যদি গণতন্ত্র হত তাহলে অস্ত্র নয়, শিক্ষার মাধ্যমে তারা সেটা করত আর স্থানীয় শিল্প বিকাশে তৎপর হত।  আজ যদি আফগানিস্তানে তারা শিল্প গড়ত, শিক্ষার ব্যবস্থা করত আর করত কর্ম সংস্থান তাহলে কি মানুষ এসবের জন্য লড়াই করত না? গত বিশ বছরে সে দেশের মানুষ নিজেদের নিরাপদ মনে করেনি, কোন সরকারই তাদের ভাগ্য বদলাতে পারেনি। তাই তাদের হারানোর কিছু ছিল না। আর এ কারণেই বলতে গেলে বিনাযুদ্ধে দেশ তুলে দিয়েছে মৌলবাদীদের হাতে। ইতিহাস থেকে কেউই শিক্ষা নেয় না। তবে আশা করব আমেরিকা তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে। অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে গেলে মাঝে মধ্যে নিজের নাকও যে কাটা যেতে পারে সেই সত্য উপলব্ধি করবে।

প্রশ্ন করতে পারেন এটা তো রাজনীতি, এখানে বিজ্ঞান কোথায়? রাজনীতি বিজ্ঞানের বাইরে না। যারা বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে তাদের সাথে আঁতাত, তা সে যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, সেটা বিজ্ঞান বিরোধী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ন্যাপ, সিপিবির সাথে জোটভুক্ত আওয়ামী লীগ আর হেফাজতের সাথে জোট বাঁধা আওয়ামী লীগের কথা। এই দুই আমলের রাজনৈতিক পরিবেশ উচ্চস্বরে জানান দেয় সমাজে রাজনীতির প্রভাব। বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার জন্য তাই রাজনীতিও একটা বিরাট ফ্যাক্টর।

পড়ুনঃ  বিজ্ঞান ভাবনা (৭)

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া