মতামত

করোনা পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থায় করণীয়

– ইমরান চৌধুরী

করোনা মহামারীর স্থবির এই  সময়টা নিশ্চয়ই আমরা কাটিয়ে উঠবো একদিন। আমাদের বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী মুখর হয়ে উঠবে প্রতিটি ক্যাম্পাস। তবুও আমাদের সবার মনে বারবার একটা প্রশ্নই রয়ে যায়।   করোনার কারণে তৈরি হওয়া অনলাইন আর অফলাইনের শিক্ষার এই বৈষম্য আমরা কি সমাধান করতে পারবো? সমাধান করতে গেলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষায় উদ্ভাবনীয় ব্যক্তিদের ভূমিকা অথবা শিক্ষায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের ভূমিকাই বা কী হবে? এসব প্রশ্ন এখন শিক্ষার্থী, শিক্ষক,অভিভাবক এবং শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায়ই সবারই চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের কারণে গত বছর ১৭ মার্চ থেকেই বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কয়েক দফায় তারিখ ঘোষণা করেও খোলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভর করেছে হতাশা। কবে খুলছে ক্যাম্পাস এই প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। এই মহামারীতেই আমরা দেখতে পেয়েছি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কি ভঙ্গুর অবস্থা। মেরুদণ্ডে ব্যথা নিয়ে কেউ যেমন তার শারীরিক সুস্থতার দাবি করতে পারে না, একইভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা না করে কোনো দেশ উন্নত হতে পারে না।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা করোনা আসার আগে থেকেই বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। যে সরকারই ক্ষমতাই আসুক না কেনো কেউই জাতির মেরুদণ্ড এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার ও গড়ে তোলার নুন্যতম উদ্যেগই গ্রহণ করে নি। উলটো আমরা দেখতে পাই  বিচিত্র পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে শিক্ষাদান পদ্ধতি- সর্বত্রই ছিল শৃঙ্খলা ও মানের অবনমন। ধর্মের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই  রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, হুমায়ুন আজাদদের মতো বিখ্যাত লেখকদের লিখা পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।  এই চিত্রটি দেখলেই বুঝা যায় আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কি করুণ দশা।

ছাত্র ইউনিয়ন তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই  বিজ্ঞানভিত্তিক গণমুখী ও একইধারার  শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের  জন্য লড়ছে অবিরাম।   শিক্ষাকে ব্যবসার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছে। ।কিন্তু আমরা দেখতে পাই   শিক্ষায় ছড়িয়ে পড়েছে বণিকবৃত্তির প্রভাব এবং রাজনীতি। ব্যবসায়ী, সেনাবাহিনী এবং কূটনীতিকরাও জড়িত হয়ে পড়েন শিক্ষা ব্যবসায়। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় প্রতি বছরে এই শিক্ষা খাতে।  সরকারও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়  খুলতে  যেন উদ্বুদ্ধ করছে তার আমলাদের,ব্যবসায়ীদের। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই ভাষা আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য সর্বস্থরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ব্যাপারটি ভেস্তে গেছে অনেক আগেই। বাড়ছে ইংরেজি, আধা-ইংরেজি ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা। শিক্ষায় বাংলা ভাষা হয়েছে অবহেলিত।

নব্য টাকাওয়ালা অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে খুশি হচ্ছেন। রাস্তার মোড়ে চিপা গলির মধ্যে গড়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যমের অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ স্কুল। এসব স্কুলের সব যে খারাপ আমি তা বলছি না। তবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক স্কুলে ছেলেমেয়েরা না শিখতে পারছে ইংরেজি না শিখতে পারছে বাংলা। আবার এর মধ্যে রয়েছে চার-পাঁচ রকম মাদ্রাসা। আলিয়া, কওমি, ফোরকানিয়া, হাফিজিয়া, ক্যাডেটসহ আরও নানা রকমের। আবার রয়েছে কিছু মিশনারি স্কুল ও এনজিও পরিচালিত স্কুল। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে এমন নৈরাজ্য।আজ করোনার প্রকোপে প্রায় স্থবির পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা।  নেই আগের মতো স্কুলে যাওয়ার তাড়া, ক্লাসে বন্ধুদের সাথে খুঁনসুটি, টিফিনে খেলাধুলা বা ক্লাস শেষে একসাথে গল্প করতে করতে ঘরে ফেরার সেই দৃশ্য।  পড়ালেখার মধ্যে থাকতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থীই দিন দিন আসক্ত হচ্ছে মাদক, গেইম বা পর্ণোমুভিতে। ব্র্যাকের এক গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে, করোনার সময়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে গৃহস্থলীর কাজ ও পরিবারকে সহযোগিতা করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ২২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারে খাদ্য সংকট রয়েছে।

