বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৬):মাইগ্রেশন ও ইমিগ্রেশন

-বিজন সাহা

বেশ কিছুদিন আগে প্রগতির যাত্রীর পক্ষ থেকে আমার সাথে যখন এক জুম আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল তখন রাশিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশীদের অবস্থা সম্পর্কে বেশ কয়েক জন জানতে চাইছিলেন। যেহেতু এ দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সংখ্যা নিতান্তই কম, তাই ভেবেছিলাম এসব নিয়ে আমার ভাবনাগুলো পাঠকদের সাথে শেয়ার করব। ইতিমধ্যে আমার এক সোভিয়েততুতো (রুশতুতো) বন্ধু, অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নে (রাশিয়ায়) পড়াশুনার কারণে যাদের সাথে আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, বর্তমানে ক্যানাডা প্রবাসী রানা মাইগ্রেশন ও ইমিগ্রেশন নিয়ে কয়েক পর্বে ফেসবুকে লিখল। আমি নিজেও এ ব্যাপারে কিছু মন্তব্য করেছি ওর লেখায়। আবার আরেক বন্ধু মানিকগঞ্জের ভজন সরকার ওর দেশত্যাগের গল্প সমগ্র উত্তরের-দেশে পাঠাল। রানার মত ভজন নিজেও বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছে। এ ছাড়া বেশ কিছুদিন আগে মগজ পাচার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রগতির যাত্রীতেই এসব ব্যাপারে কিছু আলোচনা করেছিলাম। সব মিলিয়ে মনে হল এ নিয়ে আরেকটু আলোচনা করলে মন্দ হয় না।

মাইগ্রেশন ব্যাপারটা সেই আদি কাল থেকেই চলে এসেছে। আর এই মাইগ্রেশনের কারণেই মানব জাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। এখনও ধারণা করা হয় যে প্রথম মানবের আবির্ভাব ঘটে আফ্রিকায়। পরে সে খাদ্যের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কেউ ফিরে আসে আর কেউ যায় চিরতরে। আর এখানেই লুকিয়ে আছে মাইগ্রেশন ও ইমিগ্রেশনের পার্থক্য।

আজকাল আমরা প্রায়ই ভাগ্যের সন্ধানে দেশ বিদেশে পাড়ি জমাই। কেউ যাই শুধুই অর্থ উপার্জনের জন্যে আবার ফিরে আসার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে। আবার কেউ যাই সব পাট চুকিয়ে, চিরতরে। তবে সবাই যাই নিজ নিজ সমস্যার সমাধানের খোঁজে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন না কোন সমাধান খুঁজেও পাই। তার মানে এই নয় বিদেশ আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান। কারণ ওরা আমাদের সমস্যার কথা ভাবছে না, সেটা ভেবে সমাধানের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছে না। ওরা নিজেরাও আমাদের সমস্যা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আমাদের সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে ওরা নিজেদের সমস্যার সমাধান করছে। এটা অনেকটা বার্টার সিস্টেম, আমার দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকের অভাব, তোমার অর্থের বা নিরাপত্তার। তাই চল, তোমরা আমাদের শ্রম দাও, আমরা বিনিময়ে তোমাদের আপাত নিরাপত্তা দেব। আপাত নিরাপত্তা এ কারণেই বলছি যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা আজকের সমস্যার সমাধানের জন্য বিদেশে পাড়ি দিচ্ছি, কিন্তু এর ফলে যে আমাদের ভবিষ্যৎ বিভিন্ন ধরণের নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে যেতে পারে সেটা নিয়ে অনেকেই ভাবছি না। নিরাপত্তার বলতে আমি যতটা না অর্থনৈতিক বা শারীরিক নিরাপত্তার কথা বলছি তারচেয়ে বেশি করে বলছি সাংস্কৃতিক ও মানসিক নিরাপত্তার কথা। বিশেষ করে বর্তমান বাস্তবতায়। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা এখনও অতীতের লেখাপড়ায় সীমাবদ্ধ, বর্তমানে এসব দেশ যে কালচারাল, রেনেসাঁই বলি আর শকই বলি, পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা সম্পর্কে আমাদের খুব কমই জানা আছে। কারণ এটা শুরু হয়েছে অতি সম্প্রতি। হয়তো বা এখন যাদের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে তারা কিছুটা বুঝছে। তবে এটাও হতে পারে অনেক কিছুর মত তারা এটাও মেনে নেবে বা এতেও অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তবে এসব সমস্যা সাধারণত তাদের ক্ষেত্রে ঘটে যাদের জীবন সম্পর্কে বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজস্ব জোরালো মতামত আছে। যারা সব জায়গায় স্রোতের সাথে ভেসে চলতে অভ্যস্ত তাদের এসব সমস্যায় পড়তে নাও হতে পারে। তবে এ কথাও ঠিক যে এই সমস্যা যে শুধু বিদেশেই হয় তা নয়, দেশেও হয় আর হয় বলেই প্রচুর মানুষ আজ দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে। যদিও মানব সভ্যতার ইতিহাস এটা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাবার ইতিহাস, নতুন জীবনের সন্ধানে অজানার পথে পা বাড়ানোর ইতিহাস, তবে যখন থেকে মানুষ মাটিতে শেকড় গেড়েছে মানে কৃষি কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে, তখন থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই জায়গার বাস করা তার রক্তে মিশে গেছে। তখনও অবশ্য রাজারা রাজ্য জয় করতে বেড়িয়েছে, বনিকেরা গেছে বাণিজ্য করতে অথবা প্রচারকরা ধর্ম প্রচার করতে। তবে মূলত মানুষ কোন এক জায়গায় বাস করতেই স্বাছন্দ্য বোধ করতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় বড় বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের যুগ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর অথবা ভারত বিভাগের পর লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে আবার নতুন করে শুরু হয় মানুষের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে নতুন আবাসের সন্ধান। এসব মাইগ্রেশন বা ইমিগ্রেশন স্বতঃস্ফূর্ত নয়, এসব বিপদে পড়ে, বাধ্য হয়ে। সেটা এখনও চলছে। যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু লোক আজও পাড়ি জমাচ্ছে ভিনদেশে। আবার প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে, বিশেষ করে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হবার ফলে এখন অনেকেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিদেশে যাচ্ছে উন্নত জীবনের সন্ধানে। ভারত বিভাগের সময় দেশত্যাগ ছিল দুই ধরণের – বাধ্যতামূলক ও স্বতঃস্ফূর্ত। যারা ভারত বিভাগ চায়নি, মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পাকিস্তান থেকে ভারতে গেছে প্রায় বাধ্য হয়ে, অন্য দিকে ভারত থেকে যারা পাকিস্তানে গেছে তাদের একটা বড় অংশের জন্য সেটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। দেশ থেকে এই চলে যাওয়া আজও অব্যাহত আছে। তবে তখন যদি মূলত যেত হুন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, এখন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও প্রচুর হারে দেশত্যাগ করছে। হিন্দুরা মূলত যাচ্ছে চিরতরে, মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন চিরতরে গেলেও দেশে একটা ঠিকানা ঠিকই রেখে যাচ্ছে। মনে পড়ে ছোটবেলায় আমাদের মুসলিম বন্ধুরা বলত, তোদের তো ইন্ডিয়া আছে, আমরা যাব কোথায়? বর্তমানে সারা বিশ্বের দ্বার খুলে যাওয়ায় সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে, বিদেশে যাচ্ছে সবাই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে সমস্যা হচ্ছে তা হল এখন যারা বাইরে জাছে, তারা শুধু সেখান থেকে নিরাপত্তা আর ভাল বেতন নিতেই যাচ্ছে, সে সব দেশের সংস্কৃতি, সেসব দেশের চিন্তাভাবনা গ্রহণ করতে নয়। নব্বুইয়ের দশকে পড়েছিলাম ইংল্যান্ডে সিলেতের মানুষের মাদ্রাসার জন্য আন্দোলনের কথা। অর্থাৎ কী এখন, কী তখন – সব সময় আমরা বিদেশে যাই নিজেদের মন্ত্র জপ করতে করতে, সেসব দেশের শিল্প বিপ্লব ও আধুনিক ভাবধারার লাভটুকু পেতে। সাধারণ মানুষ যারা স্বল্প সময়ের জন্য বিদেশে যায় ও দেশেই সবকিছু গড়ে তুলে, মানে মূলত আরব বিশ্বে কর্মরত শ্রমিক শ্রেণির বাঙালি থাকার প্রচেষ্টা বোঝা যায়, শিক্ষিত মানুষদের ক্ষেত্রে সেটা বোঝা কষ্ট। অন্তত যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তারা বাংলায় লেখে, বাংলায় গায়, বাংলায় বই ছাপায়। তারা নিশ্চয়ই সেসব দেশে সাফল্যের সাথে কাজ করে, কিন্তু বাংলার জন্য, বাংলা প্রতি তাদের প্রচণ্ড আবেগের বহিঃপ্রকাশ তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ দেশত্যাগ করলেও তারা ঠিক দেশকে ছাড়তে পারছে না। তারা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ গড়তে চাইছে। কেন?

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৭): ভাষা ও উন্নয়ন -বিজন সাহা

কারণ দেশে থাকলেই যে তারা নিজেদের ইচ্ছে মত শিক্ষা সংস্কৃতির ছোঁয়া পেত সেই নিশ্চয়তা নেই। প্রথমত ইতিমধ্যে দেশেও ব্যপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটেছে। আর সেটা শুধু ধর্মীয় কারণেই নয়। আমাদের নিজেদের গ্রামেই এক সময় প্রায় সমান সমান হিন্দু মুসলমান বসবাস করত। পাকিস্তান আমলে আর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কেউ ভারতে আর কেউ অন্যান্য গ্রামে বা শহরে। আর এই শূন্য স্থান পূরণ করেছে পদ্মা পাড়ের নদী ভাঙা মানুষেরা। যদিও মাত্র ১০ – ১৫ মাইলের ব্যবধান, কিন্তু এর ফলে গ্রামের পরিস্থিতির বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। এমন কি গ্রামের মুসলমান বাসিন্দারাও সেটা বলেন। ফলে এমনকি একই ভাষাভাষী, একই ধর্মাবলম্বী হবার পরেও গ্রাম নতুন ও পুরানো বাসিন্দা – দুই ভাগে বিভক্ত। দুই গোষ্ঠীর পেশা, জীবন দর্শন একেবারেই ভিন্ন। তাই যারা বাইরে যাচ্ছেন, দেশে থাকলেই যে তারা আগের মতই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বসবাস করতে পারতেন সেটাও গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। মনে পড়ছে রুশ বিপ্লবের পর দার্শনিক জাহাজের কথা। সেই সময় রুশ উচ্চবিত্তদের অনেকেই দেশ ছেড়ে ফ্রান্স, আমেরিকা এসব দেশে চলে যান। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে প্রাচীন রুশ সাহিত্য ও সংস্কৃতি ধরে রেখেছিলেন। নাবোকভ সহ অনেক বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক, গায়ক, বিজ্ঞানী এদের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছিল। হয়তো বা বিদেশে বসবাসকারী যারা আজ বাংলা ভাষার চর্চা করছেন তাদের হাতে রক্ষা পাবে ভাষা যা দেশ আজ ব্যাপক হারে হিন্দি, আরবী এসব ভাষা দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন দেশের পাট চুকিয়ে ভিন দেশের মাটিতে স্থায়ী ভাবে শেকড় গাড়ার পরেও আমরা কেন দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। আমার ধারণা কয়েক প্রজন্ম পরে সেটা হবে। পশ্চিম বঙ্গে বেড়াতে গেলে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনলে নস্টালজিক হয়ে যান। আমার যে দাদারা আমার জন্মের আগে মানে ৬০ বছর আগে দেশ ছেড়ে চলে গেছে তারা এখনও এলাকার বিভিন্ন বাড়িঘর, লোকজনের কথা জিজ্ঞেস করে। তাদের ছেলেমেয়েরা করে না, কারণ তাদের সেই স্মৃতি নেই। আমাদের দেশের মানুষ এখনও সে অর্থে গ্রাম্য, মানে প্রায় প্রতিটি পরিবারের শেকড় গ্রামে গাঁথা। এটাই হয়তো তাদের এখনও বাঙালি করেই রেখেছে। কবি ভাষায় বাঙালি করেছ মোরে মানুষ করনি। মনে পড়ে মস্কোয় শতাধিক দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে মেশার, তাদের সংস্কৃতি জানার সুযোগ থাকার পরেও আমরা মূলতঃ নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়েছি। আসলে আমাদের লোকজন সাথে করে একটা ছোট বাংলাদেশ নিয়ে যায় বা বাইরেও একটা ছোট বাংলাদেশ গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, হিন্দু, মুসলমান কোন কিছুর অভাব থাকে না। দেশের প্রতি, ভাষার প্রতি টান থাকা ভালো, বিদেশে নিজেদের জন্মভূমিকে তুলে ধরা ভালো, তবে বাইরে গিয়ে নিজে তাদের একজন না হতে পারলে দেশত্যাগ এক ধরণের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ ভিন দেশে যায় কোন সমস্যার সমাধান খুঁজতে। আর সেসব সমস্যার একটা দেশের সামাজিক বা কাজের পরিবেশের সাথে মেলাতে না পারা। কিন্তু বাইরে গিয়ে সেখানকার সমাজের সাথে যদি না মিশি বা না মিশতে পারি তাতে সমস্যার স্থান পরিবর্তন হয়, সমাধান হয় না। আরও একটা কথা এসব দেশে অধিকাংশ মানুষ যায় টাকা উপার্জন করতে, সেসব দেশের নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে, সে দেশের সংস্কৃতি সাহিত্য এসব শিখতে নয়। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন। আগে আমাদের লোকজন বাইরে যেত সেখান থেকে শিখতে, শিখে দেশে ফিরে তার প্রয়োগ করতে। সেই সময়ের রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী – এসবের বড় উদাহরণ। এখন কেউ আর শিখতে যায় না, যায় সেখানকার সুবিধা ভোগ করার জন্য। তাই শিক্ষাটা সেইটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ যা তাকে বেশি উপার্জনে সাহায্য করে। অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটাই ঘটে বলে আমার অল্প অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো