মতামত

পাপ পুণ্য ন্যায় অন্যায়

-বিজন সাহা

বিজন সাহা

আমরা প্রায়ই উপমহাদেশের শিক্ষা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করি। এর পেছনে যথার্থ কারণ আছে। আমরা মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এসব নিয়ে বলি, তবে পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে তেমন কিছু বলি কি? আমার মনে হয় শুরুটা এখানেই করা উচিৎ আর সেটা করা উচিৎ এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কী সেটা? পাপ আর পুণ্য বা গুনাহ আর ফরজ।

শিশু স্কুলের গণ্ডীতে পা দেবার অনেক আগে থেকেই পাপ পুণ্যের কথা শোনে। পাপ পুণ্যের কথা বলা খারাপ কিছু নয় যদি না সেটা প্রচলিত সামাজিক বা মানবিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করে। পাপ পুণ্য আর ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে এর ফলে এক বিশাল ফারাক দেখা দেয়। পরবর্তীতে অনেকেই এই ফারাক হয় ঠিকমত বুঝতে পারে না আর পারলেও ঠিক কোন পক্ষে যেতে হবে সেটা ঠিক করতে পারেনা। যেমন ধরুন প্রায় সকল শিক্ষিত মানুষই জানে বর্ণাশ্রম একটা অন্যায় প্রথা তারপরও সামজিক কারণে অনেকেই সেটা ভাঙ্গতে পারে না। খুন বা লুট করা অন্যায় জেনেও বিধর্মীকে খুন করা বা তার বাড়ি লুট করা অনেকেই পুণ্য বলে মনে করে।

বিচারের একটা প্রধান উদ্দেশ্য অপরাধীকে আইনের পথে আনা, তাকে সংশোধন করা। কিন্তু সে যদি তার অপরাধকে অপরাধ বলেই মনে না করে, সেটা বুঝতে না পারে – তাকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনা আদৌ সম্ভব কি? বরং উল্টো সে জন্মের পর থেকে যেটা ঠিক বা পুণ্যের কাজ বলে মনে করে এসেছে সেটাকেই যদি পরবর্তীতে ভুল বলা হয়, সঠিক ভাবে তাকে পাপ পুণ্য আর ন্যায় অন্যায়ের মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কথা বুঝিয়ে না বলা হয় সে আজীবন এই দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ভুগবে। আমাদের সমাজে নারীদের যে অবস্থান সেটাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ন্যায় অন্যায়ের পরিবর্তে পাপ পুণ্যের মাপকাঠিতেই ঠিক করা হয়।

তবে এখানেই শেষ নয়। পাপ পুণ্য যদি ধর্মীয় ধারণা হয়, ন্যায় অন্যায় – সামাজিক, মানবিক। এরপরেও আছে রাষ্ট্র – যেখানে শেষ কথা আইন। অনেক ক্ষেত্রেই যেটা আইনসম্মত সেটা সামাজিক দৃষ্টিতে ন্যায্য নাও হতে পারে। যার ফলে অনেক সময় আইনের শাসন সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। ইউরোপ আমেরিকায় আইনের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। রাশিয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে ন্যায়বিচার আইনের ঊর্ধ্বে। এটাও এক ধরণের মানসিকতা। আর এ কারণেই হয়তো আইনের প্রতি তাদের আস্থা কম। যদি ন্যায় অন্যায় অনেকটাই আবেগের সাথে জড়িত তবে আইন চলে বইয়ের লিখনী অনুসরণ করে। তাই ইউরোপ আমেরিকায় বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা যতটা রাশিয়ায় ততটা নয় – কারণ অনেক সময় আইনের বিচার তাদের ন্যায়বিচারের ধারণার সাথে মেলে না। আমাদের সব দেশে অবস্থা আরও শোচনীয়। আইনের পাশাপাশি ন্যায় অন্যায় তো বটেই পাপ পুণ্যের হিসাব নিকাষও এর সাথে যোগ হয়।

