শিল্প সাহিত্য

দানবদঙ্গল

আলী সিদ্দিকী

সুরি একপ্রকার জোর করে ফেসবুক একাউন্ট করে দেয় আশ্বিনকে। জাকারবাগের এই মিডিয়া এখন অগাবগা সবাই ব্যবহার করছে সারা দুনিয়ায়। কলেজ চত্বরে গেলে দেখা যায় সবাই সেলফোনে মুখ ডুবিয়ে আছে। চ্যাট করছে, ভিডিও দেখছে কিংবা পোস্ট করছে। বই কিংবা পত্রিকা কেউ এখন আর পড়ছে না। ফেসবুকিং করছে আর ইউটিউব দেখছে সবাই। চ্যাটিং-ম্যাসেজিং করছে, নানাভঙ্গির গাদা গাদা সামাজিক ও ব্যক্তিগত ছবি পোস্ট করে নিজেদের জাহির করছে। নিজস্ব প্রোফাইল তৈরি করে সবাই নিজের ব্র্যান্ড বানাচ্ছে। অথচ গাধাটা সারাক্ষণ বইতেই মুখ গুঁজে থাকে। চালচলনেও একেবারে উত্তম কুমারের সময় ঝাপটে পড়ে আছে। একটা হাঁদারাম! দুনিয়াটা কি দ্রæত বদলে যাচ্ছে! মানুষ কতো দ্রæত আর সহজে কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। জ্ঞানের পরিধি এখন আর পুঁথিগত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ নেই। গুগলে সার্চ দিলে এখন সবকিছুই পাওয়া যায়। তাছাড়া আছে ইউটিউব। লক্ষ লক্ষ গান, সিনেমা আর ইতিহাসের ভিডিও সহজেই পাওয়া যায়। এখন কারো কাছ থেকে বই ধার করার দিন চলে গেছে। আমাজন কিন্ডলে কিংবা পিডিএফ-এ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সকল রথী-মহারথীদের কীর্তি সম্পর্কে জানা যায়, পড়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সবাই যার যার মাত্রা অনুযায়ী ব্যবহার করছে। কেউ কেউ নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে সমুজ্জ্বল আবার কেউ কেউ নষ্ট জগতের ভ্রষ্টামির অন্ধকারকে করে তুলছে পূজনীয়। অথচ নতুন বন্ধু সৃষ্টি এবং বন্ধনের নতুনতর এই প্রেক্ষাপট বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের ঘুমন্ত সাহসিকতাকে জাগিয়ে তোলার সুবর্ণ সুযোগ বিশ্বস্তভাবেও কাজে লাগানো যায়।
মুক্তচিন্তার জগতটি এখন অনায়াসেই সব সীমান্ত ভেঙে একাকার হয়ে যাচ্ছে অথচ আশ্বিন পড়ে থাকতে ভালোবাসে পুরনো জগতে। পুরনো ধাঁচ, পুরনো আদত। ভাবটা এমন, যা চলছে যেমন চলছে চলুক। যেমন সাদাসিধে তেমনি সহজ সরল চলাফেরা। আরে, প্রতিদিনই তো একটি নতুন দিন আসে। নতুন সূর্য ওঠে। নতুন ঋতু আসে। মানুষ নতুন পথে চলতে নতুন কিছু শেখে। এসব বলে অনেক বুঝিয়ে সুরি রাজী করিয়েছে আশ্বিনকে।
কিন্তু কি এক গভীর আত্মমগ্নতায় আশ্বিন ডুবে থাকে সারাক্ষণ। ফেসবুকে সে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য নাকি বোধ করে না। অচেনাদের সাথে যে বন্ধুত্ব হয় ফেসবুকে, সে বলে এসব একেবারে প্রাণহীন। তাছাড়া এতো মানুষের সঙ্গও নাকি ওর ভালো লাগে না। বলে, বেশি মানুষ বেশি দঙ্গল। সে নিজের ভেতর কেমন যেন কুঁকড়ে থাকতে ভালোবাসে। নিজের সাথে নিজে কথা বলতে যেমন ভালোবাসে, তেমনি ভালোবাসে সময় পেলে কমলাকান্দি পেরিয়ে সুরতির বিলে গিয়ে নৌকায় ভেসে থাকতে। কমলাকান্দির সুলতানের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে দিনভর সারা বিলে ঘুরে বেড়ায়। কোন তাড়া নেই, কোন কোলাহল নেই।
সুরতির বিলের কথা শুনেছি, সুরি বলে, কিন্তু কখনো যাইনি। সুরতির বিল বলে কেন?
সব নামেরই একটা ইতিহাস থাকে, গোঁফের নীচে আলতো হাসে আশ্বিন, বলে-আশ্বিন মাসে জন্ম বলে বাবা-মা নাম রাখলো, আশ্বিন। তোমার জন্মের সময় তোমাদের উঠোনজুড়ে ছিলো ফুলের সৌরভে ভরপুর। তাই তোমার আব্বা-আম্মা নাম রাখলেন, সুরভী। এতো কমন নাম পছন্দ নয় বলে তুমি ছেঁটে করেছো, সুরি। কেউ কেউ অবশ্য ছুরিও বলে। অবশ্য সুরতি’র নামের সাথে সুরভী’র মিল আছে। সুরি কপট রাগ দেখায়। তবে আশ্বিনের বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়।
আশ্বিন যখন সুরতির বিলের ইতিহাস বলে তখন সুরি যেন কোথায় হারিয়ে যায়। প্রায় পাঁচশ’ বছর আগেকার ঘটনা বলে জনশ্রæতি আছে। তখন বাংলার সুলতান নুসরাত শাহ। পিতা আলাউদ্দীন হোসেন শাহের পথ ধরে সা¤্রাজ্য বিস্তার করে চলেছেন। তখন মোগলদের সাথে ঘাঘরার যুদ্ধ হয়। তখনকার ঘটনা। কমলাকান্দি তখন ছিলো কমলপুর। কমলপুরের নামকরা বৈদ্য ছিলেন হরেন মন্ডল। তার একমাত্র কন্যা সুরতি মন্ডল ছিলো সাক্ষাত দেবীমুর্তি। নবাবী ভূমি বিভাগের কমলপুরস্থ সুপারভাইজার নওমুসলিম এন্তার হোসেন সুরতির প্রেমে পড়ে যান। তারা দু’জনে গোপনে মেলামেশা শুরু করেন। তাদের অভয়ারণ্য ছিলো নাতিদীর্ঘ এই বিল। তখন এই বিলের কি নাম ছিলো কেউ বলতে পারে না। কিন্তু নি¤œবর্ণের হিন্দু ঘরের নওমুসলিম এন্তারকে হরেন মন্ডল ও সনাতন হিন্দুসমাজ মেনে নেয়নি। এক ঝড়োরাতে একদল লোক এন্তারকে তার ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে। সুরতি পাগলপ্রায়। তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ঘনবর্ষার একরাতে পালিয়ে সুরতি এই বিলে এসে আত্মহত্যা করে। তারপর থেকে এই বিলের নাম হয়ে গেছে সুরতির বিল।
আশ্বিনের গল্পবলায় অভিভূত হয় সুরি। কিন্তু মনের ভাব লুকিয়ে খোঁচা দিয়ে বলে, সুরতিকে খুঁজতেই কি বিলে যাও?
ধ্যাৎ! কি যে বলো না! আশ্বিন উড়িয়ে দেয়।
তাহলে তুমি বিলে দিনভর কি করো?
কি যে করি না তাই বলো, সুরি! ভাব নিয়ে বলে আশ্বিন। বলে, পানকৌড়ির দল কি চমৎকার আলতো পায়ে হেঁটে বেড়ায় বিল জুড়ে, না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন। বগারা ধ্যানী ঋষির ভঙ্গিতে যেভাবে শিকারের বন্দনা করে তা এক কথায় অপূর্ব!
অন্তর্গত উচ্ছ¡াসে আশ্বিন কলবলিয়ে তার আবেগ প্রকাশ করে অবলীলায়। সুরি মুগ্ধ হয়ে ওর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আলোর স্ফূরণ দেখে আর ভাবে, আশ্বিনের আবেগে মিশে আছে সারল্য আর কলুষহীনতা।
আর আছে জলময়ূর, আশ্বিন কলবল করে, ওর চোখজোড়া বিলের ছায়ায় নেচে বেড়ায় সীমান্তলুপ্ত আকাশ, ওদের আচরণ দেখে কি ভাবি জানো? উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বলতে থাকে, মানুষের ওদের কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। ওদের নিয়ে কয়েক ছত্র লিখেছি, শোনো-

জলময়ূরের দল পা টিপে টিপে ঘুরে ঘুরে নাচে
জলের ছায়ায় ছায়ায় অনিন্দ্য কল্লোলে
জলময়ূরীর শীৎকারে কেঁপে ওঠে জলের প্রাণ
তরঙ্গিত বাতাসে ভাসে আলোর সংসার;
প্রজন্মের মৌরসীপাট্টা রেখে জলময়ূরী যায় ভ্রমনে
শাপলা শালুকের ভাসমান প্রাসাদ ছেড়ে
জলময়ূরের পাহারায় রচিত হয় পৈত্রিক বংশপঞ্জী
নবজাতক কাকলীতে মেতে ওঠে বিলের বুক।

সুরি ভাবে, আশ্বিন কি পরম মমতায় তার নিজের জগতটা গড়ে নিয়েছে। সে নিজেকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে প্রকৃতির সাথে। ফেসবুক, ইন্টারনেট, বাইরের কোলাহল তাকে তেমন টানে না। টানলেও তা সাময়িক, আটকে রাখতে পারে না। কলেজে কতোরকম কর্মসূচী হয়, কেউই আশ্বিনকে দেখে না সেখানে। ক্লাশ না থাকলে আশ্বিন চলে যায় কলেজের দীঘির পাড়ে। জঙ্গলের ভেতর। হাতে থাকে বই, ম্যাগ্নিফায়িং গøাস। কখনো বই পড়ে, কখনো পিপঁড়া, মাকড়সা, বিচ্ছু, প্রজাপতি নয়তো বল্লার পিছু নেয়। আজকাল সেলফোনে ছবি তুলে আনে। তার পুরো পিকচার গ্যালারি প্রাকৃতিক বিষয় আশয়ে ভর্তি। ধ্যানমগ্ন বক যেমন তার প্রিয় তেমনি জলময়ূরী আর পুচ্ছ নাচিয়ে পানকৌড়িও তার ভীষণ প্রিয়। শাপলাফুলে পেঁচিয়ে থাকা সাপের নৃত্যসঙ্গমও তার কাছে অনন্য এক শৈল্পিক নৈপুণ্য।
নিয়মিত ক্লাশ করে না অথচ যথাসময়ে হোমওয়ার্ক করে পেপার জমা দিয়ে এ+ নাম্বার পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। অনেকে হিংসে করে। কেউ কেউ বলে, ও নিশ্চয় টোকে। কিন্তু কখনো প্রমাণ পায় নি। সুরি জানে তার মামাতো ভাই হাসান তো আশ্বিনের নামই শুনতে পারে না। সাতরঙ সাংস্কৃতিক সংগঠনে সুরির যোগ দেয়া, গান ও নাচের ক্লাশে যোগ দেয়ার পর থেকে হাসানের দাদাগিরি বেড়ে যায়। অথচ আশ্বিন সাতরঙের সদস্যই হয়নি। সে বলে, এগুলো ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক কাজ করার আছে। কিন্তু হাসানের এক কথা, আশ্বিনই সুরিকে বিদাতী কাজে ইন্ধন দিচ্ছে। তাই সুরির সাথে আশ্বিনকে দেখলে ক্ষেপে গিয়ে মারতে আসে। মালাউনের বাচ্চা বলে গালাগাল করে। সুরির সাথে মিশলে ঠ্যাং ভেঙে দেয়ার হুমকি দেয়। আশ্বিন কোন প্রতিবাদ করে না। সে পাশ কেটে চলে যায়। সুরি প্রতিবাদ করলে, হাসান ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় একদিন।
সুরি ওর বাবা-মার কাছে অভিযোগ করে। ওর স্কুল মাষ্টার মা আপন ভাতিজার পক্ষ নিলেও সুরির বাবা ব্যবসায়ী সেকান্দর হোসেন ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিলেন না। তিনি হাসানের বাবা শ্যালক মহিউদ্দিনকে ঢেকে ছেলের দৌরাত্মের কথা বলে। বিষয়টি পারিবারিক। কিন্তু হাসান সেটা অপমান বলে সুরিকে শাসায় কলেজ করিডোরে। সবাই প্রতিবাদ করে। সুরির বন্ধুরা প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ করে হাসানের বিরুদ্ধে। ক্ষেপে গিয়ে হাসান কলেজের পুকুরঘাটে জলখেলিরত মাছেদের ছবি তুলতে ব্যস্ত আশ্বিনের উপর হামলে পড়ে। এবার আশ্বিন রুখে দাঁড়ায়, আমার গায়ে হাত দিলে ভালো হবে না।
ওদের হাতাহাতি দেখে ছাত্রছাত্রীরা দলবেঁধে ছুটে যায়। সেদিন প্রিন্সিপাল হাসানকে একবছরের জন্য সাসপেন্ড করেন। এতে আরো ক্ষেপে গিয়ে হাসান সুরিকে হুমকি দিয়ে যায়, সে আশ্বিনকে দেখে নেবে।
আপাততঃ বিষয়টি মিটমাট হয়েছে মনে হলেও বড় রাস্তার মোড়ে দলবল নিয়ে হাসানের ঘোরাঘুরি অজানা একটা আতঙ্ক তৈরি করে সুরি আর আশ্বিনের পরিবারে। আশ্বিনের বাবা আনন্দ সেন আর সুরির বাবা সেকান্দর হাইস্কুলের বন্ধু। আনন্দ সেন লেখাপড়ায় এগিয়ে গেলেও সেকান্দর ইলেক্ট্রনিকসের ব্যবসায় থিতু হয়ে যায়। আনন্দ সেন পল্লীবিদ্যুতের ম্যানেজার হলেও প্রায়শঃ পুরনো বন্ধুর দোকানে এসে আড্ডায় বসে। একদিন সে বন্ধু সেকান্দরকে তার উদ্বিগ্নতার কথা জানায়। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে দু’জনে দু’টি আলাদা এফআইআর করে রাখে।
এদিকে সুরি আশ্বিনকে কলেজে খুঁজেই পায় না। ফাইনাল দিয়ে সে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ফোন করলে ফোন ধরে না, ম্যাসেজের জবাব দেয় না, ফেসবুকেও বসে না। সুরি জানে, আশ্বিন অবশ্যই বোর্ডে ভালো রেজাল্ট করবে এবং বুয়েটে ভর্তি হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে। হয়তো সে এখন থেকে তার প্রিপারেশান নিচ্ছে। কিন্তু তাই বলে কি সবার সাথে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দেবে? আশ্বিনদের বাড়ী ছোট্ট শহরটির শেষপ্রান্তে, সুরতি বিলে যাওয়ার রাস্তার পাশে এক বনেদী বাড়ী। আশ্বিনদের বাগানবাড়ীতে ফার্স্ট ইয়ারের পিকনিক হয়েছিলো। একই রাস্তায় বন্ধু জান্নাতদের বাড়ী। সুরি জান্নাতের সাথে পরামর্শ করে খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ে। ট্যাক্সিতে ঘন্টাখানেকের পথ। জান্নাতকে নিয়ে সুরি যখন আশ্বিনদের বাড়ীর গলিমুখে পৌঁছে তখন দেখলো কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আশ্বিন বেরিয়ে আসছে।
তোমরা? এ সক্কালবেলায়? সুরিদের দেখে চমকালো আশ্বিন। এক ধরণের অস্বস্তি বা নার্ভাসনেস চেহারায়।
তুমি দেখা করলে আমি কি দেখা করতে পারি না? সুরি চোখ রাখে আশ্বিনের চোখে।
এটা কেমন কথা আশ্বিন, জান্নাত বলে, ফোন, ম্যাসেজ কিছু নেই। বন্ধুদের মানুষ এভাবে ভুলে যায়?
আশ্বিন ওদের বাড়ীর ভেতর নিয়ে যায়। মূল ঘরের পাশে মাঝারি একটা ঘর। খাট, আলমিরা, একসেট সবুজ রঙের সোফা, টেবিল, দেয়ালে কিছু ছবি। অস্ত্র হাতে ক্যাপ পরা একটা আত্মপ্রত্যয়ী ছবি। আশ্বিনের জ্যাঠা বীর মুক্তিযোদ্ধা অনন্ত সেন। সম্ভবতঃ এটা আশ্বিনের ঘর। ওর মা এসে একটু অস্বস্তিমাখা চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে যান। সুরি বুঝলো কলেজের ব্যাপারে আশ্বিনদের পরিবারে দুশ্চিন্তা কিংবা অনিরাপত্তা দেখা দিয়েছে এবং ওদের এভাবে হঠাৎ করে আসাটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। আসলে তার এভাবে আসা ঠিক হয় নি। একধরণের অপরাধবোধ করে সুরি। ভাবলো উঠে যাই। এ সময় মধ্যবয়েসী কর্মচারি মধাব (আশ্বিন খুব বলতো মাধবের কথা। পুরনো লোক) ট্রেতে করে চা-বিস্কুট নিয়ে এসে টেবিলে রেখে চলে যায়। সুরি আশ্বিনকে দেখে। গোঁফটা ঘন কালো হয়ে উঠেছে। মুখে ফাঁকা ফাঁকা দাঁড়ি। একটু কি লম্বা হয়েছে? ওজন বেড়েছে? গাঢ় হলুদ গেঞ্জিতে বুড়ো আঙুলের ইমোজি। এ সময় আশ্বিনের বাবা অফিসের গাড়ীতে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বুঝি বললেন, মেইন গেট লাগিয়ে দাও। গেট লাগানোর শব্দ হলো। একটা কুকুর ভরাট গলায় ঘেউঘেউ করলো। মধু, এ্যাই মধু এদিকে আয়! উচ্চস্বরে কে যেন মধু নামের কাউকে ডাকলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আশ্বিন সুরিকে দেখলো আড়চোখে। মুখটা শুকনো, চোখজোড়ায় কেমন যেন অস্থিরতা, ঠোঁটের কোণে দুর্ভাবনা ছড়ানো আর কপালে লেপ্টে আছে দুশ্চিন্তা। ক’দিন ধরে ফোন করছে আর ম্যাসেজ দিচ্ছে অনবরত কিন্তু আশ্বিন ধরে নি। সে সুরিকে কোন জটিল অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে চায় না। কলেজ শেষে তো একেকজন একেকদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তখন আর কোন ঝামেলা হবে না। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে জীবনকে জটিল করে তোলার অর্থই হয় না।
তা কি করে সময় কাটাচ্ছো? জান্নাত সময় থেকে পাথর সরানোর চেষ্টা করে।
এই, একটু থেমে বলে আশ্বিন, যা আমার স্বভাব।
সে চাইছে কথা ছেঁটে ছোট করতে। সংক্ষিপ্ত করতে ওদের অবস্থান। নিশ্চিত, মা আশপাশেই আছে এবং তাকে বকে চলেছে অবিরাম। সে জানালা দিয়ে খোলা পুকুর পাড় দেখে। লাউয়ের কচি ডগায় সাদা ফুলের সতেজ আলো দুলছে। নীরবতা ভারী হয়ে উঠছে।
সুরি বুঝতে পারে আশ্বিন চাইছে তারা চলে যাক কিন্তু বলতে পারছে না মুখে। এতোদিনের সহজ সরল মেলামেশা যে তাদের মধ্যে কোন সেতুই রচনা করেনি তা যেনো হঠাৎ পরিষ্কার ধরা পড়লো। আর তা উপলব্ধি করে সে বুকের ভেতর হাহাকারের বেদম পাখা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পায়। আশ্বিনের এই নির্লিপ্ত আচরণের কারণ কি হাসানের হুমকি নাকি দূরে সরে যাবার অজুহাত? হাসান যে তার দলবল নিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় আছে, তা সে নিশ্চিত। কিন্তু তাই বলে কি সম্পর্কের বাঁধনটুকু এভাবে ছিঁড়ে ফেলতে হবে? আসলে কি আমাদের কোন বাঁধন সৃষ্টি হয়েছিলো? এখন মনে হচ্ছে এটা তার একতরফা মনোকল্পনা। এসব ভেবে সে হাঁসফাঁস করে দম নেবার চেষ্টা করে। উঠে দাঁড়ায়।
তা ঢাকায় কবে যাচ্ছো?
এখনো দিন তারিখ ঠিক হয়নি।
সাবধানে থেকো। সুরি দরোজার মুখে এসে পেছন ফেরে, তোমাকে আসতে হবে না।
আসি, জান্নাতও বিদায় নেয়, ভালো থেকো।
ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আশ্বিন সশব্দে নিঃশ্বাস ছাড়ে, পরিস্থিতিই মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, মানুষ নয়। একরাশ বিষাদ এসে তার মনের আকাশ বিবর্ণ করে তোলে। সে বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনাটাই বাতিল করে। সুরি খুবই কষ্ট পেলো।
জান্নাতদের বাড়ীতে ফিরে এসে ওরা ছাদে ওঠে। নির্জন ছাদে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ছেড়ে দেয় সুরি। অশ্রæধারায় প্লাবিত হয়ে গেলো বাঁধভাঙা আবেগ। জান্নাতের মা কিছুতেই ছাড়লো না। জান্নাতের বিয়ের প্রস্তাব আসছে। সে আর লেখাপড়া করতে চায় না। রোজগেরে স্বামী আর নিজেদের একটা বাড়ী এবং বছরান্তে বাচ্চা। ব্যস! অবশ্য সুরির জেদ মাস্টার্স করার। ওরা জান্নাতের জন্য আসা প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাপ্ত পাণিপ্রার্থীদের ছবিগুলো দেখলো। অধিকাংশের বয়েস অনেক বেশি। সুরি প্রায় সবগুলোই নাকচ করে দিলো। জান্নাত হাসে।
কম বয়েসী বরেরা ভালো রোজগেরে কি করে হবে?
তাই বলে এসব বুড়োদের বিয়ে করবি?
নাটাই হাতে রাখতে হলে তাই করবো, সুরি!
সুরির মুখে কথা আসে না। মনে মনে বলে, কি বিচ্ছিরি রুচি!
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মধ্যরাত পর্যন্ত ডিশে বোম্বের আর কোলকাতার ছবি দেখলো দু’জনে। এসময় আশ্বিনের ফেসবুকের একটা পোস্ট চোখে পড়লো। বলতে গেলে অনেকদিন পর। কিন্তু পোস্টটা পড়ে সুরি ভিরমি খেলো। পোস্টে আশ্বিন লিখেছে, ”হযরত মোহাম্মদ ছিলো একজন নারী লোভী, লুটেরা, খুনি এবং অত্যাচারী। যারা তার ধর্ম গ্রহন করেনি তাদের নিজহাতে হত্যা করতো এবং তাদের বিধবা স্ত্রীদের গনিমতের মাল বলে ভোগ করতো।” পড়ে সুরি আর জান্নাত ভ্যাবাচ্যাকা খায়। আশ্বিনকে কোনদিনই তারা ধর্ম নিয়ে কথা বলতে শোনেনি। বরং আশ্বিন বলতো, ধর্ম হলো ধূর্ত শোষকদের মানুষদের বিভক্ত করে শোষণ করার অপকৌশল। ধর্ম শুধু মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, ঐক্য নয়; ঘৃণার সৃষ্টি করে, ভালোবাসা নয়। সেই আশ্বিন এ ধরণের একটি ভয়ঙ্কর পোস্ট দেবে তা ভাবাই যায় না। সুরি আর জান্নাতের দৃঢ় বিশ্বাস হয় এটা হাসানের কারসাজি। কেউ আশ্বিনের নামে আইডি খুলে ওকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আর সেটা একমাত্র হাসানের করার সম্ভাবনা একশত ভাগ।
সুরি আর জান্নাত আশ্বিনকে ফোনের পর ফোন করছে, ম্যাসেজের পর ম্যাসেজ দিচ্ছে কিন্তু আশ্বিনের কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অস্থির হয়ে সুরি ওর বাবাকে ফোন করে বিষয়টি জানায়। বাবা হয়তো বন্ধুকে জানাবে কিংবা পুলিশকে অবগত করবে। রাত গভীর হয়ে আসে অনিশ্চয়তায়। উত্তেজনায়, উদ্বেগে, দুশ্চিন্তায় ভেঙে আসে শরীর। চোখ জুড়ে নেমে আসে প্রচন্ড ঘুম। কানফাটা আওয়াজে ঘুম ভাঙে দু’জনের। প্রথমে ভেবেছিলো বাড়ীতে ডাকাত পড়েছে। ধাতস্থ হয়ে বুঝতে পারলো মাইকে তীব্র কন্ঠে ঘোষণা এবং সমবেত মানুষের গগনবিদারী চিৎকারে কানের পর্দা ফেটে যাবার জোগাড়। শ্লোগান ভেসে আসছে, ”নবীজীর অপমানের প্রতিশোধ, নিতে হবে নিতে হবে, মালাউনদের বাড়ীঘর, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, মালাউনদের মালাউনদের, কতল করো, কতল করো, নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর।” হাজার হাজার মানুষ মশাল হাতে ছুটছে আশ্বিনদের বাড়ীর দিকে। সে ফোন করে কিন্তু ফোন বন্ধ। মুহূর্তের মধ্যে সুরির মগজে বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে চটপট করতে করতে বলতে থাকে, এটা হাসানের কারসাজি। এটা মানুষদের বলতে হবে, ওদের থামাতে হবে।
সুরি ছুটে রাস্তায় চলে আসে। সে হুঙ্কাররত মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা করে, এটা মিথ্যা, এটা কারসাজি। কিন্তু কেউ তার কথা শোনে না। কেউ থামে না। আগুনের ¯্রােত হয়ে উম্মাদ উম্মত্ত মানুষগুলো ছুটছে আশ্বিনদের বাড়ীর দিকে। তাদের কারো হাতে দা, চাপাতি, কারো কারো হাতে বল্লম, টেঁটা। সুরি হাতে পায়ে ধরে, মিনতি করে, কাকা আপনারা শোনেন, একটু শোনেন আমার কথা। তার মিনতি, তার কান্না কারো কানে পৌঁছায় না। সে ওদের সাথে সাথে ছুটছে। যেন উত্তাল তরঙ্গে ভেসে যাচ্ছে তার পলকা শরীর। একসময় কে যেন তাকে দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। ছুটন্ত মশালের আলোয় দেখলো হাসানের দানবীয় চেহারা। সুরি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু হাজার হাজার পায়ের নীচে পড়ে সে বুঝি ফুটবলের মতো আছাড় খেতে থাকে।
একটু পরে তাবৎ পৃথিবীকে ভয়ঙ্কর আলোর নাচনে কাঁপিয়ে লেলিহান শিখা আশ্বিনদের বাড়ী উপর লকলক করে। আদিম মানুষদের মতো পৈশাচিক উল্লাসে চরাচরে মাতমের সৃষ্টি হয়। পুরো অঞ্চলের মানুষ অনুমান করে কেয়ামত বুঝি হয়ে গেলো। দিনের আলো ফুটে উঠলে তাদের চোখ ক্রমশঃ দেখতে পায় আশ্বিনদের বাড়ীর অদূরে এক যুবতীর থেতলানো বিকৃত লাশ পড়ে আছে। আশ্বিনদের পুরো বাড়ী ভস্মীভূত এক ধ্বংসস্তুপ। উঠোনের মাঝখানে শানবাঁধানো আমগাছের সাথে বাঁধা পাঁচটা পোড়া কঙ্কাল। সমবেত মানুষেরা যেন বোবা হয়ে যায়। পোড়া মানুষের উৎকট দুর্গন্ধ, ধোঁয়াচ্ছন্ন বাতাসে দমবন্ধ হয়ে আসে। এ সময় বাতাসের গতি বেড়ে যায়। দমকা বাতাসে ভেসে আসে হিসহিস শব্দ। বাতাসের ঝাপটায় হিহি রিরি করে হেসে ওঠে কঙ্কালগুলো। সমবেত মানুষেরা গোল হয়ে কঙ্কালগুলোকে প্রদক্ষিণ করতে করতে নিজেদের গায়ে থুথু ছিঁটোতে থাকে। ভয়ে নাকি ঘৃণায় বোঝা যায় না।