রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (১ম পর্ব) -অধ্যাপক সুস্নাত দাশ
।।প্রথম পর্ব।।
বিশিষ্ট বৃটিশ লেখক ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ল্যাস্কির দৃষ্টিতে “রুশ বিপ্লব হল খ্রিস্টের জন্মের পর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়”। এই বিপ্লবের নেতা ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিনিয়ানভ। যিনি সারা বিশ্বে মাত্র তিনটি অক্ষরে পরিচিত। লে নি ন। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠিতে (১৯৩০) তুলে ধরা হয়েছিল রুশ বিপ্লব সম্পর্কে কবির অনুভবঃ “ রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোন দেশের মতই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলেছে ……… আপাতত রাশিয়ায় এসেছি –না এলে এ জন্মের তীর্থ দর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত। এখানে এরা যা কান্ড করছে তার ভালো মন্দ বিচার করার পূর্বে সর্বপ্রথমেই মনে হয়, কী অসম্ভব সাহস- সনাতন বলে পদার্থটা মানুষের অস্থি-মজ্জায় মনে-প্রাণে হাজারখান হয়ে আঁকড়ে আছে, তার কত দিকে কত মহল, কত দরজায় কত পাহারা, কত যুগ থেকে কত ট্যাক্সো আদায় করে তার তহবিল হয়ে উঠেছে পর্বত প্রমাণ। এরা তাকে একেবারে জট ধরে টান মেরেছে; ভয় ভাবনা সংশয় কিছুই মনে নেই। সনাতনের গদি দিয়েছে ঝাঁটিয়ে, নতুনের জন্য একেবারে নতুন আসন বানিয়ে দিলে।“
কিন্তু একটা পার্থক্য ছিল। লেনিন যে রাশিয়ায় ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন তা রবীন্দ্রনাথের দেখা রাশিয়া ছিলনা। ১৮৭০ থেকে ১৯৩০ এই অর্ধ-শতাব্দীকালে রাশিয়া বদলে গিয়েছিল অনেকটা। রাশিয়া ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনশ বছর ধরে ছিল রোমানভ বংশীয় জারদের শাসনাধীন। জারতন্ত্রের শাসনাধীনে রাশিয়া মধ্যযুগীয় সুবিধা বর্জন করে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে। কিন্তু সাধারণভাবে জারদের শাসনব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ রক্ষণশীল, সম্পূর্ণ কেন্দ্রীভূত ও স্বৈরতন্ত্রী। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি ঘটাতে থাকে তখন রাশিয়াতে ছিল সেই প্রাচীন স্বৈরাচারী ও কেন্দ্রীভূত শাসন। আর শাসকদের সে অন্ধবিশ্বাস। কেবল সামন্ততান্ত্রিক বললে রাশিয়ার অবস্থা পরিষ্কার করে বুঝানো যাবেনা। রাশিয়া ছিল কৃষিপ্রধান, তার জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল কৃষক। তাদের মধ্যে আবার বিপুল গরিষ্ঠ লোক ছিল ভূমিদাস বা সার্ফ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে রাশিয়া ছিল আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ধনতান্ত্রিক। শিল্পায়নের উদ্যোগ জার নিলেও, তা তখনও ছিল অসম্পূর্ণ। দ্বিতীয়ত মধ্য এশিয়ার কিছু অংশে ও পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রাশিয়ার উপনিবেশ থাকলেও, তার এত শক্ত ভিত্তি ছিল না যে রাশিয়ার ঘনীভূত অর্থনৈতিক সংকট তা সামলাতে পারে। জারতন্ত্র সার্ফ বা ভূমিদাসদের মুক্তি দিতে ঘোষণা করেছিল (১৮৬১); কিন্তু তা সামন্তপ্রভু ও অভিজাতদের কলকাঠিতে সফল হতে পারে নি। এই অবস্থায় রাশিয়া একের পর এক যুদ্ধে হারতে শুরু করে। ১৯০৫-এ পরাজিত হয় জাপানের কাছেও । সেনাবাহিনী-শ্রমিক ও সর্বোপরি কোটি কোটি কৃষক জনতার বিদ্রোহের মুখে পড়তে হয় গোটা জারতন্ত্রকে। নিহিলিস্ট সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন (১৮৮১) তথাকথিত ‘মুক্তিদাতা জার’ দ্বিতীয় আলেকজান্ডার । জারের এই শোচনীয় মৃত্যুর পর দ্বিতীয় নিকোলাস(১৮৯৪-১৯১৭) সিংহাসন আরোহন করেন। পিতার স্বৈরাচারী প্রতিক্রিয়াশীল নীতিকে দ্বিতীয় নিকোলাস আরও শাণিত উপায়ে কার্যকরী করেন। জারের স্বৈরতন্ত্রী, অভিজাত ও সামন্ত শ্রেণির বিশেষ অধিকার, কৃষক তথা ভূমিদাস শ্রেণির উপর নির্যাতন ও শোষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে এবং রাশিয়াতে সাংবিধানিক শাসন, ভোটাধিকার ও সংসদীয় ব্যবস্থা, ভূমি সংস্কার ইত্যাদি প্রবর্তনের জন্য নানা ধরনের বিদ্রোহ ও আন্দোলন রাশিয়ার সর্বত্র দেখা গিয়েছিল। যেমন প্রথম নিকোলাসের আমলে ঘটেছিল ডিসেমব্রিস্টদের বিদ্রোহ (১৮২৫ খ্রিস্টাব্দ) আর জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলে সশস্ত্র বিল্পববাদী বা সন্ত্রাসবাদী’ নিহিলিস্ট’ (Nihilist) এবং ‘নারদনিক’ (Narodnik) আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষপটে লেনিনের নেতৃত্বে ১৯০৩ এ গড়ে উঠেছিল রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্ট (বলশেভিক) যা ১৯১৭-র নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে কমিউনিস্ট পার্টি রূপে পরিচিত হয়।
যাইহোক একশো বছর আগে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার জন্ম পরে যা ক্রমশ সোভিয়েত ইউনিয়ন অব রিপাবলিকসে পরিনত হয় –আজ তার অস্তিত্ব শুধুমাত্র ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। ‘সোভিয়েত’, ‘সমাজতন্ত্র’ প্রভৃতি শব্দগুলি রাশিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমানে আর যুক্ত নয় কিন্তু যে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার জন্ম তার আলোচনা প্রয়োজনীয়তা প্রাসঙ্গিকতা আজও অমলিন। এর প্রথম কারন পাশ্চাত্যের মানদণ্ডে একটি দুর্বল এবং অনগ্রসর দেশ বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমেই মাত্র অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। যার ফলে ঠাণ্ডা লড়াই-এর সূচনা হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ হল ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতবর্ষ তথা তৃতীয় বিশ্বের আফ্রো-এশিয়-ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির মুক্তি-সংগ্রামে প্রেরণা সৃষ্টি করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তবে নভেম্বর বিপ্লবের রূপকারদের মধ্যে নানা তাত্ত্বিক বিষয়ে বিতর্ক ও মত পার্থক্য ছিল। যেমন, লেনিনের কাছে সর্বহারার সাধারণ ইচ্ছা মানেই বেশিরভাগ সর্বহারা মানুষের সার্বিক ভাবনা নয়- কেননা তারা কেবলমাত্র তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং সুযোগ সুবিধা নিয়েই ভাবিত। বরং তারা যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ সম্পর্কে সঠিক মার্ক্সীয় বিশ্লেষণের সঙ্গে পরিচিত হতে পারতো তাহলেই তারা ওই সাধারণ ইচ্ছাকে অর্থবহ করে তুলতে পারত। তাছাড়া লেনিনের এই মত- ‘কতিপয় পেশাদার বিপ্লবীর হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা থাকবে’ –বিচার করে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ট্রটস্কি বলেন, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র সম্পর্কে লেনিনের তত্ত্ব বাস্তবে বোঝাত সর্বহারার উপর একনায়কত্বকে।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের আগে ও পরে এইভাবে গণতন্ত্র বনাম কেন্দ্রীকতার লড়াই -এর প্রশ্নটি কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯০৪ সালে ট্রটস্কি ভবিষ্যদবাণী করেছিলেন যে “লেনিন যদি ক্ষমতায় আসেন তাহলে মার্কসের সিংহসদৃশ মস্তকটি প্রথম গিলোটিনে যাবে’ (“The Leonine head of Marx would be the first to fall under guillotine”) কিন্তু তা হয়নি; বরঞ্চ মার্কসবাদকে লেনিন নিজের মৌলিক চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ করেছিলেন। লেনিনবাদ রুশ বিপ্লবের সাফল্যের নিরিখে গোটা বিশ্বে কমিউনিস্টদের কাছে স্বীকৃত হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল লেনিনের রাশিয়া কি সমাজতান্ত্রিক হতে পেরেছিল?
-চলবে-
লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।