মতামত

বিশ্ব আদিবাসী দিবস ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’

– সুভাষ দে

গত ৯ আগস্ট ছিল বিশ্ব আদিবাসী দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য  ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়; আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহ্বান’। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি’র মূল শ্লোগান ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’ এর সাথে সংগতি রেখে এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মূল কথা হচ্ছে, দেশের সকল মানুষকে- সংখ্যা, অবস্থানের দিক থেকে যাই হোক না কেন- সকলের মানবিক মর্যাদা, রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক অধিকার প্রাপ্যতা, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সকল প্রকার জনবৈশিষ্ট্য নিয়ে সামাজিক রূপান্তরের অঙ্গীকার।
এ বছরটিতে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি, ২০৩০ সালে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন দৃষ্টিগ্রাহ্য, এখন প্রয়োজন কাউকে পেছনে ফেলে নয়, সুষম ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ গোষ্ঠী, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত জনগোষ্ঠীদের অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নটি সামনে আনি তবে সে চিত্র খুব সুখকর হবে না। সংবিধান সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার, সুযোগ, মর্যাদা দিয়েছে কিন্তু তারা সে সব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, অর্থনৈতিক, সামাজিক বৈষম্য প্রকটভাবে দৃশ্যমান।
বাংলাদেশে আদিবাসীরা মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ মাত্র, আদিবাসী-সরকার যাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, গোত্র, সম্প্রদায় নামে স্বীকৃতি দিয়েছে- এটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত- এই অল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিকে বহুত্বময় রূপ দিয়েছে। সবচাইতে বড়ো কথা, এরা আমাদের পাহাড় ও অরণ্যকে সুবাসিত রূপ দিয়েছে, প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রাখতে এদের লোকায়ত জীবন ও জীবিকা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তারা প্রকৃতিকে মাতৃসম ভাবে, এর লালন-পালন বিকাশ, সৌন্দর্য অক্ষুণœ রাখতে সদাসচেষ্ট।
৫০টি নৃ গোষ্ঠীকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনের সার্বিক অগ্রগতিতে এদের ভূমিকা প্রায় অনুল্লেখ্য। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র, বাসস্থান- এই মৌলিক অধিকারগুলোর প্রাপ্যতা থেকে এরা অনেকটা বঞ্চিত। যদিও এখন সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার তৎপরতার কারণে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। সরকার ৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দানের উদ্যোগ নিয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক তথ্যে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫২ শতাংশ মানুষের সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা নেই। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যাদের বসবাস তাদের কষ্ট নিদারুণ। কি পাহাড়, কি সমতল সর্বত্রই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার  মানুষ শতশত বছরের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের আতঙ্কে থাকে। উন্নয়নের নামে, অর্থনৈতিক জোন প্রকল্প, ইকো পার্ক, জাতীয় উদ্যান, রিজার্ভ ফরেস্ট এর নামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর  পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি, জায়গা জমি এমনকি শ্মশান ভিটা পর্যন্ত রক্ষা পায় না। তদুপরি আছে প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালীদের জোরপূর্বক জায়গা জমি দখল- এসব খবর পত্রপত্রিকায় প্রায়ই আসে। ফলে এই সব মানুষ স্থানান্তর এমন কি দেশান্তরী হতেও বাধ্য হয়।
বান্দরবানের চিম্বুক এলাকায় ¤্রাে জনগোষ্ঠীর বসত জায়গা-জমিতে বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও দেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। বৃহত্তর সিলেটের নানা উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর  ‘পুঞ্জি’ (গ্রাম) আগের মতো টিকে থাকতে পারছেনা।  (সূত্রঃ দেশ রূপান্তর, পাভেল পার্থর নিবন্ধ, ৯ আগস্ট ২০২১)
এই যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষরা বার বার পেছনে পড়ে যাচ্ছে, বাস্তুরক্ষা ও জীবিকার সংস্থান করতে হিমশিম খাচ্ছে, রাষ্ট্রের উন্নয়ন অগ্রগতির ধারে কাছেও যেতে পারছেনা, দৈনন্দিন খাবার জোগাড় করতেই তাদের প্রাণান্ত, বৃহত্তর সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কি তাদের খবর রাখছে! তাহলে কিভাবে তারা সামনে আসবে!
দেশে ৫০টি ক্ষুদ্র জাতি ও নৃ-গোষ্ঠী, এর মধ্যে সমতলে ৩৯টি, পাহাড়ে ১১টি। এদের সংস্কৃতির ভা-ার কত প্রাচুর্যময়, তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি বন্দনা, লোকাচার, উৎপাদন সম্পর্ক- প্রতিটি নৃ গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা প্রণালী, সংস্কার, আচার পৃথক, বর্ণিল। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির যে আভা তা এদের উজ্জ্বল বিভায় বর্ণিল। সংস্কৃতির বিনিময় জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও অগ্রযাত্রার মূল অনুঘটক, এটি বৃহত্তর লোকসমাজ ও রাষ্ট্রকে অনুধাবন করতে হবে।
আমরা মনে করি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলির ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পুরান ও লোকগাথা, বর্ণমালা রক্ষা করা জাতীয় কর্তব্য হওয়া উচিত। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিপন্নতা থেকে উদ্ধার করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আদিবাসী ভাষা একাডেমি ও ভাষা কমিশন গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন। জাতীয় ভাষা ইনস্টিটিউট এই বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে পারে। প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠীর পরিবারগুলোর জন্য পূর্ণাঙ্গ তথ্যভা-ার গড়ে তোলা জরুরি। তাহলে তাদের মৌলিক অধিকারগুলির প্রাপ্যতা সহজ হবে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাদের পিতৃপুরুষের বসতবাটি, জমি রক্ষা করা, তাদের জীবিকার সংস্থানে বিশদ পরিকল্পনা নেয়া। করোনাকালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলির কাছে সাহায্য পৌঁছানো জরুরি।
জনবৈচিত্র্য ও বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় জীবনধারা বৃহত্তর সমাজে সম্প্রীতি ও ঐক্যের পথ সুগম করে। সমাজ ও সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদের চর্চা সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রাণময় করে তোলে। তখন প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মর্যাদা ও গৌরবের সাথে জাতীয় ও সমষ্টিগত উন্নতিতে নিরুদ্বেগ চিত্তে সামিল হতে পারে। এই উদ্যোগে রাষ্ট্রকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
 লেখক: সাংবাদিক