মতামত

পৃথিবীর ভাষা ও বাংলা ভাষা

– পৃথিবীতে ভাষার সংখ্যা

Ethnologue ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এর তথ্য মতে বর্তমান পৃথিবীতে ৭১৬৮ টি ভাষা প্রচলিত আছে। আবার Glottolog (জার্মানি) এর তথ্যে ৮৫০০টি ভাষা তালিকাভুক্ত রয়েছে। ৭১৬৮ টি ভাষার মধ্যে পৃথিবীতে মোট ৬৯১২টি জীবন্ত ভাষা আছে। মহাদেশের বিচারে বিশ্বের ৬০০০টির মধ্যে ১৫ শতাংশ ভাষায় কথা বলা হয় দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায়, আফ্রিকায় ৩০ শতাংশ, এশিয়াতেও শতাংশের হিসেব ৩০, সবচেয়ে কম ইউরোপে, সেখানে মাত্র ৩ শতাংশ। প্রায় ৮১০ কোটির মধ্যে প্রায় ৪৮৭ কোটি মানুষ কথা বলেন মাত্র আটটি ভাষায় – ইংরেজি, ম্যান্ডারিন, হিন্দি, স্প্যানিশ, ফরাসী, আরবি, বাংলা ও পর্তুগীজ। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষাবৈচিত্র্য দেখা যায় আফ্রিকা ও এশিয়ায়, যেখানে ২০০০ এরও বেশি ভাষায় কথা বলে মানুষ। মানচিত্রের আরেক পাশ ইউরোপে ২৫০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলে মানুষ।
ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাঃ
একটি গবেষণায় জানা গেছে, পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ মাত্র ১২টি ভাষায় কথা বলে। কিন্তু সেই অল্প কিছু মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাগুলোই তাদের সংস্কৃতিকে ভিন্নভাবে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরছে। ৯৬ শতাংশ ভাষায় কথা বলেন মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ। সাত হাজার ভাষার মধ্যে দুই হাজার ভাষায় কথা বলেন মাত্র ১০০০ মানুষ। পৃথিবীতে ৪২ শতাংশ ভাষাই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থায় আছে; অর্থাৎ, তিন হাজার ৪৫টি ভাষা এখন বিলুপ্তির পথে।
বেশি ভাষার দেশ সমূহঃ
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভাষার আঁতুড়ঘর বা কয়েকটি দেশ হলো – ১. পাপুয়া নিউ গিনি – ৮৫০টি, ২. ইন্দোনেশিয়া – ৭৪২টি (৯৮টি বিশেষ কিছু এলাকায় ব্যবহৃত হয়), ৩. নাইজেরিয়া – ৫২৯টি, ৪. ভারত – ৪৫৪টি (বিলুপ্ত ২৩০টি), ৫. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – ৪২২টি (এর মধ্যে ২১১টি প্রবাসীদের ভাষা), ৬. চীন – ৩০০ টি, ৭. মেক্সিকো – ২৮৫টি, ৮. ক্যামেরুন – ২৮১টি (৫৫টি আফ্রো-এশিয়ান ১৬৯ টি নাইজার -কঙ্গো ভাষ্), ৯.
ব্রাজিল -২১৬টি (বিলুপ্ত ২১), ১০. অষ্ট্রেলিয়া -২১৬টি (বিলুপ্ত ১৮৪)।
বাংলাদেশের ভাষাঃ
সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী ও ৫০টি উপজাতি এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মিলিয়ে বাংলাদেশে ভাষা রয়েছে ৪১টি। তার মধ্যে বাংলা একটি ভাষা।
বাংলা ভাষাঃ
বাংলাদেশের প্রধান ভাষা হলো বাংলা ভাষা। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর প্রায় ২৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা।
বাংলা ভাষার জন্মঃ
সাধারণের ধারনা সংস্কৃত থেকেই বাংলা তথা ভারতের অন্যান্য আধুনিক ভাষাগুলির জন্ম। বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার হতে। ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা বংশের দুটি শাখা (১) শতম (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০) ও (২)কেন্তুম। শতমের আবার ৪টি শাখা – ১. আলবানিয়ান ২. আর্মেনিয়ান ৩. বালটো স্লাভিক ৪. ইন্দো ইরানিয়ান। ইন্দো-ইরানীয় হতে ইন্দো-আর্য (খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০) > ভারতীয় (খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-১২০০) > প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা (খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০) > প্রাচীন কথ্য ভারতীয় আর্যভাষা (খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০) > সংস্কৃত (খ্রিষ্টপূর্ব স্প্যানিশ) > প্রাচীন প্রাচ্য (খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০) > গৌড়ী প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্ব ২০০) > গৌড় অপভ্রংশ (৪০০-৬০০খৃস্টাব্দ) > বঙ্গ কামরূপী (৫০০খৃস্টাব্দ) > বাংলা-অসমীয় > গোদিক > প্রাচীন বাংলা (৬৫০খৃস্টাব্দ) > মধ্য বাংলা (১২০০-১৮০০খৃস্টাব্দ) > আধুনিক বাংলা (১৮০১-)।
বাংলার উপভাষাঃ
বাংলা ভাষার অনেক উপভাষা রয়েছে যেমন – ১. রাঢ়ী উপভাষা, ২. বঙ্গালী উপভাষা, ৩. বরেন্দ্রী উপভাষা, ৪. ঝাড়খণ্ডী উপভাষা, ৫. রাজবংশী উপভাষা প্রধান। এছাড়া আরো কয়েকটি উপভাষা হলো – ৬. সুন্দরবনী উপভাষা, ৭. সিলেটী উপভাষা, ৮. চাঁটগাঁইয়া উপভাষা, ৯. মেদিনীপুরী উপভাষা, ১০. রংপুরী উপভাষা, ১১. বরিশালী উপভাষা, ১২. ময়মনসিংহীয় উপভাষা, ১৩. নোয়াখালীয় উপভাষা প্রভৃতি।
বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাসঃ
বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছর পুরনো। বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের প্রথম নিদর্শন ‘চর্যাপদ ‘। ‘চর্যাপদ ‘ একটি গানের সংকলন। এখানে ২৩ জন কবির ৫১ টি (মতান্তরে ৫০ টি) কবিতা বা গান রয়েছে। ২৩ জন কবির মাঝে কক্কুরী পা চর্যাপদের কবিদের মধ্যে একমাত্র মহিলা কবি। অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করে।
বাংলা ভাষা/সাহিত্যের জনকঃ
বাংলা সাহিত্যের আদি কবি নিয়ে মতভেদ আছে। চর্যাপদের প্রথম পদটি লুইপা রচনা করেন। সেই হিসেবে তাকেই চর্যাপদের আদি কবি বলা হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩ -১৯৩১) সহ অধিকাংশের মতে বাংলা ভাষার আদি কবি হলেন বৌদ্ধধর্মের মহাসিদ্ধ ও ধর্মগ্রন্থের রচয়িতা কবি “লুই পা”। তবে চর্যাপদের কবিদের মধ্যে সর্বাধিক পদ রচনা করেন কাহ্ননপা। তিনি মোট ১৩ টি পদ রচনা করেন। তাই অনেকে বাংলা ভাষার প্রথম কবি এবং আদি কবি বা জনক বলেন কাহ্নপা কে। আবার ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর (১৮৮৫ – ১৯৬৯) মতে খৃষ্টীয় ৬৫০-১২০০ সালের মধ্যে রচিত “চর্যাপদ” আরেক কবি “শবরপা”। আবার কেউ কেউ মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথের কথা বলেন। অন্যদিকে লুই পা এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের আদিসিদ্ধ মীননাথ বা মৎস্যেন্দ্রনাথ একই ব্যক্তি কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। যেমন বিতর্ক রয়েছে মীননাথের জন্মস্থান বরিশাল, সন্দ্বীপ নাকি কামরূপে।
বাংলা ভাষার লিপিঃ
বাংলা ভাষার নিজস্ব লিপি রয়েছে। এই লিপির নাম বাংলা লিপি। সিদ্ধম্ বা সিদ্ধমাতৃকা লিপি থেকে বাংলা লিপির উৎপত্তি হয়েছে। খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয়-প্রথম শতকে ব্রাহ্মী লিপির উত্তর ভারতীয় লিপিরূপ থেকে জন্ম নেয় কুষাণ লিপি, যা থেকে পরে গুপ্ত লিপির উৎপত্তি হয়। গুপ্ত লিপির ক্রমবিবর্তনের ফলে সিদ্ধমাতৃকা লিপির উৎপত্তি হয়, যার কালক্রমিক পরিণতি থেকে বাংলা লিপি বর্তমান রূপ ধারণ করে।
ব্রাহ্মী লিপি > কুষাণ লিপি > গুপ্ত লিপি > সিদ্ধমাতৃকা লিপি > বাংলা লিপি।
বাংলা লিপির ব্যবহার প্রায়ই মধ্যযুগীয় ভারতের পূর্বাঞ্চলে এবং তারপর পাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবহার ছিল। পরে বিশেষভাবে বাংলার অঞ্চলে ব্যবহার করা অব্যাহত ছিল। পরে বাংলা লিপিটিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের অধীনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বারা আধুনিক বাংলা লিপিতে প্রমিত করা হয়েছিল।
বাংলা লিপির বর্ণঃ
বাংলা লিপিতে মূল বর্ণের সংখ্যা ৫০টি। এগুলো আবার দুই ভাগে বিভক্ত (১) স্বরবর্ণ (২) ব্যঞ্জনবর্ণ।
স্বরবর্ণ – বাংলা স্বরবর্ণ হচ্ছে বাংলা ভাষার এমন কিছু লিখিতরূপ যারা ব্যঞ্জনবর্ণের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে উচ্চারিত হতে পারে । আন্তর্জাতিক ৭ টি মৌলিক (ই এ অ্যা আ অ ও এবং উ) স্বরবর্ণের ৬ টি (অ্যা বাদে যদিও বাংলা ভাষার কথ্য ও লেখ্য কথা ও লেখাদিতে উপস্থিত। বিশ্বের প্রতিটি ভাষাতেই এধরনের কিছু বর্ণ রয়েছে। বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের সংখ্যা মোট ১১টি।
ব্যঞ্জনবর্ণ – বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ হচ্ছে এমন কিছু বর্ণ যারা অন্য কোনো বর্ণের সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে উচ্চারিত হতে পারে না। বিশ্বের প্রতিটি ভাষায় এধরনের কিছু বর্ণ রয়েছে। বাংলা ভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা মোট ৩৯টি।
বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যাঃ
বাংলায় প্রায় ৭৫,০০০ পৃথক শব্দ রয়েছে, যার মধ্যে: ৫০,২৫০টি (৬৭%) শব্দ “তৎসম” (সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি গৃহীত), ২১,০০০টি (২৮%) শব্দ “তদ্ভব” (পালি এবং প্রাকৃত ভাষা দ্বারা হয়েছে) এবং “বিদেশী” শব্দ প্রায় ৫০০০ টি।
#লেখকঃ সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলা
সূত্রঃ
* উইকিপিডিয়া।
* বাংলাপিডিয়া।
* কোরা।
* এথ্‌নোলগ (Ethnologue: Languages of the World)।
* গ্লোটোলগ (Glottolog)
* বিবিসি বাংলা।