অন্যদিকে যাদের পরিবারে খাদ্য সংকট ছিল না এবং কোন রকম আয় বর্ধক কাজ করতে হয়নি সেসব পরিবারের প্রায় ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গল্প গুজব বা আড্ডাবাজি করে দিন অতিবাহিত করছে। এছাড়া বিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সঠিক নির্দেশনা না পাওয়ায় ৪৪ শতাংশ, পরিবার থেকে সাহায্য না পাওয়ায় ১৯ শতাংশ এবং ঘরে পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় ১১ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যে একদম থেমে না থাকলেও পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড এবং শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি ও সাফল্যের উপরই দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভরশীল। বিকল্প পদ্ধতি হিসাবে অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা নিয়েও বিভিন্ন কারণে প্রশ্ন রয়েছে। অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষার নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো নাম মাত্রই শিক্ষা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু আদৌ এর দ্বারা শিক্ষার্থীদের  কোনো  লাভ হচ্ছে কিনা তা অভিভাবক, শিক্ষকরাই ভালো জানবেন।   প্রায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে এই ধরনের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। এদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থী, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, আদিবাসী  শিক্ষার্থী, আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা রয়েছে। সুতরাং আমাদের অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয় সমতা আনয়নে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। করোনা পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থাকে গোছানোর জন্য দরকার সরকারের সুনির্দিষ্ট  পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের সদিচ্ছা।

শিক্ষাকে ব্যবসার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। শিক্ষাখাতে ও গবেষণাখাতে   পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ   বরাদ্দ এবং সরকার কতৃক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো পরিচালনা করার উদ্যেগ নিতে হবে। সেজন্য আমাদের প্রয়োজন শিক্ষা বান্ধব বাজেট। বর্তমানে আমাদের দেশে জিডিপির ২.২ শতাংশ বরাদ্ধ করা হয় শিক্ষায় যা অপ্রতুল। ছাত্র ইউনিয়ন  শিক্ষা খাতে  জিডিপির ৮ শতাংশ ও মোট বাজেটের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে অনেকদিন ধরেই।   আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। গত আড়াই বছরে শিক্ষাখাতে মহামারীর যে প্রভাব পড়েছে, তা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে তুলতে বড় বিনিয়োগ আর সংস্কার প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে বিশেষ প্রণোদনাও সুফল দিত, যার কোনো দিশা বর্তমান বাজেটে নেই।স্বাভাবিকভাবেই করোনা বিপর্যয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে বর্তমান সরকার জীবন, জীবিকা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এটি যতখানি ব্যবসা সহায়ক, ততখানি শিক্ষা সহায়ক হয়নি। শিক্ষায় গত আড়াই  বছরে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতি হয়ে চলেছে, সেই ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য,বর্তমানের শিক্ষায়  বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট আরো বাড়াতে হবে। শুধুমাত্র অর্থের অভাবে আমাদের দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই ঝরে যায়। শিক্ষা ও অর্থ ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা উপকরন নিশ্চিত করনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

করোনা পরবর্তী পৃথিবী অনলাইন শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে। তাই প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, তাই প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরন হিসাবে ইলেকট্রনিক ডিভাইজ প্রদান নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। স্বল্পমূল্যে শিক্ষার্থীদেরকে ইন্টারনেট সুবিধা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফ্রি ইন্টারনেট প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও আত্বপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা প্রয়োজন। কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ করতে হবে। কারিকুলাম শিক্ষার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। করোনা মহামারীর পর আগামী কারিকুলাম গতানুগতিক হবে না। বর্তমান সময় ও আগামীর কথা মাথায় রেখেই কারিকুলাম পুনঃসংস্করণ করা জরুরি। বর্তমানে প্রয়োজন কমিউনিটি বেইজড বা ক্রাউড সোর্স কারিকুলাম। যার মাধ্যমে শিক্ষা যতটুকু কমিউনিটির প্রয়োজন, ততটুকু কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।কমিউনিটি বেইজড কারিকুলামের ফলে শিক্ষা বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব। কারিকুলাম প্রস্তুতিতে অবশ্যই শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয় করতে হবে। জরুরি অবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা কী হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। জীবনমুখী ও প্রাকৃতিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে অনেক। দক্ষতাভিত্তিক কারিকুলামের পাশাপাশি বাস্তবমুখী নানা কার্যক্রমও কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। অসমতার সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে সমতার সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।   সে জন্য সবার সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা খুবই জরুরি। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা সফলতা পাবো ও শিক্ষা বৈষম্য অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখকঃ  সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা