চলমান সংবাদ

বর্ষা আসলেই প্রশাসনের তোড়জোড়, এখনো পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে হাজারো মানুষ

পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরতদের সরাতে সারা বছর প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ না থাকলেও বর্ষা মৌসুম এলেই শুরু হয় উচ্ছেদে তোড়জোড়। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। পাহাড় ধসে প্রাণহানি বন্ধে এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধে বিভিন্ন সময় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি নানা সুপারিশ করলেও এসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয়না। বর্ষা আসলেই যেন শুরু হয় প্রশাসনের সকল তোড়জোড়। এবারও বর্ষার শুরুতে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে প্রশাসনের উদ্যোগ শুরু হয়। কিন্তু এখনআষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবন শেষ হতে যাচ্ছে। এখনো পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবছরই উচ্ছেদ অভিযানে সেবা সংযোগ লাইনসমূহ বিচ্ছিন্ন করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু কিছুদিন পর মানুষ আবারও ফিরে যায় পুরনো আবাসস্থলে। পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে রয়েছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। গত মে মাসে কমিটির ২১তম সভায় সেবা সংস্থাসমূহকে পাহাড়ের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রতিনিধির নাম প্রস্তাবনা চেয়ে চিঠি পাঠানো হলেও এখনো কোনো সংস্থার সাড়া মেলেনি। এদিকে গত তিনদিন ধরে টানা ভারি বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড় ও ভূমিধসের শঙ্কায় ঝুঁকিতে রয়েছের পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা বাসিন্দারা। যদিও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বলছে, পাহাড়ের আশেপাশে থাকা লোকজনদের সতর্ক করতে সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, সতর্ক অবস্থায় আছে প্রশাসন। টানা বৃষ্টিপাতে ভূমিধসের আশঙ্কায় মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) রাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের টিম চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়ে অভিযান চালায়। এসময় নগরীর কয়েকটি পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত ৯২টি পরিবারকে সরিয়ে নেয় জেলা প্রশাসন। এ সময় ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। চট্টগ্রামের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং ছয়জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ অভিযানে ছিলেন। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, ‘ছয়টি পাহাড় থেকে ৯২ পরিবারের ৩১০ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়। তাদের চারটি আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। অভিযান এখনও চলমান আছে। আমরা বিভিন্ন পাহাড় পরিদর্শন করে দেখছি, কারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন। সবাইকে আমরা সরিয়ে নেব।’ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে আনা পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বুধবার (২৮ জুলাই) দুপুরে ভুনা খিচুড়ি ও ডিম সরবরাহ করা হয়েছে। রাতের খাবারের ব্যাবস্থাও করা হচ্ছে। মাইকিং চলমান রয়েছে। পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্বেচ্ছাসেবকরা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনার কাজ এখনো অব্যাহত রেখেছেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে কিংবা পাহাড় কেটে বসতি গড়ে উঠেছে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস। দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে প্রতিদিনই গড়ে উঠছে ঝুঁপড়ি থেকে শুরু করে চার-পাঁচ তলার দালান। পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় ততই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানোর উদ্যোগে স্থবিরতা চলে আসে। নগর বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতাযয় দিন দিন বাড়ছে পাহাড়ে বসতি। মদদ দিচ্ছে প্রভাবশালীরা। দফায় দফায় বৈঠক, তালিকা প্রণয়ন ও সুপারিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ অবৈধ বসতি সরানোর কাজ। ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে আড়াই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর টেকনিক্যাল কমিটি যে ৩৭ দফা সুপারিশ করেছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, যারা অবৈধভাবে এই পাহাড়গুলোতে বসবাস করছে তাদেরকে গ্যাস-পানির সংযোগ আছে। এই সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবৈধভাবে সরকারি জমি দখল করে ভাড়া দেয়া এবং উচ্চ আদালতে মামলা চলমান থাকাসহ নানা জটিলতা থাকায় বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বেশ কয়েকটি পাহাড়ের ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট আছে এবং সে রিটের আছে আসলে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, পাহাড় দখলের পেছনে রয়েছে ভূমিদস্যুতা। যারা দখলদার, তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকেন। তারা যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকারের সমর্থক গোষ্ঠী সেজে পাহাড় দখল করেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ এবং পাহাড় রক্ষা করতে হলে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ে ব্যাপকভাবে বনায়ন করতে হবে।
# ২৮.০৭.২০২১ চট্টগ্রাম #