চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা

– বিজন সাহা

(৭)

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

দেশে গেলে আমি সব সময়ই চেষ্টা করি সোভিয়েত ফেরত বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। সবার সাথে না হলেও কিছু কিছু বন্ধুর সাথে দেখা করিই করি। এদের সঙ্গে সংগঠন করেছি, মিটিং মিছিল করেছি, একসাথে খেয়েছি, একই মার্ক্সবাদী আদর্শ ভাগ করে নিয়েছি। তাই এদের প্রতি একটা বিশেষ ধরণের টান আছে। এরা সবাই ওখানে ভাল পড়াশুনা করেছে, কষ্ট করে নিজেদের গড়ে তুলেছে, বর্তমানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত, রাজনীতির সাথে জড়িত না হলেও মানুষের কথা ভাবে, নিজ নিজ সাধ্যমত সমাজ সেবা করে। গ্রাম বা মফঃস্বল শহরের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা আমার এই বন্ধুরা যাকে বলে সেলফ মেড মেন। আর একারণেই হয়তো তাদের কাছ থেকে অন্য ধরণের ব্যবহার আশা করি, তাদের জীবন দর্শনে মানুষ, মানুষের সচেতনতা, মানুষের কর্ম প্রাধান্য পাবে সেটাই আশা করি। একবার এক এরকম এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম। বড় কোম্পানির বড় অফিসার। এক সময়ের বিপ্লবী। ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত শুনতে পারত না।
– কিরে ,কেমন আছিস?
– গুরুর কৃপায় ভালই আছি।

আমার তো চোখ ছানাবড়া। বলে কী?
– ঠিক বুঝালাম না। এত কষ্ট করে পড়াশুনা করে নিজের চেষ্টা আর যোগ্যতায় এত বড় হলি, আর আজ বলছিস গুরুর কৃপায়। কী ব্যাপার রে?
– গুরুর কৃপা না থাকলে দেশে কিছুই হয় না। দেশে তো থাকিস না।
– তুই এটা বিশ্বাস করিস?
– আগে করতাম না তবে বলতাম, চারিদিকে সবাই বলে বলে। এটাই আমাদের সমাজের বর্তমান চিত্র। রাজনৈতিক দল করার মতই হয় নামাজ পড়তে হবে নয়তো পূজা করতে হবে। তবে এখন করি। গুরু দয়ায় এসব হয়েছে কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তিনি অসন্তুষ্ট হলে যে সব হারাতে পারি এই ভয় অনেক আগে থেকেই মনে ঢুকেছে।
– বাঃ।
এর বেশি আমার আর কিছু বলার ছিল না। তবে বদ হজম করার মত ছিল অনেক কিছুই। মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন জাগল। এই যে লোকগুলো নিজেরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, অনেক খড়কুটা পুড়িয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তারপরেও কেন নিজের শক্তিতে বিশ্বাস হারাচ্ছে, কেন নিজেকে, নিজের ভাগ্যকে গুরুর হাতে সমর্পণ করছে? কেন এমন হয়?

না না, কেউ  যদি তাদের সব সাফল্যের জন্য ঈশ্বরকে সাধুবাদ জানায় তাতে কোন সমস্যা নেই, ব্যক্তি মানুষ সেটা করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্নটা হল মানুষ কেন এভাবে বদলে যায়। কারণ তার উত্তর থেকেই বুঝলাম, সে যতটা না বিশ্বাস থেকে এখানে এসেছে তার চেয়ে বেশি সামাজিক রীতিনীতি থেকে। এটা অনেকটা সেই পাইওনীয়ার বা কমসমলের মত। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে সবাই এসব করত। সবাই যে মন থেকে করত তা নয়। অনেকেই করত অন্যদের দেখাদেখি। যাতে একঘরে না হয়ে যায়। সামাজিকতা বলেও একটা কথা আছে। তবে এভাবে যে শুধু ধর্ম কর্ম করে তাই নয়, শুনেছি কোন কোন অফিসে এভাবেই সবাই ঘুষ খেতে শিখে, কেননা কেউ যদি না খায়, সে অল্প সময়ের মধ্যেই সবার চক্ষুশূল হয়। তারপর মানসিক অত্যাচার, চাকরি হারানো। এটা অবশ্য আমার শোনা কথা। কিন্তু সবই তো একই স্কীমে কাজ করে। তবে ঘটনা দাঁড়ায় প্রথম দিকে অনেকেই শুধু সামাজিকতার কারণে এভাবে বললেও এক সময় এতে বিশ্বাস করে বসে। সে তার ভালমন্দ সব কিছুতে ঈশ্বরের হাত দেখে। এভাবে এক সময় নিজের কাজ দিয়ে সাফল্য লাভের চেয়ে ঈশ্বরকে খুশি করে সাফল্য লাভের চিন্তা তার মাথায় ঢোকে ঠিক যেমনটা অনেকেই সাফল্যের সোপান হিসেবে যতটা না নিজের দক্ষতাকে দেখে তার চেয়ে বড় করে দেখে বস বা নেতাদের সুনজর আর কাজ দিয়ে নয়, চাটুকারিতা দিয়ে, তেল মাখিয়ে সে সেই সুনজর অর্জন করতে চায়। আর এখানেই সমস্যা। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ নিজের শক্তিতে বিশ্বাস করে, নিজের পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় দিয়ে সাফল্য লাভ করতে চায় আর ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষ সব সময়ই তাঁর কৃপার অপেক্ষায় থাকে। নিজের ভাগ্য রচনায় সক্রিয় না হয়ে বরং প্যাসিভ ভূমিকা পালন করে। এভাবেই সমাজ থেকে বিজ্ঞানমনস্কতা বিদায় নেয়। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যেখানে সব কিছুতে বৈজ্ঞানিক যুক্তি খোঁজে, এরা তাদের সব কাজের যুক্তি খোঁজে ধর্মের মধ্যে। মনে পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা। কথা প্রায় সমস্ত বিষয়ই মার্ক্সবাদী দৃষ্টি থেকে দেখা হত, মার্ক্সবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হত। এর ফলে জেনেটিক্স, সাইবারনেটিক্সের মত অনেক কিছুই পরিত্যাক্ত হয়েছে, বিজ্ঞানীরা হয় জেলে জীবন কাটিয়েছে নয়তো গবেষণা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। একই ভাবে আমরা যদি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ব্যাখ্যা ধর্ম গ্রন্থে, ধর্মীয় নেতাদের জীবন যাপনে খুঁজি সেটা হয়তো বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা ফলপ্রসূ হবে, তবে পরিণামে সেটা বিজ্ঞানমনস্ক জেনারেশন তৈরি করতে বাধার সৃষ্টি করবে আর সেটা যেমন বিজ্ঞানের জন্য তেমনি সমাজের জন্য হবে ক্ষতিকর।

প্রশ্ন করতে পারেন এতে ক্ষতির কী আছে?  উদাহরণ দেব একেবারে বর্তমান ঘটনা থেকে। এখন অতিমারি চলছে দেশে দেশে। অতিমারি তো নয় যুদ্ধ। এর মধ্যেই সারা বিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটির বেশি লোক করোনা আক্রান্ত হয়েছে, প্রায় ৪২ লাখ মানুষ মারা গেছে। অনেক যুদ্ধেও এমনটা হয় না। এছাড়া করোনা কারণে কত লোক যে অনাহারে বা চিকিৎসা না পেয়ে মরছে তার হিসাব কে রাখে? তাই করোনা প্রতিরোধ অভিযান – এটা আসলেই যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মূল সৈনিক ডাক্তার ও চিকিৎসা কর্মী। তারা লড়ছে ফ্রন্টে থেকে। ডাক্তার আর চিকিৎসা কর্মীদের মধ্যে মৃত্যুর হার দেখলেই বোঝা যাবে কেন তারা সৈনিক। তারা জীবন পণ করে আমাদের বাঁচাচ্ছে আর আমরা ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রেখে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা কুম্ভ মেলা করি, ঈদ করি, পূজাপার্বণ করি, অথচ ভেবে দেখি না আমাদের অবহেলায় কত ডাক্তারের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। সুস্থ হলে আমরা ডাক্তারকে ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না, অথচ ঈশ্বরকে ঠিকই কৃতজ্ঞতা জানাই। এজন্যে কি শুধু আমরাই দায়ী? অনেক ডাক্তার রোগীর জন্য সব কিছু করে নিজেই বলেন, “ঈশ্বর করুক সুস্থ হয়ে যাবেন।” তার মানে ডাক্তার নিজেই নিজের শ্রমকে ছোট করছেন। তাই রোগীরাও ডাক্তারের পরিবর্তে ঈশ্বরকেই ধন্যবাদ জানায়। তবে ডাক্তার ব্যর্থ হলে দায়টা একান্তই নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন ভ্যাক্সিন বা অন্যান্য সাহায্যের জন্য আমরা কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই না, এমনকি বিজ্ঞানীদেরও না, ধন্যবাদ জানাই প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা স্থানীয় নেতাদের। কেন? এরা ক্ষমতাশালী। ঈশ্বরের মত এরাও সবার কাছে থেকে আনুগত্য পেতে পছন্দ করে। যতক্ষণ না ডাক্তার সহ অন্যান্য বিজ্ঞান কর্মীরা নিজেদের শক্তিতে বিশ্বাস করবে, মাথা উঁচু করে নিজেদের বৈজ্ঞানিক সত্যটার জন্য লড়াই করতে শিখবে, ততদিন এদের শ্রমের ফসল উঠবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ঘরে যেমনটা কৃষকের ধান ওঠে জোতদারের গোলায়।  আর এসব যাতে না ঘটে আমাদের উচিৎ ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানের আর বিজ্ঞানীদের গল্প শোনানো, বলা এই যে রেডিও, টেলিভিশন, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ভ্যাক্সিন, গাড়ি, ট্রেন, প্নেন, বিদ্যুৎ, ফ্রিজ, জামা কাপড়, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ অর্থাৎ প্রতিটি জিনিস যা সে প্রতিদিন ব্যবহার করছে, যা তার জীবনকে অর্থময় করে তুলছে এ সবই বিজ্ঞানের আবদান। যেদিন আমরা সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানের অবদানের সাথে সাথে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে পারব, শুধু মানুষের ঘরে নয়, বিজ্ঞান যেদিন মানুষের মনে প্রকাশ করবে সেদিন পৃথিবী বদলে যাবে। আর সেটা করতে পারি আপনি, আমি, সে সবাই নিজেদের ঘরে বিজ্ঞানের মহিমার কথা বলে।

পড়ুনঃ বিজ্ঞান ভাবনা (৬)

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো, রাশিয়া