মতামত

আফগানিস্তানে যুক্তরাস্ট্রের ব্যর্থতা ও তার ভবিষ্যত পরিণতি ( প্রথম পর্ব )

—— হায়দার এ. খান

পশ্চিমা বিশ্ব গত কদিন আগে  বিস্মযের সাথে প্রত্যক্ষ করেছে যুক্তরাস্ট্র সমর্থিত আফগান সরকারের পতন। কোন রকমের বিমান হানলা বা ভারী অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুততার সাথে উগ্রপন্হী তালেবান গোষ্ঠী কাবুলের দখল নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে নির্দিস্ট সময়ের ভিতরে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে অটল থেকে সততার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মার্কিন জনগণের কাছে একটা বিষয় সাফ জানিয়ে দিলেন যে, আফগানিস্তানের সরকার যদি পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজেদের সেনাবাহিনী ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন আদায় করতে না পারে, তবে তাদের রক্ষা করার জন্য আমেরিকান সৈন্যরা আর নিজেদের রক্ত দিতে রাজী নয়। আফগানিস্তানে মার্কিনীদের নৈতিক পরাজয় হয়েছে কী-না সেটা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, তবে বাইডেন তার পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক সেনা প্রত্যাহারের  সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের যথার্থ উদ্যোগ নিয়েছেন। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আমেরিকার তিন-চতুর্থাংশ নাগরিকেরা আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রশ্নে জো বাইডেন এর সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা রেখেছেন।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আফগানিস্তানে সৃস্ট মানবিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় আমেরিকা ও তার মিত্ররা, সেখানকার বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও এনজিওসহ  অন্যান্য সংস্থাগুলো  দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে বড় রকমের ভুমিকা রেখেছে। তবে সেখানকার শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার অজুহাতে মার্কিনীদের অনুপ্রবেশ দুর্ণীতির মহাযজ্ঞ আর সাধারণ জনগনের জন্য দুর্ভোগই বয়ে এনেছে। এমনও নিশ্চয়ই হতে পারে, সমস্যাটির দিকে একটা  যুৎসই ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে একটা প্রশংসনীয় ভু-রাজনৈতিক দৃশ্যকল্পের অবতারণা করতে পারি। সম্প্রতি আমি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেবার চেষ্টা করি। ফলাফল হিসেবে দেশটির সার্বিক অর্থনীতি ও বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্ণীতি আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলির ব্যর্থতার অন্তর্নিহিত কারণ বলেই প্রতীয়মান হয়। সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই দুর্ণীতির মহাযজ্ঞে পশ্চিমাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ছিল বেশ চোখে পড়ার মত! এই সহজ সত্যকে যদি আমরা উপলদ্ধি করতে পারি, তবে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় কাবুলে যুক্তরাস্ট্র সমর্থিত আফগান সরকারের কেন এত দ্রুত পতন হয়ে গেছে।

কাগজে-কলমে আফগানিস্তানের সরকারী সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা তিন লাখের মতো, যা তালেবান বাহিনীর চাইতে মোটামুটি চার গুণ বেশি। বিমানবাহিনী এবং ভারী অস্ত্র-শস্ত্রও ছিল। এইসব সামরিক সদস্যদের যুক্তরাস্ট্র ও মিত্ররা নিজ নিজ দেশে উন্নত সামরিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছিল। অত্যন্ত ব্যযবহুল এইসব প্রশিক্ষনের ব্যয় ছাড়াও আফগান সামরিক বাহিনী ও তাদের জেনারেলরা পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থসাহায্যও পায়। তবে, পশ্চিমাদের এতসব সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য সবই কিন্তু জলেই গেল। তালেবানদের না ছিল ভারী অস্ত্র-শস্ত্র, না ছিল  বিমানবাহিনী। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া সরাসরি খুব বেশি বৈদেশিক সমর্থন না পেলেও, সাধারণ মানের অস্ত্র দিয়ে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর দেশে ফেরার সময়ের মধ্যেই সহজেই কাবুল দখলে নিয়ে নেয়। সামরিক হিসেব নিকেষের বাদ দিলেও  দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতিত সাধারণ আফগান জনগণের মন জয় করে তালেবানেরা  পশ্চিমা দখলদারদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করেছে।

চলবে . . .

লেখক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক লেখক, গবেষক।
অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব ডেনভার, যুক্তরাস্ট্র।
আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা, ইউরোপিয়ান ইকোনোমিক এন্ড সোশাল কমিটি

অনুবাদ, রবীন গুহ, সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, প্রগতির যাত্রী ডট কম