মতামত

বাংলাদেশের শ্রম খাতের জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা

– ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

 

বাংলাদেশের শ্রম খাতের চ্যালেঞ্জ সমূহ চিহ্নিত করে তা মোকাবেলায় এবং শ্রম সেক্টরের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষে বাংলাদেশ ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময়ের জন্য জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনাটি ছিল.২০১৯ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ কমিশনের নবম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলাফল। এই উদ্যোগ শোভন কাজ বাস্তবায়ন এবং সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষে জাতিকে পরিচালিত করার লক্ষে সরকারের প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করে।  তবে ইতিমধ্যে অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেলেও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে খুব বেশী অগ্রগতি হয়েছে বলে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। জাতীয় পরিকল্পনার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল শ্রম আইনের সংশোধন। বিগত সংসদে শ্রম আইন সংশোধনের বিল পাশ হয়েছিল বটে তবে তাতে ছিল নানা অসংগতি। ফলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি উক্ত বিলে স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠিয়েছেন।

পটভূমিঃ সুদীর্ঘকাল যাবৎ বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ পরিক্রমায় এদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রধান অবদান অনস্বীকার্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) অর্জন এবং এর নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য দেশের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে শ্রম খাতের জন্য জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ এদেশের শ্রমজীবী মানুষের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

প্রধান উদ্দেশ্যঃ শ্রম খাতের জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা মূলত একটি কৌশলগত রোড ম্যাপের রূপরেখা দেয় এবং বিভিন্ন মূল উদ্দেশ্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রম খাতকে টেকসই ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গতিশীল শক্তিতে রূপান্তরিত করা। জাতীয় পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে, শোভন কাজ বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ, শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের মান উন্নত করা, শিশু শ্রম নির্মূল করা এবং শ্রম খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।

শোভন কাজ বাস্তবায়নে উদ্যোগঃ জাতীয় শ্রম কর্ম পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শোভন কাজ বাস্তবায়নের উপর জোর দেওয়া এবং একইসাথে মান সম্পন্ন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। মান সম্পন্ন  কর্মসংস্থান বলতে আমরা বুঝি শ্রমের ন্যায্য মজুরি এবং শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করা। আমাদের দেশে যেহেতু জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশী এবং জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। সুতরাং শোভন কাজ বাস্তবায়ন এবং মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান নিশ্চিতের মাধ্যমে সকল শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই ও গণমুখী হয়।

পেশাগত নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যঃ শ্রম বিষয়ক জাতীয় কর্ম পরিকল্পনায় একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং দেশের সকল শিল্প-কলকারখানায় পেশাগত নিরাপত্তা এবং সকল শ্রমজীবী মানুষের স্বাস্থ্যের মান উন্নত করার উপর জোর দেয়। কর্মক্ষেত্রের মালিক-শ্রমিক উভয়ের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে  একটি কার্যকর পরিদর্শন ব্যবস্থা গঠনের মাধ্যমে একটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হ্রাস এবং কর্মীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

শিশু শ্রম নির্মূলঃ বাংলাদেশে শিশু শ্রমের ব্যাপকতা শ্রম খাতের জন্য একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। এই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে শিশু শ্রমকে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসাবে বর্ণনা করে শ্রম খাতে শিশু শ্রম নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জাতীয় পরিকল্পনায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে আছে শক্তিশালী এবং কঠোর আইন প্রণয়ন করে প্রয়োগের প্রক্রিয়াকে উন্নত করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের বিকল্প শিক্ষাগত কর্মসূচী বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে কেবল শিশু শ্রম নির্মূলই একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না বরং শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের শ্রম শক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ এবং পরিকল্পনা গ্রহণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নঃ কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন শ্রম খাতের জাতীয় কর্ম পরিকল্পনার অন্যতম মূল স্তম্ভ। মহিলা কর্মীদের বিকাশের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে লিঙ্গ সমতাকে উন্নীত করতে এবং বৈষম্য দূরীকরনে বিভিন্ন শিল্পে নিয়োজিত মহিলাদের উন্নতির জন্য  পরিবেশ সৃষ্টি করা এ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল প্রতিবন্ধকতা ভেঙে এবং নারী শ্রমিকদের অনর্ভুক্তির সুযোগ বৃদ্ধি করে শ্রম খাতকে এমন একটি স্তরে নিয়ে যেতে হবে যাতে নারী শ্রমিকেরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।

দক্ষতা উন্নয়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিঃ শ্রম শক্তির সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য, জাতীয় শ্রম কর্ম পরিকল্পনা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর জোর দেয়। এরমধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণ কর্মসূচী, বৃত্তিমূলক শিক্ষার উদ্যোগ এবং শিল্পের সাথে অংশীদারিত্ব তৈরি করা -যাতে শ্রমিকেরা ক্রমবর্ধমান চাকরির বাজারের  চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। মানব পুঁজিতে বিনিয়োগ করে এ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে শ্রম খাতের ন্যায় ভিত্তিক প্রতিযোগিতা বাড়ানো।

পর্যবেক্ষন এবং মূল্যায়নঃ একটি শক্তিশালী এবং মূল্যায়ন কাঠামো জাতীয় শ্রম কর্ম পরিকল্পনার সাফল্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরিকল্পনাটি নিয়মিত উন্নয়ন এবং অগ্রগতি মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ও সামঞ্জস্যপূর্ণ বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি রূপরেখা প্রদান করে এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতাও নিশ্চিত হয়। এধরনের পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য অনেকের কাছে উচ্চাকাংখা মনে হলেও শ্রম খাতের উন্নয়নের একটা বাস্তবসম্মত প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

উপসংহারঃ বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ চিহ্নিত করে একটি শ্রম বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে শ্রম খাতের জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা (২০২১-২০২৬) একটি মাইলফলক হতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা এ পরিকল্পনা বায়বায়নে মূল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করে ন্যায়সঙ্গত এবং আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য একটি অনুকূল কর্ম পরিবেশ তৈরি করবে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। তন্মধ্যে প্রায় ৭ কোটির অধিক শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বৈষম্য এবং শোষণ থেকে মুক্তি। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও যখন শ্রমজীবী মানুষের ন্যুনতম অধিকার নিয়ে কথা বলতে হয় সেটা খুবই দুঃখজনক।

২০২১ সাল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের শ্রম খাতের জাতীয় কর্ম পরিকল্পনার রোডম্যাপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশ আন্তরিকতার পরিচয় দিবে এমনটিই প্রত্যাশা।

(লেখকঃ কোঅর্ডিনেটর, ওশ সেন্টার, বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্প এবং সংগঠক, টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটি)