বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১২৮): শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবস 

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

 

কয়েকদিন আগে জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবস পালন করল। প্রতি বছরই পালন করে। তবে মনে হয় এসব দিবস উদযাপন কেমন যেন রুটিন মাফিক কাজে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মানুষজন রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। কিছু কিছু অনুষ্ঠান হয়। মূলত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানরা নিজেদের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন আলোচনা সভার আয়োজন করে। হতে পারে আমি ভুল করছি। তবে বাইরে থেকে সব দেখে এমনটাই মনে হয়। এই দিনটি বরাবরই বিজয় দিবসের আড়ালে ছিল, এখনও আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। আমার তো মনে হয় এই দিনই স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বীজ রোপণ করেছিল। আর সেই বীজ থেকেই  অঙ্কুরিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যেদিন শুধু বঙ্গবন্ধুকেই সপরিবারে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্নকে, হত্যা করা হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে, হত্যা করা হয়েছিল হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে। সেই অঙ্কুর আজ মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। আজ দেশে যে মৌলবাদের উত্থান সেটার শুরুও সেই ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর।

সত্যি বলতে কী দেশে থাকাকালীন আমি নিজেও এ নিয়ে খুব একটা সচেতন ছিলাম না। হয়তো ঢাকা ও অন্যান্য বড় বড় শহরে এ দিনটি পালন করা হত, কিন্তু ছোট শহর বা গ্রামে ১৪ ডিসেম্বর নিয়ে কোন কিছু বলা হত কিনা সেটা মনে করতে পারছি না। আর পঁচাত্তরের পরে যখন বঙ্গবন্ধু সহ একাত্তরের ইতিহাসই মানুষকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়, কী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম সেটা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় তখন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে যে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করা হত না সেটাই স্বাভাবিক। আসলে শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবী কেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি, হয় না। হলে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা হয় সেখানে এত ভুল থাকার কথা ছিল না। আমরা সব সময় বলি ত্রিশ লক্ষ শহীদ, কিন্তু সেই বিমূর্ত সংখ্যাকে অবয়ব দেবার চেষ্টা কি আমরা কখনও করি? আমাদের গ্রামেই বেশ কিছু লোক একাত্তরে নিহত হয়েছে। এছাড়া তরা ঘাঁটে কত লোক যে হত্যা করা হয়েছে তার হিসেব কে রাখে? তরা ঘাঁটকে বধ্যভুমি হসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও সেখানে কারা মারা গেছে, কাদের হাতে মারা গেছে সেই ইতিহাস উদ্ধার করার জন্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। একই কথা বলা যায় প্রায় প্রতিটি বধ্যভূমি সম্পর্কে। হয়তোবা রাশিয়া না এলে, এখানে প্রতিটি জনপদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত মানুষের নাম খোঁদাই করা দেয়াল না দেখলে এসব কথা মনেই হত না। যদিও আমার খেলার সাথী কয়েক জনের বাবা বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন একাত্তরে ঘাতক দালালদের হাতে মারা গেছে তবে দেশে থাকাকালীন শুধু সমবেদনা প্রকাশ করা ছাড়া এ নিয়ে বেশি কিছু করার চিন্তা মাথায় আসেনি। হতে পারে বয়সের কারণে, হতে পারে সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে। স্বাধীনতার পর পর সবাই ব্যস্ত ছিল নয় মাসের যুদ্ধে বিপর্যস্ত জীবন নতুন করে গড়ে তুলতে। আর পঁচাত্তরের পরে তো এসব নিয়ে ভাবাও অপরাধ ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতি অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

গত ১৬ ডিসেম্বর কাকতালীয় ভাবে ভ্লাদিমির পুতিনের অনলাইন প্রশ্নোত্তর সেশন ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আধুনিক জার্মানির প্রতিষ্ঠাতা বিসমার্কের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন “সেনাপতিরা যুদ্ধ জেতে না, যুদ্ধ জেতে স্কুলের শিক্ষকগণ আর পাদ্রীরা।” আসলেই তাই। স্কুলেই তৈরি হয় ভবিষ্যৎ নাগরিক আর সে কেমন হবে সেটা নির্ভর করে শিক্ষক কী শিক্ষা দিচ্ছেন তার উপর। তাছাড়া চাই বা না চাই, সাধারণ মানুষের উপর ধর্মের বা সঠিক করে বললে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব অনস্বীকার্য। তাই শিক্ষক আর ধর্ম প্রচারকারীরা জনগণকে কী বলবে সেটার উপর নির্ভর করে জাতি দেশপ্রেমিক হবে কি হবে না বা দেশ বলতে সে কী বুঝবে। অনেক কিছুর মতও দেশ বিমূর্ত ধারণা। এটা শুধু মানুষ বা ভূখণ্ড নয়, এটা কিছু ধারণা যার উপর নির্ভর করে দেশের চেহারা, চরিত্র।

যুদ্ধ কখনই একমাত্রিক নয়, জীবনের অনেক কিছুর মত যুদ্ধও বহুমাত্রিক। যুদ্ধ শুধু সেনারাই করে না, করে সমস্ত জাতি। সেনাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরি করে একদল, আরেক দল তৈরি করে পোশাক, খাবার। তাছাড়া শুধু সৈনিক দিয়ে তো আর দেশ বা জাতি গড়ে ওঠে না, সেখানে থাকে প্রচুর নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যাদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছু দরকার। তাই যুদ্ধ মানেই প্রচুর মানুষের সম্পৃক্ততা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়াতে তাই যুদ্ধ বা ফ্রন্ট ভেটেরানের পাশাপাশি সরবরাহকারী বা হোম ফ্রন্ট ভেটেরানও ছিল, আছে। কিন্তু আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধা শুধু তারাই যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। আর সময় মত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি না করায় পরবর্তীতে এমনকি একাত্তরে জন্মগ্রহণ করা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছে আর বাদ পড়ে গেছে অনেক আসল মুক্তিযোদ্ধা। আমার ধারণা দেশের বর্তমান একাত্তর বিমুখ রাজনৈতিক যাত্রাও এর সাথে জড়িত।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১২৯): সম্মেলন –বিজন সাহা

অনেকেই বলে দেশপ্রেম হল বখাটের শেষ আশ্রয়স্থল। হয়তোবা অতি ধূর্ত কেউ কেউ দেশপ্রেমকে নিজের ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করে, তবে সাধারণ মানুষ, যারা ব্যক্তিগত লাভ লোকসান নয়, দেশের প্রতি ভালবাসা থেকেই দেশের জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধাবোধ করে না তাদের জন্য দেশপ্রেম কোন ফাঁকা বুলি নয়। ফেসবুকে প্রায়ই এরকম একটি স্ট্যাটাস দেখি “স্কুল কলেজে শিক্ষিত যুবকেরা নয়, গ্রাম গঞ্জের চাষাভুষার ছেলেমেয়েরাই নিজের প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছে।” কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। কারণ একাত্তরে আমাদের দেশে পড়ুয়া ছেলেদের সংখ্যা তেমন ছিল না, তারপরেও এই ছাত্ররাই দেশের স্বাধীনতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আবার স্বাধীনতা পরবর্তী কালে শিক্ষিত মানুষেরাই দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এমনকি এখনও যারা বিভিন্ন দেশে কায়িক পরিশ্রম করে মানবেতর জীবন যাপন করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে অথবা যেসব নারীরা নামমাত্র বেতনে গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করে তারাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর শিক্ষিত মানুষ, যাদের কথা ছিল সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়া, তারাই দেশকে উল্টা পথে চালিয়েছে, তারাই দেশকে আবার সাম্প্রদায়িকতার পথে নিয়ে গেছে, যাচ্ছে। আবার তারাই সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে চালান করছে। রাশিয়াতেও দেখি যারা যুদ্ধ করছে তাদের অধিকাংশই সাধারণ পরিবার থেকে। এটা ঠিক অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের ছেলেমেয়েরা যুদ্ধে গেছে, যাচ্ছে, অনেক সাংসদ নিজেদের ম্যান্ডেট জমা দিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে, সাধারণ সেনাদের সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। তবে এই সময় যারা দেশ ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে চলে গেছে তারা হয় আপার ক্লাসের অথবা শিক্ষিত ছেলেমেয়ে যারা সহজেই বিভিন্ন জায়গায় কাজ পেতে পারে।

বর্তমানে দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে আমার কেন যেন মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বর আর কিছুটা পয়লা বৈশাখ ছাড়া আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একে একে বছরের বাকী সবগুলো দিন আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এবার ফেসবুকে দেখলাম বিজয় দিবসে কোথাও কোথাও উর্দু ভাষায় অনুষ্ঠানের চিত্র। সমস্যাটা উর্দুতে নয়, তবে ভয় হয় এটাও একাত্তরের চেতনায় যারা বিশ্বাস করে তাদের কাছ থেকে এসব দিনগুলো কেড়ে নেবার পায়তারা।

আমরা প্রায়ই বলি ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করা হয়েছিল। কথাটি আংশিক ভাবে সত্য। শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয় যুদ্ধের সমস্ত সময় ব্যাপী যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বা নিতে পারতেন সেই সব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। প্রশ্ন হল ১৪ ডিসেম্বর গণহারে বুদ্ধিজীবী হত্যা করা না হলে দেশ কি অন্য পথে চলতে পারত কিনা? ইতিহাসে যদি, কিন্তু এসবের জায়গা নেই। তবে আমরা ভেবে দেখতেই পারি। এসব বুদ্ধিজীবীরা দেশের ভেতরে থেকে হাজারো ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দেশের জন্য প্রকাশ্যে কাজ করে গেছেন শত্রুর মাঝে বাস করে। অনেকেই ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ যাদের কথা তিনি শুনতেন ও যাদের তিনি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন না। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু অন্য কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়েই হোক অথবা সন্দেহ বশতই হোক, নিজের অনেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে বঙ্গবন্ধু নিজের উপর এতটাই আস্থাশীল হয়ে ওঠেন যে স্বাভাবিক সাবধানতা অবলম্বন করতেও ভুলে যান। হয়তোবা ১৪ ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হতেন। যারা একাত্তরে বারুদের মধ্যে বসে নির্ভয়ে স্বাধীনতার মন্ত্র ছড়িয়ে গেছেন এই কাজটিও তাঁরা নিশ্চয়ই করতেন। কেননা বুদ্ধিজীবীদের দলের প্রতি অনুগত থাকার দায়িত্ব থাকে না, দায়িত্ব থাকে দেশের ও মানুষের প্রতি অনুগত থাকার, দেশপ্রেমিক হবার। হয়তো সেক্ষেত্রে ইতিহাস অন্য পথে চলত। দেশে বর্তমানে যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটা হয়তো এরকম নাও হতে পারত।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো