বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৪৪):এক হয়ে নয় এক সাথে  

– বিজন সাহা

আজকাল প্রায়ই এরকম স্ট্যাটাস দেখা যায় “জীবনে ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই। ধর্মের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।” কিন্তু ধর্ম বলতে আমরা কেন প্রথাগত ধর্ম বোঝাই সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। কারণ বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে মারামারি হানাহানি সেটা কি নিজ নিজ ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে নাকি নিজেদের ক্ষমতার জোর দেখাতে? যারা নিজেদের ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায় তারা তো তলোয়ার নিয়ে আসে না, আসে শান্তির ও মুক্তির বাণী নিয়ে। তলোয়ার নিয়ে যারা আসে তারা দখল করে রাজ্য, ধনসম্পদ। তাই ধর্ম না থাকলেই যে শান্তি আসবে তার কোন বাস্তব কারণ নেই। একটা সময় ছিল যখন ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ হত, হত ক্রুসেড। ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের ক্রুসেড ইতিহাস বিখ্যাত। তেমনি ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে যুদ্ধ আর তার মূলে ছিল ধর্ম। কিন্তু বর্তমানে ধর্ম নিয়ে কি যুদ্ধ হয়? এখন তো যুদ্ধ হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য। আমেরিকা সেকুলার দেশ, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই দেশ যত যুদ্ধ বাঁধিয়েছে আর কেউ তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। সেটা করেছে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের নামে। তাহলে কেমনে বলি ধর্মই অশান্তির মূল? তাছাড়া যেসব মৌলবাদী গ্রুপ যেমন আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট ইত্যাদি বর্তমানে অশান্তির সৃষ্টি করছে তারা সবাই আমেরিকার অর্থে ও সহযোগিতায় তৈরি। সুতরাং শান্তির অন্তরায় ততটা না ধর্ম যতটা বিভিন্ন দেশের ঔপনিবেশিক মনোভাব। তাই এক্ষেত্রে যেটা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত তা হল শোষণ না থাকলে শান্তি আসবে। ধর্মকে আসলে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেমন ব্যবহার করা হয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ধর্মের বিরুদ্ধে নয় শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

আমাদের সমস্যা মনে হয় আমরা প্রায়ই কোন আদর্শের একটা দিকের উদাহরণ দিয়ে সেই আদর্শ বিচার করি। খেমার রুজ সমাজতন্ত্রের কথা বলত। তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে সমাজতন্ত্র বিচার করা কি ঠিক? অথবা ক্লিনটন, বুশ, ওবামা, বাইডেন যাদের সরাসরি হস্তক্ষেপে অনেক দেশ ধ্বংস হয়েছে ও অনেক মানুষ মারা গেছে তাদের দিয়ে কি গণতন্ত্রের ভালোমন্দ বিচার করব? একটু খেয়াল করলে দেখবেন অধিকাংশ মানুষ কিছু না কিছু অলৌকিক বিষয়ে বিশ্বাস করে, করতে চায়। জানি না সেটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কি না। আপনি প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস বাতিল করলে তারা অন্য কিছুতে বিশ্বাস করবে।‌ এটা করে মূলতঃ বৈষম্যের শিকার হয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নে লোকজন ঈশ্বর বা ধর্মে তেমন বিশ্বাস করত না তার অনেক কারণের একটা মনে হয় বৈষম্য কম ছিল বলে। সেজন্যেই আমার মনে হয় যদি আমরা সমাজে বৈষম্য কমাতে পারি, শোষণের পরিমাণ কমাতে বা দূর করতে পারি অলৌকিক শক্তির প্রতি অন্ধবিশ্বাস এমনিতেই কমবে।

নিঃসন্দেহে ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্বর্গের লোভ দেখিয়ে মানুষকে দিয়ে হাজারটা অমানবিক কাজ করিয়ে নেয় ধর্মও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শোষণের হাতিয়ার হিসেবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া আমরা কেন অন্যদের কি দরকার আর কি দরকার না সেটা ঠিক করতে যাই? একজন টেকনিশিয়ানের কি গল্পের বই পড়ার দরকার আছে?  একজন টেকনিশিয়ান কর্মজীবনে তা হলেও সে যেমন সাহিত্যানুরাগী হতে পারে তেমনি হতে পারে গানের ভক্ত। আসলে মানুষের জীবন বহুমুখী, বিভিন্ন তার চাহিদা।  আমার মনে হয় ধর্মের দরকার আছে কি নেই সেই প্রশ্ন না করে ধর্মকে যাতে শোষণের, অন্যায় করার ও ভেদাভেদের হাতিয়ার করা না হয় সেটা দেখা উচিৎ। অনেকেই বলেন ধর্মকে ব্যবহার করে অনেক অসামাজিক কাজ করা হয়। রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করে কি কম অন্যায় করা হয়? আমরা মনে হয় ধর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে আসল কালপ্রিটদের কথা ভুলে যাচ্ছি।

কিন্তু কেউ যদি ধর্ম পালন করতে চায় তাহলে তার সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কি আমাদের আছে? যত লোক বিজ্ঞানে বিশ্বাসী তারচেয়ে শতগুণ বেশি মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী। আমাদের অনেকের বাবা মা ধর্মে বিশ্বাস করতেন, তারা কি সবাই খারাপ মানুষ ছিলেন? খারাপ মানুষ ধার্মিক বা অধার্মিক নয়, তারা খারাপ। এটা ঠিক যে বিশ্বাসী লোকদের ঠকানো সোজা। তাছাড়া এই যে আমরা বিজ্ঞান বিজ্ঞান বলি, কিন্তু কয়জন মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক? কয়জন মানুষ নিজের কাজকে প্রশ্ন করে? নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে প্রশ্ন করে? অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুফল ভোগ করে। তাছাড়া একটা জিনিস মনে রাখা দরকার আমার জন্য ফিজিক্স যেমন নেশা ও পেশা, কারও জন্য সাহিত্য বা গান, অনেকের জন্য ধর্মীয় রীতিনীতি সেরকম। ধর্ম না থাকলে (নিষিদ্ধ করলে, কেননা এমনি এমনি সেটা উঠে যাবে না, এমনকি নিষিদ্ধ করলেও অনেকেই গোপনে ধর্ম পালন করবে) সাথে সাথে এর সাথে যেসব সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে সেটাও উঠে যাবে। পূজা বা ঈদ না থাকলে সেই সাথে পূজা বা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় বিলোপ পাবে। আমাদের সমস্যা হল আমরা অধিকাংশ জিনিস কোন এক নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ চারিদিক থেকে দেখে। ভালো ফটোগ্রাফার বিভিন্ন দিক থেকে দেখে তারপর ছবি তুলে। হকিং রেডিয়েশনের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। এটা বলে যে এমনকি ব্ল্যাক হোলও সম্পূর্ণ কালো নয়, আলো বা তথ্য বিকিরণ করে। আসলে কোন কিছু যেমন শতভাগ খারাপ নয় তেমনি কোন কিছু শতভাগ ভালোও নয়। সব আপেক্ষিক। তাছাড়া বিজ্ঞান বাহ্যিক সমস্যা কমবেশি সমাধান করতে পারলেও মনোজগতের অনেক সমস্যার সামাধান দিতে অপারগ। ফলে এমনকি উন্নত বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষ ধর্ম বা অন্যান্য জায়গায় আশ্রয় খোঁজে। কোন কিছু বাদ দেবার আগে বিকল্প ব্যবস্থা দিতে হয়। গরু যেমন ছাগলের বিকল্প নয় বিজ্ঞান তেমনি ধর্মের বিকল্প নয়। এরা দুই ভিন্ন আক্সিওমার উপরে প্রতিষ্ঠিত।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৪৩): ক্রকুস সিটি হলে সন্ত্রাসী হামলা – বিজন সাহা

আমরা প্রযুক্তিগত ভাবে অনেক এগিয়ে গেলেও সেই মধ্য যুগের মানুষ রয়ে গেছি। এটা শুধু যারা ধর্ম বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে নয় যারা বিজ্ঞানে বিশ্বাসী তাদের মাঝেও দেখা যায় – কারও পারিবারিক জীবনে, কারও ব্যবসায়িক জীবনে। একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখা যাবে – যারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে তারা কিন্তু বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে না, বরং বিজ্ঞানের সব আবিষ্কার ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু আমরা যারা বিজ্ঞানের কথা বলি, তারা কি করি? ধর্ম ব্যবসায়ী যখন লাখ লাখ মানুষকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে টানে আমরা ঠিক উল্টোটা করি – তাদের দূরে সরাই। কেন একজন মানুষ ধর্ম গুরুর কথা শুনে কিন্তু আমাদের পাত্তা দেয় না? মনে হয় সেটা আমাদের মাস সাইকোলজি না বোঝার কারণে। আরও একটা কথা, আমেরিকা ইউরোপ – যারা বিজ্ঞান প্রযুক্তির সম্মুখ সারিতে তাদের হাতেই কিন্তু আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট ইত্যাদির সৃষ্টি। তাছাড়া আমরা নিজের জ্ঞানগর্ভ কথার ভিড়ে ভুলে গেছি কেন “জীবনে ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই। ধর্মের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ছাড়া পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব” এ রকম লেখা প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়।

পঁচিশ বছর আগেও ফেসবুক ছিল না, আমরা ঠিক জীবন যাপন করতাম। ফেসবুককে ব্যবহার করে যত বিপ্লব, যত অন্যায় করা হয়েছে তার হিসেব কে রাখে। তাই জীবনে কার কি প্রয়োজন সেটা নির্ধারণ করা মনে করি বোকামি। শুধু একটা জিনিস দেখা উচিৎ – তা হল আমার বা কারও কাজ যেন সমাজের জন্য বিপদজনক না হয়।  দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে হয় দেখব ধর্ম, রাজনীতি এসব ব্যবহার করে যত অন্যায় করা হয় সেটা এমনিতেই দূর হয়ে গেছে। সমস্যা তাই মনে হয় আইনের অপব্যবহারে আর বৈষম্যে। তাই আমাদের দরকার ঝোপ বুঝে কোপ না মেরে সমস্যা সত্যিকার অর্থে কোথায় সেটা নির্ণয় করা।

অনেকেই বলে ধর্ম কারও কারও শোষণের হাতিয়ার। তবে এখন ধর্মের খুব একটা প্রয়োজন নেই। ধর্মীয় ফেনাটিজম বা উগ্রতা প্রচলিত আইন দ্বারা প্রশমিত করা হয়। জীবন পাল্টে দিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানুষের মনোজগতকে উন্নত করে। ধর্ম নামক বিষয়টি না থাকলে খারাপ কাজে ব্যবহার থাকতো না। গনতন্ত্র, সংবিধান, আইন এগুলোর সাথে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট। তাহলেই অন্যায় করে কেউ পার পাবে না। একজন টেকনিশিয়ানের বই না পড়েও সিনেমা হলে একটা ভালো সিনেমা দেখলে বা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নিজেকে যুক্ত করলেও মননের উন্নতি ঘটতে বাধ্য । এটাই সমাজ সংস্করণে ভুমিকা রাখবে।

বাংলা ভাষায় ধর্মের আরেক অর্থ বৈশিষ্ট্য, মানে কোন একটা বিশেষ গুন (দোষ) সম্পন্ন। আমাদের দেশে আর্জেন্টিনা ব্রাজিলকে ঘিরে অনুসারীদের ঝগড়া বিবাদ ব্যতিক্রম নয়। এসব ঘটে বিভিন্ন ক্লাব ঘিরে। এমন কি মাস্ক না মাক্স এ নিয়ে বিতর্কের জীবনহানি ঘটে। জীবনহানি ঘটে রাজনৈতিক বিতর্কে। আসলে যখনই কেউ নিজেকে অন্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট ভাবে তখনই আসে অন্ধবিশ্বাস। কারণ মানুষ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একজন গায়ক আর একজন শিক্ষক – তা তারা যত ভালোই হোন, দুজনের মধ্যে তুলনার সুযোগ কম। এমনকি দুজন একই পেশার মানুষও পেশার বিবেচনায় ভালোমন্দ হলেও সার্বিক বিবেচনায় তেমন নাও হতে পারে। কারণ কারও জীবন শুধু একটা বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও সে সন্তান, স্বামী বা স্ত্রী বা পিতা বা মাতা বা বন্ধু। তাই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা সব সময়ই ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। আর এর সাথে বিজ্ঞান বা সত্যিকারের ধর্মের সম্পর্ক নেই বললেই চলে।

রুশরা বলে সব সাধুরই ভক্ত থাকে। প্রতিটি মতবাদই কিছু না কিছু অনুসারী পাবে। কেন? কারণ বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে হাজার রকমের ভাবনা আছে। কোনটা ভালো, কোনটা তত ভালো নয়। কিন্তু কোনটা মানুষ খাবে আর কোনটা খাবে না সেটা নির্ভর করে মার্কেটিং-এর উপর। আজ যদি বিজ্ঞান বা মানবতা অন্ধবিশ্বাসের কাছে হেরে যায় সেটা ধর্মের দোষ নয়, বিজ্ঞানমস্ক মানুষের প্রগতির বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার অক্ষমতা। মানুষ প্রায়ই অন্যের মুখ বন্ধ করে নিজের কথা প্রচার করতে চায়। ধর্মের বাধা নিষেধ সেটাই করে। কিন্তু বিজ্ঞানের মূল কথা তো প্রশ্ন করা, সবাইকে কথা বলার সুযোগ দেয়া, সব ধরণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। আর তাই যদি হয় ধর্মকে বিলুপ্ত করার আকাঙ্ক্ষা কি আমাদের নিজেদের ধর্মীয় মৌলবাদীদের মত অন্ধবিশ্বাসী করে তোলে না? এই তো আমাদের দেশে মহা সমারোহে ঈদ উদযাপিত হল। প্রচুর মানুষ যারা ঠিক ধার্মিক নয় তারাও সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালো। দু’ দিন পরে বাঙালি নববর্ষ পালন করবে। যদি একই ভাবে ধর্মে বিশ্বাসীরা নববর্ষ পালনকে স্বাগত জানাতে পারত, যদি ঈদের মত নববর্ষও মানুষ সারা দিন ধরেই পালন করতে পারত, যদি নববর্ষের মঙ্গল যাত্রায় গিয়ে মানুষকে ভয়ে ভয়ে কাটাতে না হত! এসব  হয়তো একদিন হবে। তবে সেটা যাতে হয় সেজন্য কাউকে বাদ দিয়ে নয় সবাইকে নিয়েই সামনে যেতে হবে, এক হয়ে নয় এক সাথে পথ চলতে হবে। আসলে সবাই এক হওয়ার ভাবনাটাই মৌলবাদের জন্ম দেয়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো