শিল্প সাহিত্য

মধ্যসত্ত্বভোগী আল মাহমুদ : দুই

– শোয়েব নাঈম
কবি আল মাহমুদ (ফাইল ছবি)

“যুদ্ধের নয় মাস কোলকাতায় অবস্থানকালে আমার প্রধান নেশাই ছিল কোলকাতাকে জানা… ” – আল মাহমুদ ।

যিনি কোলকাতাকে জানাটাই তার নৈতিক দায়িত্ব ভেবেছিলেন, আর সেই শহরকে বেশি ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধ থেকে নয়মাস  দূরে থাকাটাই কর্তব্যজ্ঞান করেছেন,তার চরিত্র থেকে একজন ‘মধ্যসত্ত্বভোগী’ এক মানবের বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব হওয়াটাই তো স্বাভাবিক!

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী জীবনে রব-জলিলকে ফুলের মালা দিয়ে ১৯৭২ এ জাসদের ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক পদ বাগিয়ে সমাজতন্ত্রের পথে যাওয়ার দ্বীপ্ত ঘোষণা দিয়েই শুরু করলেন তার বৈষয়িক প্রাপ্তির ক্যারিয়ার।

ক্রমাগত রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িয়ে একবার জেলে গেলে পরেরদিন জেল থেকে ছাড়িয়ে আনেন, টেলিফোন করে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই শিল্পকলা একাডেমীর উপ-পরিচালক পদে বঙ্গবন্ধু তাকে চাকুরীতে নিয়োগ দেন এবং পদোন্নতির ফলে শিল্পকলার একাডেমীর পরিচালকও হন, আর এতে মহাখুশীতে রব-জলিল-জাসদ-সমাজতন্ত্র ভুলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর গলায় ফুলের মালা দিয়ে ‘বাকশাল’-এ হাসিমুখে যোগ দেন। আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখে ফেলেন মোটা এক উপন্যাস – ‘কাবিলের বোন’ !

১৫’ই অগাস্ট নৃশংস সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে ‘বাকশাল’ ভুল ঘোষণা দিয়ে জিয়ার সাথে হ্যান্ডশেক করতে চলে যান এবং হাতে হাত মিলিয়ে আরো বেশি সুবিধাবাদে উদ্বুদ্ধ হন !  জিয়াউর রহমানের ‘জাসাস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ নির্মাণে । জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি পূর্বের থেকে আরও বেশী ধনে অর্থে আয়েসে জীবনযাপন করতে লাগলেন ! এবার কৃতজ্ঞচিত্তে জিয়াকে নিয়ে লিখলেন একটি গল্প- ‘তৃষিত জলধি’ !

জিয়াউর রহমান সামরিক ক্যু হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে লে.জে.হো.মো. এরশাদ! ক্ষমতার মোহে এরশাদও হয়ে গেলেন রাতারাতি একজন’কবি’ ; আর আল মাহমুদ সেই সুযোগটি নিয়ে হয়ে গেলেন স্বৈরাচারী এরশাদের রাজসভার প্রধানতম কবি ! এরশাদকে তোষামোদ করে করে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ এবং ‘দৈনিক বাংলা’- তে কলাম লিখে সৈরাচারী এরশাদকে বাংলাদেশের একজন ‘কবি’ বানিয়ে বাগিয়ে নিলেন গুলশান আবাসিক এলাকায় রাজ-উপঢৌকন , গুলশানে আল মাহমুদের অট্টালিকা!

ক্রমাগত অধঃপতিত যুগে এরশাদ ‘ইসলাম’ নিয়ে সমাজে রাষ্ট্রে সরাসরি রাজনীতি শুরু করলে তিনি ঐ সুযোগের আরেকটা সদ্ব্যবহার করলেন। এবার জামাত-ই ইসলামের সাথে গোপনে বৈষয়িক দফারফার ভিত্তিতে ডিগবাজি দিলেন। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার রক্ষার কৌশল নিয়ে ‘ইসলাম’ রক্ষার ঘোষণা দিলেন এবং জামাত তোষণ করে করে জামাত-ই অর্থায়নে গদগদ হয়ে নিজেকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভেবে যুদ্ধাপরাধীদের তুষ্ট করে লেখে ফেলেন ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ ।

যে ‘সোনালি কাবিন’-এ  বৈশ্বিক আবেদন নিয়ে একদা লিখেছেন –

“গাঙের ঢেউয়ের মত বল কন্যা কবুল কবুল”…. সেই সোনালী কাবিনের কবি যখন জামাত-ই ইসলামের টাকায় ‘ইসলামী’ হয়ে যান সুচতুরভাবে, প্রাপ্তির লোভে, তখন ৮১ বছরে তার মৃত্যুকে গতানুগতিক-নিত্যনৈমিত্যিক-বোরিং ঘটনা মনে হওয়ার পাশাপাশি ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠাটাও স্বাভাবিক ।

আল মাহমুদ আজীবন ছিলেন সুবিধা আদায়ের এক মধ্যসত্ত্বভোগী কবি, সেই মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত । তার কোনো একটি কবিতাও নেই যা এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের অধিকার আন্দোলনকে ধারণ করেছে, গণচেতনাকে প্রভাবিত করেছে। যা লিখেছে তা সবই একই ধাচের এবং যতটুকু লিখেছে সবসময়ই নিজের স্বার্থ আর সুবিধা বিবেচনায় রেখে, যিনি মধ্যসত্ত্বভোগীর সুবিধাবাদী চরিত্র নিয়ে সারাজীবন শুধু নিজেকে বিবর্তন করেন আর প্রাপ্তি ঘটান ঐশ্বর্যের!

( চলবে….)

পর্ব – তিন,  ২১ জুন ‘২১সোমবার প্রকাশ করা হবে