মতামত

করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজন দেশীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশল 

– মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

গত বছরের ৮ মার্চ এদেশের মানুষ হঠাৎই করোনা নামীয় এক অদেখা দানবের সাথে প্রথম পরিচিত হয়। প্রথমটায় এই অদৃশ্য দানবের শক্তিমত্তা আঁচ করতে না পারলেও ১০ দিনের মাথায় যখন সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় আর ক্রমেই কলকারখানা, অফিস আদালত, গাড়ির চাকা কিংবা উড়োজাহাজের পাখা সবকিছুই স্তব্ধ হয়ে যায়, তখনই করোনা হয়ে যায় এদেশের মানুষের কাছে আর সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই একটি মানবিক বিপর্যয়ের নাম। এই করোনা ভাইরাস আতংক ধীরে ধীরে সারাবিশ্বের মতো এদেশের মানুষের চোখেমুখে শঙ্কা লেপ্টে দিলেও বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা  চলতে থাকে সমানভাবে।

করোনা বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে পুরো বিশ্ব এক ধরণের কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির চাকা আক্ষরিক অর্থেই প্রায় স্থির হয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল দাবিদার রাষ্ট্রগুলোও চলার গতির ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। বলতে গেলে সারাবিশ্ব যেনো করোনা মহামারীর কাছে স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি প্রতিদিন মৃত্যুর পরিসংখ্যান চিত্র পরিবর্তন করে চলেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা যানবাহন সময়ে সময়ে অল্পকালের জন্য খুলে দিলেও ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফ এর তথ্যমতে বাংলাদেশের মতো কয়েকটি দেশ একদিনের জন্যও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেনি। এর ফলে একটি প্রজন্ম যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  সচেতন নাগরিক মাত্রেরই এটি উদ্বেগের কারণ।  তবে এ কথা সত্য যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান  খুলে দেওয়ার দাবি জোরদার হচ্ছে। কিন্তু খুলে দাও বললেই তো আর খুলে দেওয়া যায় না। অন্তত যেখানে করোনা সংক্রমণের হার বিশ্বব্যাপী উর্ধ্বমুখী। কিংবা করোনার প্রতিষেধকও যেখানে সহজলভ্য এবং শতভাগ কার্যকর বলে দাবি করা যাচ্ছে না।

এদিকে,  করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশ্ববাসীর আস্থার ঠিকানা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) যে অনুমানে পথ চলছে, তা এক রকম নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। এ কারণেই কার্যত বিশ্ববাসীকে সত্যিকার অর্থে আশার আলো দেখাতে পারছে না স্বাস্থ্যবিজ্ঞানও। প্রতিনিয়ত ধরন পাল্টানো করোনাভাইরাস যে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তাতে অন্তত আর কারো দ্বিধা নেই। আর এ কারণেই করোনা প্রতিরোধে নতুন করে ভাবার অবকাশ আছে বলে মনে করি।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে একটু বেশিই পরিচিত। উপকুলবর্তী হওয়ায় এদেশের মানুষকে বারংবার ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষসহ নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। দূর অতীত কাল থেকে এ সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের  শিকার হয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে এক অপার সহ্যশক্তি তৈরি হয়ে গেছে। ফলতঃ এসব প্রাকৃতিক  বিপর্যয়ের কারণে বার বার অপরিসীম  ক্ষয়-ক্ষতি,  লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানীসহ বিপুল পরিমাণ বন্য ও গৃহপালিত পশু-পাখির জীবননাশের ঘটনা আমাদের দিয়েছে অপরিসীম প্রাণশক্তি আর অপরিমেয়  সাহস। ঘরবাড়ি হারিয়েও তাই মানুষ আবার গড়ে নিয়েছে নিজের মাথাগোঁজার ঠাঁই, ছন্নছাড়া হয়েও আবার হয়েছে সংসারী, প্রিয়জন হারিয়েও খুঁজে নিয়েছে বাঁচার অবলম্বন। এই অমিয় প্রাণশক্তির উৎস আর কিছুই নয়, বাঙালির হাজার বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর নিজস্ব উদ্ভাবনী কৌশল।

তাই বর্তমান কালের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ করোনা প্রতিরোধে দেশীয় দুর্যোগব্যবস্থাপনা কৌশল প্রয়োগ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করি।

করোনা দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রচেষ্টায়, ছাত্রসমাজ, কিশোর ও তরুণ,  জনপ্রতিনিধি,  প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল,  সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, এনজিও সহ  বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যে কোন ন্যায় সংগত আন্দোলন সংগ্রামে  ছাত্র ও যুব সমাজের ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই করোনাকালেও তারা বেশ কার্যকরী  অবদান রাখতে পারে।  এই বয়সীদের সহনশীলতা ও শক্তি সাধারণত বয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এই শক্তিকে কাজে লাগানোর ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ ফল বয়ে আনবে সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের সকল দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের কাছাকাছি গিয়ে, তাদের জাগানোর কাজটি তো আগেও এদেশের ছাত্রসমাজই করেছে। তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়,  করোনাকালে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সচেতন করতে পারে তারাই।

উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে- শিক্ষার্থীরা নিজেরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরে,সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদেরকে মাস্কপরা বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। হাটবাজার, লোকালয় ইত্যাদি জনসমাগম হয় এমন স্থানে প্রচারণা চালাতে পারে। এভাবে সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, এলাকার কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে নিজেরা নিরাপদে থেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কিংবা কেউ করোনায় মারা গেলে তার সৎকারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পারে ছাত্রসমাজ। এই কাজটি বাংলাদেশ স্কাউটস,  রোভার স্কাউটস,  গার্লস গাইড, রেডক্রিসেন্টের সদস্যরাও করতে পারে। এসব সংগঠনের সদস্যরা  প্রশিক্ষিত বিধায় তাদের দিয়ে আরো বেশি সুচারুভাবে এই ধরনের সেবামূলক কাজগুলো করা সম্ভব। এছাড়াও সেবার যে ব্রত নিয়ে এসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে তারা যোগ দিয়েছে,  তা বাস্তবায়নে এর চেয়ে মোক্ষম সুযোগ আর নাও আসতে পারে। এছাড়াও করোনাকালে কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে ছাত্ররা দাঁড়াতে পারে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে  ত্রাণকার্য শুরু হয়েছে এ কথাটি যেমন সবার জানা তেমনি ত্রাণ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ডের বিষয়টিও কারো অজানা নয়। তাই নানা উৎস থেকে আসা ত্রাণ যেনো যথার্থভাবে পরিচালিত হয় সে ব্যাপারেও  ছাত্র-যুব সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে। দায়িত্বশীল মহল থেকে তরুণদের নিয়ে এলাকা বা ওয়ার্ড ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের উদ্দেশ্যে একটি দল গঠন করা যেতে পারে। যারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে মহামারী করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করবে।

করোনাকালে করণীয় সম্পর্কে তরুণেরা যাতে অন্যদের শেখাতে পারে, সে জন্য তাদের প্রয়োজন মতো প্রশিক্ষণও দেওয়া যেতে পারে। এতে তারা দুর্যোগকালীন জরুরি পরিস্থিতিতে সেবামূলক কাজে কার্যকরভাবে অংশ নিতে পারবে।

দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিগণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। এটি গ্রামীণ অঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, পৌর  ও নগর পর্যায়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য পর্যন্ত যুক্ত থাকতে পারেন।

দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলতে গেলে,  কোন এলাকায় করোনা রোগী পাওয়া গেলে ঐ রোগীকে দ্রুততম সময়ে শনাক্ত করা থেকে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত যাবতীয় কার্যক্রমে প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বা ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে পর্যায়ক্রমে উর্ধতন পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

রোগীর জটিলতার ধরন বিবেচনা করে প্রয়োজনবোধে স্থানীয় সংসদ সদস্যও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ এভাবেই আমরা সুদীর্ঘকাল ধরে মোকাবেলা করে আসছি। একইভাবে করোনা আক্রান্ত এলাকায় সর্বসাধারণের যাতায়াত সীমিতকরণের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করাও সম্ভব হবে।  তাহলে পুরো দেশ লকডাউন বা শাটডাউনের মতো ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু আক্রান্ত এলাকায় নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে পুরো দেশের অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সচল রাখা সম্ভব হতে পারে।

করোনা মহামারী যেমন সত্য, তেমনি মানুষের সম্মিলিত শক্তি দ্বারা এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে মানুষের বিজয় গাঁথা রচনা করা সম্ভব,  এ কথাটিও বিশ্বাস করতে হবে। তবে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের হাজার বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর কৌশলকে কাজে লাগাতে হবে, এই সত্যকেও মানতে হবে।

লেখকঃ প্রক্তন অধ্যক্ষ ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি