মতামত

কলকারখানাগুলো যেন মৃত্যুফাঁদ, দায় কার?

– ফজলুল কবির মিন্টু

বিগত ৮ জুলাই বৃহস্পতিবার নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় ৫২ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশগুলো চেনারও উপায় নেই। এখন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে চিনে নিতে হবে কোনটা কার লাশ। “ও স্যার, আমার মায়ের হাড্ডিগুলি খুইজ্জা দেন” বলে যখন নিখোঁজ শ্রমিক তসলিমার মা ফিরোজা আর্তনাদ করে, তখন কী জবাব দেবে আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজ?

করোনার ছোবল থেকে বাঁচার জন্য দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন গৃহে অবস্থান করছিল তখন রূপগঞ্জের হতদরিদ্র মানুষগুলো জীবন ও জীবিকার সন্ধানে সেজান জুস কারখানায় কাজে যোগদান করেছিল। কর্মরত অবস্থায় ৫২টি তাজা প্রাণ পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। যাদের অধিকাংশের বয়স ছিল ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশের শ্রম আইনের সংজ্ঞা অনুসারে কোন শ্রমিকের ১৮ বছরের কম বয়স হলে তাদের শিশু শ্রমিক বলা হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ শ্রম আইন ও আইএলও কনভেনশন অনুসারে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার জাতি সংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সবধরনের শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ।

২০২০ সালের শুরু থেকে বিশ্ব আজ এক কঠিন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। করোনা অতিমারির কারনে সারা বিশ্ব আজ লন্ডভন্ড। জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। আমাদের দেশের মানুষও তাই সংকট থেকে মুক্ত নয়। বরং তারা জীবন ও জীবিকার উভয়মুখী সংকটে নিপতিত। করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের হত দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী তথা শ্রমজীবী মানুষ।

করোনার প্রথম ঢেউ এর আঘাত মোকাবিলা করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী তথা শ্রমজীবী মানুষ যখন নতুন করে পথ চলার স্বপ্ন দেখছিল তখন আবারো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর আঘাত আসলো। এসময় আমরা লক্ষ্য করলাম, করোনা থেকে বাঁচার জন্য সরকার একদিকে লকডাউনের কথা বলে অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার নামে জরুরী ও রপ্তানীমুখি পোশাক কারখানা সমূহ খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছিল। সেই সুযোগে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও প্রায় সকল কলকারখানাই খোলা ছিল। ফলশ্রুতিতে লকডাউন কার্যত প্রহসনে পরিনত হয়েছিল। সমালোচকরা একে ধনীর লক ডাউন আর গরীবের আপদ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকে। করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে সমাজের উঁচুতলার এবং নিচুতলার মানুষ গুলোর মধ্যে কী নিদারুন বৈষম্য বিরাজমান রয়েছে।

সম্প্রতি পত্র পত্রিকাগুলো ফায়ার সার্ভিসকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, বিগত ছয় বছরে দেশে প্রায় ৬ হাজার ৮১টি অগ্নিকান্ড ঘটেছিল এতে প্রায় ৩৭২ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল। উক্ত অগ্নিকান্ডগুলোতে কতজন শ্রমিক অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন তার উল্লেখ না থাকলেও ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের কেটিএস গার্মেন্টস এ ৫৭ জন, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে তাজরীন ফ্যাশনে অগিকান্ডে ১১২ জন এবং রানা প্লাজা ধ্বসে ১১৩২ জন নিহতের কথা নিশ্চয়ই সবার স্মরণ আছে। স্বভাবতই সকলের আশা ছিল রানা প্লাজা ধ্বসের পর সরকার, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ও কলকারখানার মালিক পক্ষের টনক নড়বে। কিন্তু সম্প্রতি বাঁশখালির গন্ডামারায় পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত শ্রমিকের রক্তের দাগ না শুকাতেই সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডের কারনে ৫২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যাওয়ার পর প্রমাণিত হয় আসলে সে আশা ছিল নিতান্তই দুরাশা।

সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডের পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে, বিল্ডিং কোড না মেনে কারখানা তৈরি করা। কারখানায় জরুরী বহির্গমণের পথ না থাকা। কারখানার অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র না থাকা, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ফায়ার ফাইটার ও উদ্ধারকারী দল না থাকা। সর্বোপরি আগুন লাগার পর কারখানা থেকে শ্রমিকদেরকে বাইরে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা না করে বহির্গমণ পথে তালা লাগিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।

সেজান জুস কোম্পানী কর্তৃক প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা সরকারী ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে বিল্ডিং কোড না মেনে কারখানা তৈরি করা শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যদিকে এত বড় নির্মম ঘটনার পরও মালিক যখন দম্ভ করে বলে, “কারখানা থাকলে আগুন লাগবে, আর আগুন লাগলে শ্রমিক মারা যাবে, এতে আমার কী দোষ?” তখন সারা দেশের বিবেকবান মানুষ বিস্মিত ও হতবাক না হয়ে পারেনা।

৮ জুলাই এর অগ্নিকান্ডের ঘটনার জন্য যেমন সেজান জুস কারখানার মালিক পক্ষের দায় রয়েছে তেমনি কারখানা বিল্ডিং এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা, অগ্নি নিরাপত্তা তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরক অধিদফতর সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরকারী দফতরগুলোও দায়িত্ব এড়াতে পারেনা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলো আজ দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে। সচেতন জনগন মনে করে, বিল্ডিং কোড না মেনে কারখানা পরিচালিত হওয়ার দায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের। অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র, ফায়ার ফাইটার এবং উদ্ধারকারী দল ছাড়া কারখানা পরিচালিত হওয়ার দায় ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স বিভাগের। আগুনের মাত্রা দেখে সহজেই অনুমেয় যে, সেজান জুস কারখানায় বিস্ফোরক দ্রব্য ও অতিমাত্রার দাহ্য পদার্থ ছিল, যার দায় বিস্ফোরক অধিদফতর কোনভাবে এড়াতে পারেনা। এখানে আরো লক্ষণীয় বিষয়, বিভিন্ন ফলের জুস উৎপাদনের এই কারখানায় ফলের ভরা মৌসুমেও কোন আম বা অন্য কোন ফলের চিহ্ন পর্যন্ত ছিলনা। এতে প্রমাণিত হয় যে, কিছু ক্যামিকেলে বিভিন্ন ফলের ফ্লেবার দিয়ে জুস হিসাবে বিক্রি করে সাধারণ মানুষকেও তারা ধোঁকা দিচ্ছে- যা মানব শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকারকও বটে।

দেশের কলকারখায় দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে রূপগঞ্জের অগ্নিকান্ডের ঘটনার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ী সকল পক্ষকে চিহ্নিত করে বিশেষ ট্রাইব্যনালের মাধ্যমে দ্রুত বিচার হওয়া জরুরী। একই সাথে আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুসারে নিহত শ্রমিকদের লস অফ ইয়ার আর্নিংস হিসাব করে আজীবন আয়ের সমপরিমান অর্থ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদেরও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করে যথাযথ ক্ষতিপূরন পাওয়া নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রের। এর জন্য প্রয়োজনে বর্তমান শ্রম আইনের ক্ষতিপূরন সম্পর্কিত ৫ম তপসিল সংশোধন করতে হবে।

সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকান্ডের পর সারা দেশের কলকারখানা সমূহে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শংকা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় মালিক, শ্রমিক এবং সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি নিরপেক্ষ টাস্ক ফোর্স গঠন করে সারা দেশের কলকারখানা সমূহ পরিদর্শন করে শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সমূহ অপসারণ করে কারখানাগুলোকে নিরাপদ করতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শ্রমিকদেরকে নিজ নিজ কর্মস্থানে কথা বলার অধিকারের সুযোগ করে দেয়া। কারণ কথা বলার সুযোগ থাকলে শ্রমিকেরা নিজেরাই তাদের কর্মস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি কারখানা ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনায় কোন ত্রুটি বা অনিয়ম হলে তাও সংশোধনের সুযোগ থাকবে। যা একটি সুস্থ শিল্প সম্পর্ক রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসরণ করে প্রত্যেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দেয়া উচিৎ।

দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ শিল্প শ্রমিক রয়েছে। জীবন বাঁচাতে, জীবিকার সন্ধানে হতদরিদ্র শ্রমিকেরা কাজের সন্ধানে কারখানায় যায়। কিন্তু কারখানাগুলো আজ মৃত্যুফাঁদে পরিনত হয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজ এর দায় এড়াতে পারেনা।

কেটিএসে ৫৭, তাজরীনে ১১২, রাণা প্লাজায় ১১৩২ জন শ্রমিকের মৃত্যু! আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের বিবেককে নাড়া দিতে পারেনি, আজও বন্ধ হয়নি কলকারখানায় শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিল। বরং সর্বশেষ শিকার হলো রূপগঞ্জে ৫২ জন শ্রমিক।

বাংগালীর জাতীয় জীবনে ৫২ এর একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ৫২ বাংগালীকে সাহস দেয়, শক্তি দেয়, আবেগে আপ্লুত করে। ৫২তে আমরা ভাষার জন্য লড়াই করে জয়ী হয়েছি। ৫২’র পথ ধরে আমরা ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থাণ, ৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি।

৫২’র চেতনাকে ধারন করে, এদশের শ্রমজীবী মানুষ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে নিরাপদ কর্মস্থল ও তার ন্যয় সংগত সকল অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে এমনটাই প্রত্যাশা…………

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি