বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা

– বিজন সাহা

(৩)

বিজ্ঞান বলতে আমরা সাধারণত পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়ন এসবই বুঝি। কিন্তু বিজ্ঞান আসলে এর চেয়ে অনেক বড়। এর বিস্তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। পৃথিবী কি জানে যে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে? মনে হয় না। এটা আমরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেটা স্থির করেছি আর নিজেদের বোঝার সুবিধার জন্য সেটা গ্রহণ করেছি। আমরা যেমন বিভিন্ন ভাষায় কথা বলি, মানে মানুষের যেমন নিজের মনোভাব আদান প্রদানের জন্য ভাষা দরকার, বিজ্ঞানীদেরও তেমনি প্রকৃতির গতিবিধি, তার বিবর্তন বোঝার জন্য ভাষা দরকার। পদার্থবিদ্যার জন্য সেই ভাষা হল গণিত। সেদিক দিয়ে দেখলে পদার্থবিদ্যা বা গণিতের মত ভাষাও বিজ্ঞান। গণিতের বা পদার্থবিদ্যার যেমন নিজস্ব নিয়ম আছে, ভাষারও তেমনি নিজস্ব নিয়ম আছে  যাকে আমরা বলি ব্যাকরণ। গণিতের মত ভাষাও মানুষের তৈরি। এটা এ জন্যেই বলা, অনেকেই কিছু কিছু ভাষাকে অন্য ভাষার চেয়ে পবিত্র আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এটা ঠিক নয়। পরিবেশ, পরিস্থিতি একেক অঞ্চলে একেক ভাষার জন্ম দিয়েছে। ফলে আমরা দেখি কিছু কিছু অঞ্চলে এমন সব শব্দ আছে যেটা অন্য অঞ্চলে নেই। যেমন বাংলার ঝ আমরা যত সহজে উচ্চারণ করতে পারি, অন্যেরা সেটা পারে না। একইভাবে রুশ ভাষায় কিছু শব্দ অন্যদের উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়। মনে পড়ে মস্কোর দিনগুলোর কথা। ওখানে অনেক আরব দেশীয় ছাত্র ছিল। ওরা «পাইদিওম পাপিয়ম পিভা» মানে «চল বিয়ার খেতে যাই» বলতে পারত না, বলত «বাইদিওম বাবিয়ম বিভা»। পরে জেনেছি ওদের ভাষায় প জাতীয় কোন শব্দ নেই। এটা ভাল বা মন্দ নয়। ওরা নিজেদের ভাষাটা এমনভাবে তৈরি করেছে যেখানে প দিয়ে কোন শব্দ নেই। আর এর ফলে ওদের এক বিশিষ্ট উচ্চারণ ভঙ্গি গড়ে উঠেছে, যেমনটা হয়েছে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রুশ বা অন্যদের ক্ষেত্রে। কথাটা এ জন্যে বলা যে অনেকেই বিভিন্ন কারণে ভাষায় বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন আনতে চান আর সেটা করতে গিয়ে কখনই ভাষার উৎস ও তার বিবর্তনের ইতিহাস মাথায় রাখেন না। এটা শুধু যে ভাষার জন্য ক্ষতিকর তাই নয়, সেই অঞ্চলের মানুষের মানসিকতার জন্যেও ক্ষতিকর। কারণ ভাষা দিয়ে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে, তাই ভাষাটা যদি সহজাত না হয় সেটা এক ধরণের মানসিক চাপের সৃষ্টি করে। তাই আমরা যখন বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা বলি, সেটা শুধু আমাদের নাগরিক অধিকারের লড়াই ছিল না, ছিল জাতিসত্ত্বার লড়াই, এবং এক অর্থে বাইওলজিক্যাল বিবর্তনের লড়াই।

এর আগে পর্যবেক্ষণের কথা বলতে গিয়ে আমরা হরিপদ কাপালীর কথা বলেছিলাম। কৃষিতে আমরা পরে আবার ফিরে আসব। এবার ঘুরে আসা যাক আদিম যুগে। একটা সময় ছিল যখন মানুষকে জীবন ধারণ করতে হত বন্য জীবজন্তুর সাথে লড়াই করে। তবে এটাও ঠিক, তখন মানুষ নিজেই বন্য ছিল। তাদের খাদ্যের একমাত্র উৎস ছিল মাংস। তারা শিকার করত বন্য প্রাণী আর তাই খেয়ে জীবন ধারণ করত। কী দিয়ে তারা প্রাণী শিকার করত? পাথর দিয়ে। পাথর ছুঁড়ে তারা হত্যা করত এসব প্রানীদের। এখনও আমরা ছুঁড়তে হলে সবচেয়ে মসৃণ, গোলাকার পাথর বেছে নিই। তাই ধারণা করা যেতে পারে তারাও সেটাই করত। তখনই কেউ একজন খেয়াল করল নিজেদের হাতে ব্যথা লাগলেও ধারালো পাথর দিয়ে পশু শিকার অনেক সহজ। এটাই তাদের প্রেরণা দিল পাথর দিয়ে কুঠার তৈরি করার। আবারও আমরা দেখছি পর্যবেক্ষণ কত গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমাদের মনে হতে পারে এসব একেবারেই ছেলেমানুষি কাজ, তবে সেই সময় এটাও ছিল যুগান্তকারী আবিষ্কার।

আমাদের অনেকেই খাণ্ডবদাহনের কথা শুনেছি – কেউ মহাভারত পড়ে, কেউ বা শামসুর রহমানের কবিতায়। অথবা পড়েছি গ্রীক পুরাণে প্রমিথিউসের স্বর্গ থেকে আগুন  নিয়ে আসার কথা। অথবা এক সময় শুনেছি ইউরোপ আর আমেরিকার বনে দাবানলের কথা। বর্তমানে টিভি  আর ইন্টারনেটের কল্যাণে স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি বনে আগুন লাগার ঘটনা। হতে পারে তখন কোন পর্যবেক্ষক মানুষ দেখেছিল কীভাবে গাছে গাছে ঘর্ষণ আগুনের স্ফুলিঙ্গের জন্ম দেয়। আর সেখান থেকে সে বুঝতে পারে কাঠে কাঠে  বা পাথরে পাথরে ঘষা লাগিয়ে অগ্নুৎপাত করা সম্ভব। আমরা যে ম্যাচ ব্যবহার করি তার মূলেও কিন্তু সেই ঘর্ষণ। এভাবেই আমরা দেখি  কীভাবে কিছু কিছু মানুষের পর্যবেক্ষণ মানুষকে ধাপে ধাপে সামনের দিকে নিয়ে গিয়েছে। তবে এটা ঠিক, তখন শিক্ষা ছিল একমুখী, মানে মানুষ প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়া গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করত আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেরা অনুরূপ কিছু তৈরি করার চেষ্টা করত। সেক্ষেত্রে প্রকৃতি ছিল আমাদের শিক্ষক। তবে বর্তমানে মানুষ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। সে শুধু দেখেই শিখে না বা বলা চলে দেখে অনুরূপ কিছু করে না, নিজের জ্ঞানকে ব্যবহার করে নতুন অনেক কিছুই সে আবিষ্কার করে যা আগে ছিল না। কিন্তু আমরা যা কিছু করি সব কিছুকেই কি বৈজ্ঞানিক বলা চলে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের ভাবতে হবে সেটা প্রকৃতির সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিজ্ঞান যখন প্রকৃতির বিপক্ষে যায় সেটা বিজ্ঞান না বলে অপবিজ্ঞান বলাই শ্রেয়। এ নিয়ে আমরা আগের পর্বে কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছি।

বিজ্ঞান ভানার  ২য় পর্ব পড়তে নীচের লিংকে ক্লিক করুনঃ

বিজ্ঞান ভাবনা – ২

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া