বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৩):বিজ্ঞান ও বানিজ্য

-বিজন সাহা

গত সপ্তাহে আমরা বলেছিলাম যে বিজ্ঞান আসলে প্রতিনিয়ত চর্চা করার বিষয়। বিজ্ঞানে ষাট সত্তর বছর বয়স বলে কিছু নেই। আমি পদার্থবিদ। কী আমাদের রিসার্চ ইনস্টিটিউট জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ কী গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, তত্ত্বীয় বিভাগে ৮০, ৮৫, ৯০ বা এর বেশি বয়সের অনেকেই কাজ করছেন আর কাজ করছেন খুবই সক্রিয় ভাবে। খেলোয়াড়দের যেমন প্রতিটি ম্যাচে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় গবেষকদেরও ঠিক তেমনি। তাদের প্রতিনিয়ত নিজেদের কাজকে উন্নত থেকে উন্নততর করতে হয়। এটা আসলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। তবে রুটিন মাফিক কাজ যেমন শিক্ষকতা যদি বছরের পর বছর একই ভাবে চালিয়ে নেয়া যায়, গবেষককে সব সময়ই নতুন কিছু দিতে হয় যা আগে কেউ করেনি। আর শুধু নতুন রেজাল্ট পেলেই হবে না, সেটা অন্যান্য গবেষকদের দরবারে পেশ করতে হয় রায়ের জন্য। তাই এখানে থেমে থাকার সুযোগ নেই। তবে বিজ্ঞানে সব সময়ই গবেষণার ফলাফলের নতুনত্ব, মৌলিকতা, তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক গুরুত্ব, নির্ভরযোগ্যতা – এসব প্রমাণ করে সামনে যেতে হয়। তাই আজ এ দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত আছে বলে বাইরের পত্রিকায় পেপার পাবলিশ না করার চিন্তা সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ বিজ্ঞান দেশ কালের ঊর্ধ্বে। এখানে সংকীর্ণমনস্কতার সুযোগ নেই।

সমস্যাটা হল বিজ্ঞানীরা এই সমাজেরই মানুষ। তাই বিজ্ঞান নিজে না হলেও বিজ্ঞানীকে সমাজের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হয়, সমাজে প্রচলিত নিয়ম কানুন মেনে চলতে হয়। গত সপ্তাহে বন্ধুর সাথে কথার এক পর্যায়ে চলে আসে কিউ-১, কিউ-২ ইত্যাদি পত্রিকার রেটিং-এর কথা। মাত্র কয়েক বছর আগেও পত্রিকার এ ধরণের রেটিং ছিল না। আমরা নিজ নিজ প্রোফাইলের পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম। আসল কথা ছিল নামকরা, ভালো জার্নালে নিজের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা। একটা সময় ছিল যখন অধিকাংশ ভালো ভালো জার্নাল বিনে পয়সায় গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করত। কিছু কিছু জার্নাল যে পয়সা নিত না তা নয়, তবে আমার পক্ষে সেটা দেয়া কখনই সম্ভব হয়নি। তাই ওদিকে কখনই পা মাড়াইনি। তবে ইদানিং অনেক নামকরা জার্নাল বন্ধ না হলেও আগের মত নিজেদের আর ধরে রাখতে পারেনি। সেটা আর সব কিছুর মতই। কোডাকের মত বড় কোম্পানি আজ বাজারে নেই। নেই এরকম অনেক কিছুই। একই অবস্থা গবেষণার বাজারেও। সেসব জায়গায় আসছে বাণিজ্যিক পত্রিকা। এটা ঠিক যে এসব পত্রিকার মান যথেষ্ট ভালো। মানে তারা শুরু থেকেই নামী দামী বিজ্ঞানীদের এডিটরিয়াল বোর্ডে এনে এবং ভালো রিভিউ করে পত্রিকার মান তৈরি করে। তাই সেখানে লেখা প্রকাশের জন্য সমস্ত ধরণের চেক আপের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। তবে এরপর সেখানে পয়সা দিতে হয়। এটা সবাই পারে না, বা সব দেশের সব ইনস্টিটিউট সেটা করে না। আমার মনে আছে একটা ঘটনার কথা। একটা পেপার একটা জার্নালে সাবমিট করার পর সেখান থেকে উত্তর পেলাম আমার লেখার বিষয় ওদের জার্নালের জন্য উপযুক্ত নয়। অথচ এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই পত্রিকায় একই বিষয়ে আমার গোটা দশেক গবেষণা পত্র বেরিয়েছে। কিন্তু এসব রিফিউজালের কোন উত্তর হয় না। পরের দিন ওদের কাছ থেকে একটা মেইল পাই। সেখানে কয়েকটি জার্নালের নাম যেখানে আমার লেখা সাবমিট করতে পারি। খোঁজ নিয়ে দেখি এসবই ঐ পাবলিশার্সের জার্নাল, তবে সেখানে বিনে পয়সায় লেখা ছাপানো হয় না। আমি ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমার অপারগতার কথা জানালাম। পরে অবশ্য সেই জার্নালেই বিনে পয়সায় লেখাটি ছাপিয়েছিল। এসব কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য – বলা যে দিন দিন বিজ্ঞান ব্যবসায়ে পরিণত হচ্ছে। এখন তো দেশে দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে যেখানে পয়সা দিয়ে পড়াশুনা করতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ একান্তই কমার্শিয়াল হলেও অনেকেই পড়াশুনার মানের দিকেও খুব নজর দেয়। সেটা অবশ্য সব সময়ই ছিল। পুঁজিপতিরাই সব সময় বিজ্ঞানকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু তখন মানুষ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে ইনভেস্ট করত। এখন সবাই চায় তৎক্ষণাৎ লাভ, তাই যারা থিওরিতে কাজ করে তারা খুব একটা যত্ন আত্তি পায় না।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৩৪):বিজ্ঞান ও রেটিং-বিজন সাহা

এবার আসি বিভিন্ন পত্রিকার কথায়। এখন অধিকাংশ জার্নাল বিভিন্ন রেটিং-এর মধ্য দিয়ে যায়। মূল ভাগ কিউ-১, কিউ-২, কিউ-৩ ও কিউ-৪। অবশ্য সব জার্নাল যে এখানে পড়ে তা নয়। রাশিয়ার বেশ কিছু জার্নাল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এসব ক্যাটাগরি থেকে বাদ পড়েছে। এমনকি আজকাল কোন জার্নালে পেপার সাবমিট করতে গিয়ে দেখি আমার ইনস্টিটিউটের নাম ওদের রেজিস্টার থেকে বাদ পড়েছে। যাহোক। আমাদের দেশের বাবা-মারা যেমন ছেলেমেয়েদের জিপিএ-৫ বা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউটগুলোও একই ভাবে চায় তাদের গবেষকরা যেন কিউ-১ বা কিউ-২ জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। এর উপর নির্ভর করে প্রমোশন ইত্যাদি। বিশেষ করে এটা দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণটা মনে হয় ভালো জার্নালে শিক্ষকদের পাবলিকেশন থাকলে বিদেশী ছাত্রদের আকৃষ্ট করা সহজ হয়। বিশেষ করে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাজেটের একটা বড় অংশ আসে বিদেশী ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে। এটা ঠিক এরা বিদেশীদের স্টাইপেন্ড দেয়, তবে তার চেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে অর্থের বিনিময়ে। এছাড়া অন্য কোন ব্যাখ্যা দেখি না। তাই প্রথম দিকে যখন বলা হত কিউ-১, কিউ-২ পত্রিকায় পাবলিশ করার জন্য, শুধু তাই নয়, এসব জার্নালে পেপার বেরুলে আর্থিক ভাবে উৎসাহিত করা হত, তখন এটাকে আমার অন্তত নম্বরের পেছনে ছোটার মত মনে হত। তবে ইদানিং কালে মনে হয় বর্তমান অবস্থায় এসব চেষ্টা থাকা উচিৎ। কেননা পশ্চিমা বিশ্ব সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে যা কিছু রুশ তা নিষিদ্ধ করতে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, শিল্প, বানিজ্য – সব দিক থেকেই রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টা চলছে। ভুলে গেলে চলবে না যে ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক কারণের একটা ছিল নর্থ স্ট্রীম। ইউরোপের বাজার থেকে রাশিয়ায় তেল গ্যাস সরানোর জন্য আমেরিকা এটা করেছে। এর আগে থেকেই বিভিন্ন সময় সত্য মিথ্যা বিভিন্ন অভিযোগে রাশিয়ার খেলোয়াড়দের অলিম্পিক, বিশ্বকাপ ইত্যাদি প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রাশিয়ার সব কিছু নিষিদ্ধ করা। তাই আমাদের বরং আরও বেশি করে চেষ্টা করা উচিৎ এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এসব জার্নালে পবলিশ করা। তবে একই সাথে উচিৎ রুশ জার্নালে পাবলিশ করা, লোকাল জার্নালগুলোর মান উন্নত করা। আসলে সোভিয়েত আমলে এসব জার্নাল খুবই ভালো ছিল। তখন স্থানীয় গবেষকরা এসব জার্নালে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বাইরের জার্নালে পাবলিশ করা যখন অনেক সহজ হয়ে গেল, সবাই তখন শুরু করল সেসব জার্নালে লিখতে। আর এভাবে নিজেদের জার্নালগুলো পিছিয়ে পড়তে শুরু করল। আমার মনে হয় এটাও একটা সুযোগ নিজেদের জার্নালগুলোর উন্নতি করার। যদি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এদের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিকে নিজের পায়ে দাড় করাতে পারে, যদি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এদের এগ্রিকালচারকে নিজেদের পায়ে দাড় করাতে পারে তাহলে এটা কেন সাহায্য করবে না এদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাঁজাতে? তাই বাইরের ভালো জার্নালের পাশাপাশি দেশের পত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে, খুঁজতে হবে ভারসাম্য। এ নিয়ে পরের পর্বে।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো