মতামত

করোনাকালে মধ্যবিত্ত জীবনে সংকট

সুভাষ দে

কারা মধ্যবিত্ত। বৈশিষ্ট্য ও অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো ২০০৭ সালে মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ৩ ভূমিকা উল্লেখ করেন। ১) উদ্যোক্তা প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসে। তাঁরা সমাজে উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, কর্মসংস্থান তৈরি করে। ২) মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ মানবপুঁজি আহরণ ও সঞ্চয়ের উপর জোর দেয় যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উপকরণ। ৩) মধ্যবিত্তরা দরিদ্রদের তুলনায় বেশি ভোগ করে এবং একটু বেশি গুণগত মানের পণ্য বা সেবা পেতে বেশি খরচ করতে রাজি থাকে, এর মাধ্যমে মধ্যবিত্তরা যে চাহিদা তৈরি করে তা বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করে। এতো গেল অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কিত বিষয়। এর বাইরেও রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, বিনোদন অর্থাৎ একটি সমাজের উন্নয়নশীল ও মননশীল ভুবন তৈরিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা প্রত্যক্ষ, পরিবর্তনশীল, ইতিবাচক, কখনো বা বিপ্লবাত্মক। এই শ্রেণীটি সমাজ পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে প্রধান ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও মধ্যম, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে।

অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন ২০১৫ সালে মধ্যবিত্ত নিয়ে গবেষণা করেছেন, তখন আমাদের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বা ৩ কোটি ৫৮ লাখ জনসংখ্যাকে মধ্যবিত্ত ধরা হয়েছিল। গবেষণায় বলা হয়েছিল ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা এক তৃতীয়াংশ হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বোস্টন কন্সাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) বাজার ও চাহিদার দৃষ্টিকোণ ব্যাখ্যা করে বলছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সামর্থ বাড়ছে। অবশ্য এসব তত্ত্ব কোভিড সংক্রমণের আগের কথা। কোভিড-১৯ এর পরের পরিস্থিতিতে এই প্রথম বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বে মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমেছে ৯ কোটি আর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১৩ কোটি ১০ লাখ।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে, এক ব্যক্তির ক্রয় ক্ষমতা (পিপি) প্রতিদিন ২ মার্কিন ডলার থেকে ২০ মার্কিন ডলারের মধ্যে যদি হয়, তাহলে তাকে মধ্যবিত্ত বলা যায়। এই হিসেবে তারা বলছে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হলো ৩ কোটি ৭ লাখ। বিশ্বব্যাংকের মধ্যবিত্তের আয়ের হিসেবটি আরেকটু বেশি, ১০ থেকে ৫০ ডলার পর্যন্ত। আবার কোন কোন গবেষণার মতে, ১০ থেকে ২০ ডলার আয় যাদের তাদের মধ্যবিত্ত বা মধ্যম আয়ের বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ধরে বলা যায়, যাদের মাসিক আয় ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা, তারা মধ্যবিত্ত। আবার অনেক রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদ ২৫ হাজার টাকা থেকে মধ্যবিত্তের আয় হিসেবে ধরেন। বলা হয় বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ মধ্যবিত্ত। ১৬ কোটি হিসেবে জনসংখ্যা ধরলে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৪ কোটি ৮০ লাখ। অবশ্য জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটির   বেশি।

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রবাসী কর্মজীবী, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, গণমাধ্যম কর্মী, শিল্প, ব্যাংকিং, কর্পোরেট গোষ্ঠীর মধ্যম সারির কর্মকর্তা, ছোট ও মধ্যম শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মকর্তা প্রমুখ। গ্রামাঞ্চলেও এখন বড় মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠেছে।  প্রবাসী পরিবার, মাঝারি কৃষক, উপজেলায় নগরায়ণের প্রভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, কারিগর – সব মিলে বড় মধ্যবিত্ত শ্রেণী।

এই বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক বড় অংশ কোভিড-১৯ এর অভিঘাতে বিপর্যস্ত। করোনার কারণে ব্যবসা বাণিজ্য অনেকটা স্থবির। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। ব্যাপক সংখ্যক লোকের বেতন কমেছে। নগরের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষ বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ সামাল দিতে না পেরে পরিবার পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন ১৩ শতাংশ, আয় কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের, অপরদিকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলছে করোনার প্রভাবে চাকরি হারিয়েছেন ৩৬ শতাংশ। পিপিআরসির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, নতুন করে আড়াই কোটি লোক দারিদ্র সীমার নিচে চলে গেছে। করোনার অভিঘাতে অনেক মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে চলে গেছেন।

করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে মুশকিলে পড়েছেন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সন্তানদের লেখাপড়া, চাকরির কারণে শহরের বাসা ছাড়তে পারছেন না। অর্থনৈতিক কষ্টের কারণে খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ সরকার, বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে নগদ সাহায্য, ত্রাণ পেয়েছে কিন্তু অভাবগ্রস্ত মধ্যবিত্তরা কোনোরূপ সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। ফলে এই করোনাকালে মধ্যবিত্ত শ্রেণী কষ্টের মধ্যে পড়ে গেছেন।

মধ্যবিত্তরা সন্তানদের লেখাপড়ায়, সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজে মন দিতে পারছেন না অভাবের কারণে। দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের সন্তানদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে।  সাধারণত সন্তানেরা লেখাপড়া শেষে পরিবারের হাল ধরেন। মোটকথা, বিকাশমান শ্রেণী  হিসেবে মধ্যবিত্ত এখন সংকটে পড়েছে। তাদের অনেকের শ্রেণী অবস্থান নিম্নগামী। প্রবাসী পরিবারের ৩ লক্ষ মানুষ ফিরে এসেছেন দেশে। তাদের ৪৭ শতাংশ কোন কাজে যুক্ত হতে পারেননি। এ কথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুবিদিত যে, কেবল অর্থনীতি নয়, সমাজ বিনির্মাণে, সমাজকে টিকিয়ে রাখতে এই শ্রেণীর ভূমিকা অপরিহার্য। সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায্যতার চাপটি দেয় মধ্যবিত্তরা। তাদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য অশনি সংকেত। এক শ্রেণীর হাতে প্রচুর অর্থ, ভোগ বিলাস, বিদেশে অর্থ পাচারে মগ্ন, ঋণখেলাপীরা জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। বাংলাদেশের ধনিক শ্রেণী সকল সুযোগ সুবিধা, প্রণোদনা ভোগ করছে, যা এই করোনাকালেও অব্যাহত আছে। অন্যদিকে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক স্তর হিসেবে রাজনীতি ও সমাজ পরিচালনায় ভূমিকা রাখে সক্রিয়তার মাধ্যমে, তারাই আজ বৈষম্যের শিকার। গণতান্ত্রিক ও সম্প্রীতিময় সমাজ প্রতিষ্ঠায় মধ্যবিত্তের ভূমিকা স্বীকার করে এই শ্রেণীকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে জীবন জীবিকার সংগ্রাম, অর্থনৈতিক গতিময়তা বাড়ানো, সমাজের সফলতা ও সক্রিয়তার জন্য টিকা কর্মসূচী সফল করা ছাড়া বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি এই মুহুর্তে বড় প্রয়োজন। মধ্যবিত্তের আয়ের এক বড় অংশ যায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক আপ্যায়ন,ভ্রমণ ও বিনোদনে। ঘরভাড়া তো আছেই। করোনার এই দুর্দিনে তাদের সবকিছুতেই টান পড়েছে। করোনার কাল দীর্ঘ হলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের তাড়া করবে। সমাজ সংসারের অনেক কিছুই তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে শুরু করবে যা তাদের শারীরিক ও মানসিক অবসাদে ডুবিয়ে দেবে। তাই এই সময় ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের অর্থনৈতিক প্রণোদনা (নগদ সহায়তা), উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, সন্তানদের জন্য বিশেষ শিক্ষাভাতা, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মসৃজন, চাকুরি হারানোদের চাকুরিতে পুনর্বহাল জরুরি হয়ে পড়েছে। নগর ও গ্রামের মধ্যবিত্তশ্রেণীর তথ্য জরিপ করে তাদের তথ্যভাণ্ডার তথা ডাটা বেইজ তৈরি করার কাজটি জরুরি ভাবে হাতে নেয়া উচিত।

(লেখকঃ সাংবাদিক)