মতামত

সি আর বি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্তে তরুণ প্রজন্মের প্রতিক্রিয়া

-সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল চট্টগ্রামবাসী মানবেনা

হুমায়রা শওকত

সুদুর্গম দূরদেশ –

 পথশূন্য তরুশূন্য প্রান্তর অশেষ

 মহাপিপাসার রঙ্গভূমি;

            ————-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ছোটবেলা থেকেই বেশ সখ্যতা ছিলো জায়গাটির সাথে।স্টেডিয়ামে খেলা শেষেই চলে যেতাম বাবার সাথে।

সি আর বি — খুব মায়া জড়ানো একটি স্থান। চট্টগ্রামের ফুসফুস নামে খ্যাত। চারিদিকে গাছপালা, সবুজ অরণ্য, শতবর্ষী গাছের আবাসভূমি। নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে কিছুটা স্বস্তি, আরাম ও মানসিক প্রশান্তির খোঁজে সময় পেলে মানুষ জমায়েত হয় সিআরবির শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে। এছাড়া এটি বহন করে আসছে শত বছরের ইতিহাস। এই সিআরবিতেই ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন অনেক বীরযোদ্ধা। এই সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চলীয়)  মহাব্যবস্থাপক এর নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭২ সালে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দু’শো বছরের ইতিহাস জড়ানো অন্যতম একটি স্থাপনা এটি। স্থানটি মিশে আছে আমাদের ইতিহাসের সাথেও।

এখন আসা যাক ৫০০ শয্যার হাসপাতাল স্থাপনের প্রকল্প বাস্তবায়ন  প্রসঙ্গে। আমাদের জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে হাসপাতাল প্রয়োজন ঠিক, তবে করোনা কালীন এই সময়ে অক্সিজেন এর স্বল্পতা যেখানে নিংড়ে নিচ্ছে আমাদের শান্তি সেখানে গাছপালা নিধনের মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মাণ কতটুকু যৌক্তিক সেই প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি। ২০১২ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক- এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৪,৪২০ বর্গ কিলোমিটার যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১১.০৮%। বাংলাদেশ একটি সবুজ দেশ হলেও এর বনভূমির পরিমাণ খুব কম।অধিকাংশ সরকারি বনভূমি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে।  টাইগার পাস ও বাঘঘোনা নাম থেকেই বোঝা যায় এক সময় চট্টগ্রামে কত সমৃদ্ধ বনাঞ্চল ছিলো।  কিন্তু  দুঃখের বিষয় এই চট্টগ্রামেই এখন বনাঞ্চল নেই বললেই চলে। শিল্পযুগে প্রবেশের সময় পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিলো ১০০ কোটি । তখন জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্য এতো বেশি ছিল যে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে তা অবাধে ব্যাবহার করা হতো। বিশ শতকের শেষ দিকে এসে জানা গেল, জীবসম্পদ অসীম নয়, সীমিত এবং মানুষ তা অবাধে ধ্বংস করে চলেছে। এখন চিন্তার বিষয় হলো, যে জীবসম্পদের ওপর মানুষের কল্যাণ, বিকাশ, অস্তিত্ব নির্ভরশীল তা ধ্বংস করে, হাসপাতাল নির্মানের নামে জীবন রক্ষার কথা কি করে ভাবা হচ্ছে ?

এছাড়া লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো বয়স্ক মানুষদের এবং শিশুদের চিত্তবিনোদন কিংবা বৈকালিক বা প্রাত ভ্রমণের কোন ব্যাবস্থা চট্টগ্রামে নেই বললেই চলে। অসহায় গরীব শিশুকিশোরদের জন্য বিনা টিকিটে আনন্দময় শৈশব নিশ্চিত করণের ও ব্যবস্থা নেই। এই চট্টগ্রাম যেন এক কারাগারে পরিণত হতে চলেছে। ইতোমধ্যেই ষোলশহর ২ নং গেইটে  বিপ্লব উদ্যান ধ্বংস করে একে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। ব্যাবসায়িক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সিআরবি তে হাসপাতাল স্থাপনের যেই অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে তা কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়।

তাই হাসপাতাল নির্মান নিয়ে স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকার জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিবে বলে আশা রাখি।  হাসপাতাল তৈরী হোক, তবে এই সবুজ ভূ-স্বর্গ ধ্বংসের মাধ্যমে নয়। সিআরবি রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। এটি রক্ষায় সোচ্চার পুরো চট্টগ্রামবাসী।  বর্তমান সরকার আমলেই এখানে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় চট্টগ্রামবাসী তা মেনে নেয় নি। সেই জায়গায় ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে হাসপাতাল নির্মানের এই অপচেষ্টা  কখনোই মেনে নিব না আমরা।

হুমায়রা শওকত, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।