পীরাণ থেকে পাঞ্জাবি : বাঙালির আত্মপরিচয় – নাজিমুদ্দিন শ্যামল
বাংলাদেশ নামে যে ভূখণ্ডটিতে আমরা বসবাস করছি তা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করলেও এর রয়েছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। আর এই ভূখণ্ডে আমরা যারা বাঙালি হিসেবে আত্মপরিচয়ে গর্ববোধ করছি তাদেরও রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য; আমাদের মাতৃভূমির ইতিহাসের সাথে জাতি হিসেবে আমাদের ইতিহাসও গৌরবোজ্জ্বল ও ঋদ্ধ। আমাদের এই মাতৃভূমি রাষ্ট্র হিসেবে নতুন হলেও মধ্যযুগের আদিপর্ব থেকে বাঙাল নামের যে জনপদের কথা ঐতিহাসিকরা বলেন তারই ধারাবাহিক জাতি হিসেবে বাঙালি আজ স্বমহিমায় ও কীর্তিতে অস্তিত্ববান এক জাতি। প্রাচীন যুগ থেকেই বাঙালির ঐতিহ্য রয়েছে খাদ্য, পোশাক, সংস্কৃতি, ভাষা তথা সর্বক্ষেত্রেই। প্রাচীন কালে বঙাল সমাজে তাঁতীদের স্বতন্ত্র মর্যাদা ছিলো। প্রাচীন প্রকৃতি খণ্ডের লেখমালা থেকে জানা যায়, তাঁত চালিয়ে, কাপড় বুনে ও অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্যে বিবাহিত রমনীরা স্বামীকে সাহায্য করতেন। প্রাচীন কালে বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিলো ভাত, মাছ, মাংস, ফলমূল, শাকসবজি, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য। যদিও প্রাচীনকালে বর্ণাশ্রম ধর্ম সমাজের মূল ভিত্তি ছিলো খাদ্য, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যকার বিষয়াদিতে বঙাল জনপদের মানুষের সাদৃশ্য ছিলো। প্রাচীনকালে বঙাল পুরুষ ও রমনীরা সেলাইবিহীন তাঁতের বস্ত্র পরিধান করতো। কালে কালে বঙাল রমনীগণ তাদের পুরুষদের জন্য সেলাই করা জামা বানানো শিখলো। তারা সূচিকর্মে সিদ্ধহস্ত হওয়ার পর বিশেষত মধ্যযুগে ফতুয়া সাদৃশ্য পাঞ্জাবি বা পীরান সেলাই করতো। তখন পাঞ্জাবি বা ফতুয়া বা পীরান পুরো হাত ছিলো। কিন্তু কোমর অবধি লম্বা থাকতো। কালে কালে নিপূণা সূচিশিল্পীগণ অর্থাৎ বঙাল রমনীগণ তাদের পুরুষদের জন্য নানা ডিজাইনে জামা বানালো। নদী তীরবর্তী ও কার্পাস উৎপাদনকারী পার্বত্য অঞ্চলসমূহে এর বিকাশ লাভ সমধিক হওয়ার কারণে পাঞ্জাবি নামাকরণ হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। তখনও, অর্থাৎ প্রাচীন ও মধ্য যুগে আস্তিন, বোতাম এসব ধারণা তৈরি না হলেও ফিতা বা ফিতা সদৃশ্য কাপড় দিয়ে পাঞ্জাবি বাঁধা হতো বলে জানা যায়। আবার ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে শুধু গলা দিয়ে ঢুকানো যেতো ও চতুর্পাশ সূচিকর্ম দিয়ে তৈরি হতো এমন পোশাক বা পীরান যা পাঞ্জাবি নামেই খ্যাত হয়েছে কালে কালে। শরীরের উপরের অংশের জন্য পীরান বা পাঞ্জাবি সেলাই করা হলেও পুরুষদের নিচের অংশে সেলাইবিহীন ধূতি পরিধান করা হতো। তেমনি নারীরাও সেলাইবিহীন কাপড় (যা শাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে) পড়তো। তারা বক্ষবন্ধনীর জন্যও সেলাইবিহীন টুকরো কাপড় ব্যবহার করতো। ফলত আমরা দেখতে পাই প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ থেকে শুরু করে পরবর্তীতেও বঙাল জনপদের অধিবাসী পুরুষগণ পাঞ্জাবি, ধূতি ও নারীগণ শাড়িকেই প্রধান পোশাক হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে পরিধান করে আসছে।
পরবর্তীতে এই জনপদে বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতির সাথে পাঞ্জাবির আকার ও সৌষ্ঠব পরিবর্তিত হলেও মূল ঐতিহ্য সমুন্নত থেকেছে। আমরা দেখতে পাই এদেশে সূফি সাধকরা ইসলাম প্রচার করতে এলে পাঞ্জাবির আদলে তারা পোশাক পড়েছেন, ইসলাম ধর্মের অনুসারী মানুষেরাও ঐতিহ্যের সাথে সাজুয্য রেখে পাঞ্জাবির আকার আয়তন ও সৌষ্ঠব পরিবর্তন করে বাঙালির মূল পোশাকের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। ফলত এদেশে বাঙালির হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিচ্ছদ ধর্মসমূহের বিকাশেও পরিবর্তিত হয় নি। তাই পাঞ্জাবি ও ধূতি, কিংবা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি অথবা পাঞ্জাবি ও পাজামা বা প্যান্ট এখনও বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাকই শুধু নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয়ের এক ঐতিহাসিক মাত্রা। ফলে এখনও বাঙালির মূল পোশাক বলতে পুরুষগণের পাঞ্জাবি ও রমনীগণের শাড়িকেই বুঝিয়ে থাকে। এটা একটা আশ্চর্যের বিষয় যে, প্রাচীন, মধ্য তৎপরবর্তীকাল বর্তমানের আধুনিক যুগ পর্যন্ত হাজার হাজার বছর ধরে পাঞ্জাবি ও শাড়ি বাঙালি পুরুষ ও রমনীর মূল পোশাক হিসেবে উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হচ্ছে। এখন যে কোন আচার অনুষ্ঠানে বিয়ে শাদি ঈদ পার্বণ থেকে শুরু করে জন্ম মৃত্যুর অনুষ্ঠান পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই বাঙালি পুরুষরা পাঞ্জাবি পরিধান করে থাকে। বাঙালি পুরুষদের জীবনে ধর্ম, অর্থনীতি সংস্কৃতি সবকিছুর সাথে ওতোপ্রোতভাবে পরিচ্ছদ হিসেবে পাঞ্জাবি জড়িয়ে আছে।
প্রাচীনকাল কিংবা মধ্যযুগের সৃষ্টিকর্মে নিপূণা বাঙালি রমনীদের রুচি ও পছন্দ থেকে যে পাঞ্জাবি নামের পোশাকটির উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিলো, হাজার হাজার বছর ধরে যে পোশাকটি বাঙালি পুরুষের পরিচ্ছদ হিসেবে সগৌরবে টিকে আছে, বর্তমান কালের সূচি শিল্পীরা তাকে আরো আধুনিকতা ও বিস্তৃতিই দেয়নি, বরং বিশ্বময় বাঙালির ঐতিহ্য ও স্মারক হিসেবে পাঞ্জাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলত বাংলাদেশের মানুষ নয় বরং সারাবিশ্বের অনেক মানুষের কাছেই পাঞ্জাবি এখন আধুনিকতম পোশাকের বিশেষ্য।
নাজিমুদ্দিন শ্যামল: কবি ও সাংবাদিক, সাবেক সভাপতি, সিইউজে।