শিল্প সাহিত্য

সূর্য সেনকে বার বার মনে পড়ে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে

– আবসার হাবীব

১. এপ্রিল ১৮, ১৯৩০

১৮ এপ্রিল। এ রকম কোনো কোনো উজ্জ্বল দিন বা তারিখ আসে। দুএকটা ছোটখাট অনুষ্ঠান হয়। কখনো মনে পড়ে, কখনো বা মনে পড়ে না।

চট্টগ্রাম জে.এম সেন হলের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বিপ্লবী মহানায়ক সূর্য সেন, সকলের প্রিয় মাষ্টারদার আবক্ষ ভাস্কর দেখে মাথা নত হয়ে আসে শ্রদ্ধায়। ইতিহাস কথা বলে নীরবে। বাঙ্ময় হয়ে উঠে এক একটা অধ্যায় বা সময়।

এই আবক্ষ ব্রোঞ্জ ভাস্করের শিল্পী হলেন কলকাতার বিভাস পাল। ভাস্করটি এখানে স্থাপন করা হয় বাংলাদেশ সূর্য সেন স্মৃতিরক্ষা সংসদ চট্টগ্রাম, বিপ্লবীতীর্থ স্মৃতি সংস্থা ও সূর্য সেন স্মারক প্রতিমূর্তি কমিটি কলকাতার যৌথ উদ্যোগে ১৯৭৫ সালের এই দিনে। যেনো ভুলে না যাই ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের কথা।

২. সূর্যকুমার সেন

চট্টগ্রাম রাউজান উপজেলাধীন নোয়াপাড়া গ্রামে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সূর্যকুমার সেন জন্ম গ্রহণ করেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ। বাবা ছিলেন রাজমণি সেন। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা, শহরের ন্যাশনাল স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সূর্য সেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ ক্লাসে পড়ার সময়, এই কলেজের শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সংশ্রবে আসেন। সূর্য সেনকেও স্বদেশ-প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন একটি ক্ষুদ্র বিপ্লবী দলে। এবং কিছুদিনের মধ্যেই ঐ দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

৩. সর্বপ্রথম পতাকা উত্তোলন

বেঙ্গল অর্ডিন্যাস থেকে মুক্ত হয়ে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন ১৯২৮ সালেই সূর্য সেন, অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ প্রমুখ বিপ্লবীরা। ফিরে এসেই ভাবতে থাকেন কিভাবে কাজ করা যায় দেশের স্বাধীনতার জন্য। ঠিক করলেন, সরকারী অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে সেই অস্ত্র দিয়েই সামনাসামনি যুদ্ধ, রেললাইন তুলে ফেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, এবং ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনাও করেন।

এরই মধ্যেই মাষ্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী কর্মীবাহিনী সংগঠিত হয়ে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আঘাত হানার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। ১৯৩০ সালের প্রথমদিকেই আক্রমণের প্রস্তুতি থাকলেও অনুকূল পরিবেশ না থাকায় তিনমাস পর ১৮ এপ্রিল চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে কর্মসূচী বাস্তবায়নে ছড়িয়ে পড়েন। সূর্য সেনের ভাষায় এই কর্মসূচী হলো মৃত্যুর কর্মসূচী।

এই কর্মসূচী অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ১৮ এপ্রিল রাত দশটায় যুগপৎ আক্রমণ শুরু হয় কেন্দ্রিয় পুলিশ অস্ত্রাগারে, টেলিগ্রাফ অফিসে, অক্সিলিয়ারী ফোর্সের অস্ত্রাগারে, ইউরোপীয়ান ক্লাবে। রেল যোগাযাগ বিচ্ছিন্ন করা হয় লাঙলকোটে ও ধুমের কাছে। বিপ্লবীরা উভয় অস্ত্রাগার আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে যায় এবং উদ্বৃত্ত   অস্ত্র ভেঙ্গেচুরে জ্বালিয়ে দেয়।

আক্রমণের সাফল্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে ইণ্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার সভাপতির নাম দিয়ে একটি প্রচারপত্র শহরে বিলি করা হয়। চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য সেন। ১৮ এপ্রিল রাতেই স্বাধীন চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের  পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক পুড়িয়ে দিয়ে। তিনবার বন্দুকের আওয়াজ করে সমবেতভাবে জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

এর কিছুক্ষণ পর স্বাধীন চট্টগ্রামের বিপ্লবী সামরিক সরকারের প্রধান বলে ঘোষণা করা হয় মাষ্টারদা সূর্য সেনকে। মাষ্টারদা এরপর বিদ্রোহী সৈনিকের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। এই বক্তৃতায় তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং আসন্ন প্রতি-আক্রমণ প্রতিরোধের সংগ্রামে এই স্বাধীন বিপ্লবী সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্য  করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান। এ বিপ্লবী সরকারের স্থায়ীত্ব ছিলো চার দিন।

৪. গৈড়লা গ্রামে সংঘর্ষ

১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী গৈড়লা গ্রামে পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের সংঘর্ষ হয়। ঘণ্টা দুয়েক দুপক্ষ থেকেই গোলাগুলি চলার পর মাষ্টারদা ও স্থানীয় একজন তরুণ ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। পরে ব্রজেন সেনের ৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

১৯৩৩ সালের জুন মাসে মাষ্টারদা, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্তকে নিয়ে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের তৃতীয় সাপ্লিমেন্ট কেস আরম্ভ হয়্ এর আগে ১৯৩২ সালের ১ মার্চ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার রায়ে ১৬ জন বেকসুর খালাস পায়। কিন্তু জেল গেটেই আবার বন্দী করা হয় অর্ডিন্যান্সবলে। অনন্ত সিং, গনেশ ঘোষসহ ১২ জনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়, অনিলবন্ধু দাসের পাঁচ বছর, নন্দলাল সিং-এর তিন বছর জেল।

১৯৩৩ সালের মে মাসে আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে দুপক্ষের গোলাগুলির পর তারকেশ্বর দস্তিদার, কল্পনা দত্ত ও ১৬ বছরের মনোরঞ্জন দাশ ধরা পড়েন। এই সংঘর্ষে আশ্রয়দাতা পূর্ণ তালুকদার ও তার ছোট ভাই নিশি তালুকদার গুলিতে নিহত হন। তৃতীয় মামলার রায়ে মাষ্টারদা সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদার-এর ফাঁসির হুকুম হয় এবং কল্পনা দত্তের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এরপরে একে একে সকলেই ধরা পড়েন। শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত ও কালিকিঙ্কর দে এই সময় ধরা পড়েন। এঁরাই তখন সংগঠন কিছুটা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

৬. মাষ্টারদার ফাঁসি ১২ জানুয়ারী, ১৯৩৪

বয়সে নবীন যাঁরা জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেয়ার প্রতিশোধ নেয় ১৯৩৪ সালের ৯ জানাুয়ারী গৈড়লা গ্রামের বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনকে হত্যা করে। এই সেনই মাষ্টারদার আশ্রয়স্থান সম্বন্ধে খবর দিয়েছিলো পুলিশকে। মাষ্টারদা সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দেয়া হয় এর তিনদিন পরেই ১২ জানুয়ারী রাত ১২টার সময় সমস্ত শহর ও জেলখানা মিলিটারী পাহারা রেখে।

৭. সূর্য সেনের মর্মস্পর্শী রচনা

পুলিশ সূর্য সেনের নিজের হাতে লেখা বিজয়া নামে এক মর্মস্পর্শী রচনা উদ্ধার করে। এই রচনার বিভিন্ন অংশ সরকার পক্ষ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় তাদের বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য এক্সিবিট ১৮৯, ১৯৯ ও ২০৫ হিসেবে উদ্ধৃত করে। সেই রচনার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো : ৯.১০.৩২ বিজয়া দিবস

……..আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে কত বিজয়াই তো এসে গেছে। কিন্তু আজকের বিজয়া আর অন্য বিজয়ার মধ্যে কত তফাৎ – এবারকার বিজয়া যেন সবচেয়ে মূল্যবান। জীবনে যা দেখিনি, জীবনে যা পাইনি, জীবনে যা শিখিনি এমন কত অভিনব জিনিস নিয়েই বিজয়া এল আজ আমার কাছে…।

আড়াই বছরের মধ্যে তিনটি বিজয়া এল, এর মধ্যে কত অন্তরঙ্গ বন্ধু, কত আদরের ভাই-বোনের জীবনের বিজয়াই চোখে দেখলাম — নরেশ, বিধু, টেগরা, ত্রিপুরা, মধু, প্রবাস, নির্মল, ভোলা সবারই কথা আজ একে একে মনে পড়েছে। কত জীবনের বিজয়ার নিমিত্তই না হলাম, কত স্নেহময়ী জননীর বুক শূন্য করে তাঁর সোনার পুতলিকে স্বাধীনতার বেদীমূলে আহুতি দিয়েছি, কতজনকে অন্তরীণে কারাগারে, নির্বাসনে, দ্বীপান্তরে পাঠিয়েছি….। এ সবের দায়িত্ব থেকে নিজেকে বাদ দেই কি করে ?

…… পনের দিন আগে যে নিখুঁত, পবিত্র, সুন্দর প্রতিমাটিকে এক হাতে আয়ুধ, অন্য হাতে অমৃত দিয়ে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলাম, তাঁর কথাই আজ সবচেয়ে মনে পড়েছে।… গত পনের দিন ধরে এক মুহূর্তের জন্য আমি তাঁকে ভুলতে পারি নি যাকে আমি নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুমতি দিয়েছিলাম।…. আজ বিজয়ার দিনে, সেই দিনের বিজয়ার করুণ স্মৃতি যে আমার মর্মে মর্মে কান্নার সুর তুলছে–চোখের জল যে কিছুতেই রোধ করতে পারছি না–সেই নিখুঁত, পবিত্র, সুন্দর প্রতিমা হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের অধ্যায় এখানে শেষ হয়।

আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এ-কথা বলেছিলেন মাষ্টারদা সূর্য সেন। সেই পথ ধরে আজকের বাংলাদেশ। বার বার মনে পড়ে এই বিপ্লবীর কথা অন্যায়ের প্রতিবাদে-প্রতিরোধে।

আবসার হাবীব: উন্নয়ন কর্মী