তাই শুধু আইন করে আইনের শাসন প্রনয়ণ করা সম্ভব নয় যতদিন না পাপ পূণ্য ন্যায় অন্যায়ের সংজ্ঞার পারস্পরিক সংঘর্ষ দূর করা হয় আর সেটার সাথে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের হারমনি খুঁজে বের করা যায়।

কিন্তু এটা করা কি এতই সহজ? আমি রাশিয়ার কথা বলতে গিয়ে বলেছি আইন আর ন্যায়বিচারের কথা। সেখানে পাপ পুণ্যের কথা আসেনি। রুশ সাহিত্য পড়ে বোঝা যায় এক সময় সেখানকার মানুষও ধর্মপ্রাণ ছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর ৭১ বছরের কমিউনিস্ট শাসনে সেখান থেকে পাপ পুণ্যের ধারণা উঠে যায়। পাপ পুণ্যের কথা যে কেউ বলে না তা নয়, তবে কোন অন্যায়কে পুণ্য বলে চালিয়ে দেওয়ার ধর্মীয় অনুশাসনের কথা আমার অন্তত জানা নেই।  ইউরোপের কথা যদি বলি সেখানে ঐতিহ্য এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। ভালমন্দের বিচার শুধু আইন দিয়ে হলেও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বলে একটা ব্যাপার থেকেই যায়। আমেরিকার কথা আলাদা। হতে পারে ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ডেও একই অবস্থা। কারণ এসব দেশে তারা বলতে গেলে স্থানীয় জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে নতুন যাত্রা শুরু করেছিল। স্থানীয় জনগণের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল প্রচলিত ন্যায় অন্যায় পাপ পুণ্যের বিশ্বাস। এখানে যারা নতুন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে তারা প্রায় সবাই বনিক শ্রেণীর। ধর্ম নয়, অর্থই ছিল তাদের উপাস্য দেবতা। আর সে জন্যেই তারা নিজেদের মত লিখেছে আইন। যেহেতু এদের প্রায় সবাই ইউরোপের সামন্তবাদী সমাজ থেকে মুক্তি পেতে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা তাদের কাছে ছিল একমাত্র না হলেও অন্যতম আরাধ্য। তবে সেটা নিজেদের জন্যে। যাদের শ্রমের উপর গড়ে উঠেছিল তাদের সম্পদের পাহাড় তাদের স্বাধীনতা নিয়ে এদের কোনই মাথাব্যথা ছিল না। আর এ কারণেই দাসপ্রথা ছিল সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ। এখন সময়ের সাথে মানসিকতা বদলেছে, নিজেদের দেশের মানুষের কাছে সবার জন্য গণতন্ত্র, সমান অধিকার – এসব ধারণা সামনে চলে এসেছে। কিন্তু তারা কি সত্যই গণতন্ত্র, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এসব নিজেদের মনে ধারণ করে? আমেরিকার গণ্ডী  পেরুলেই আমরা দেখব, ভিন দেশের মানুষকে তারা মানুষই মনে করে না। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের নীতি এখন আমেরিকাতেই ফিরে আসছে। বিএলএম সহ বিভিন্ন আন্দোলন পারত পক্ষে কোন কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হলেও সেটা ইতিমধ্যে রাজনৈতিক গণ্ডী  পেরিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। বিভিন্ন সময়ে আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট ইত্যাদি উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসী সংগঠন সৃষ্টি  করে আমেরিকা শত্রুকে রোধ করতে সমর্থ হয়েছিল বটে, তবে এখন এরাই আমেরিকার উপর এক হাত নিচ্ছে। তাই প্রচলিত আইন যে শেষ কথা নয় এটাও সত্য। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে সমাজে যে পাপ পুণ্য ন্যায় অন্যায়ের ধারণা আছে সেসব মাথায় রেখেই আইন তৈরি করতে হবে আর ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একই ভাবে সেই আইনের প্রয়োগ করতে হবে। তবে আইন এমন হতে হবে যেন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সে আইন সমান হয়।  কারণ আইনের কাজই হল মানুষের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা তার জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নয়।

দুবনা, ২১ জুন ২০২১

বিজন সাহা – গবেষক ও শিক্ষক
জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফোর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা, রাশিয়া
গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া