মতামত

এঙ্গেলসঃ কর্ম ও দর্শণ

—রবীন গুহ

রবিন গুহ (ফাইল ছবি)

মার্কস আর এঙ্গেলসকে বলা হয় দুই হরিহর আত্মা।  ‘মার্কসবাদ’-এর সূত্রায়নের আসল রূপকার হিসেবে দেখা হয় এঙ্গেলসকে। ব্রিটেনের শ্রমিক আন্দোলন ও ইউরোপের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সঙ্গে মার্কসের পরিচয় ঘটিয়েছিলেন এঙ্গেলসই। এই দুজন মহাত্মা তাদের যৌথ জীবনের সৃজনশীল কাজ দিয়ে গোটা দুনিয়াতে হৈ-চৈ ফেলে দেন। সমাজচিন্তার জগতে একেবারেই নতুন ও বৈপ্লবিক চিন্তার  অবতারণা করেছেন তারা। তাদের এই যৌথ রচনার মাধ্যমেই তারা প্রথম তাদের দু’জনের রাজনৈতিক দর্শন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিষয়ে ঐক্যমত পোষন করেন এবং পরে তাদের যুথবদ্ধ চিন্তাকে আরো বেশি গভীরভাবে ও বস্তুগতভাবে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করার কাজে ক্রমশ এগিয়ে গেছেন তাদের সারাজীবন ধরে।তারা এই দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, চৈতন্য জীবনকে নির্ধারণ করে না, বরং জীবনই নির্ধারণ করে চৈতন্যকে। তারা দেখান যে, মূলত, সমাজের উৎপাদন পদ্ধতির উপরই নির্ভর করে সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রকৃতি। আর এই সম্পর্কসমূহই নির্ধারণ করে দর্শন, নৈতিকতা, ধর্ম ইত্যাদি চেতনাগত বিষয়। ।

ধারণা করা হয়, ১৮৪২ সালের নভেম্বরের শেষাশেষি রাইনিশচে চাইটুং সম্পাদকীয় দপ্তরে মার্কস ও এঙ্গেলস প্রথম পরষ্পরের সাথে এক সৌজন্যমূলক সাক্ষাতে মিলিত হন।  দেখা হবার পরে এই দুই কীর্তিমান ব্যক্তি পরষ্পরের এমন বন্ধু হয়ে গেলেন যে, আজও এই দুই কীর্তিমানের বন্ধুত্ব সবার মাঝে সমীহ জাগায়, বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।তাদের এই বন্ধুত্ব ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক।হলি ফ্যামিলি’র ভ্রান্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ১৮৪৪ সালে প্যারিসে মার্কস ও এঙ্গেলসের দেখাসাক্ষাত হলে মার্কস প্রস্তাব করেন তারা দু’জনে নব্য হেগেল অনুসারী বা হেগেলিয়ানদের নেতা ব্রুনো বাউয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের লেখামূহকে বা হেগেল সংক্রান্ত তাদের ব্যাখ্যাকে খন্ডন করে একটি বই প্রকাশ করবেন। সে অনুযায়ী তারা একসাথে লেখেন ‘হলি ফ্যামিলি’। বইটির মূল নাম হলো- দ্য হলি ফ্যামিলি অর ক্রিটিক অব ক্রিটিক্যাল ক্রিটিসিজম এগেইনস্ট ব্রুনো বাউয়ের এন্ড কোম্পানী’। ব্রুনো বাউয়েরের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে একাডেমিক লেভেলে প্রভাব বিস্তার  করেছিল। বাউয়ের এই ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি জার্মান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার কারণে মার্কস ও এঙ্গেলস একসাথে এই বইটি রচনা করতে উদ্যোগী হন। বইটি সম্পর্কে লেনিন এঙ্গেলসকে স্মরণ করে লেখায় লিখেছেন- “দার্শনিক বাউয়ের ভ্রাতা ও তাদের অনুগামীদের ঠাট্টাচ্ছলে করে বলা হয় ‘পবিত্র পরিবার’। উক্ত ভদ্রলোকগণ এমন সব সমালোচনার প্রচার করতেন, যার অবস্থান ছিলো বাস্তবতার উর্দ্ধে, যা ছিলো পার্টি ও রাজনীতির উর্দ্ধে, যা সমস্ত ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপ প্রত্যাখ্যান করে থাকে, যা পারিপার্শ্বিক জগত ও তার চারপাশের ঘটনাবলী নিয়ে কেবলমাত্র ‘খুঁতসন্ধানকারী’ হিসেবে অনুধ্যানে ব্যাপৃত থাকত। উক্ত ভদ্রলোকগণ, বাউয়ের ভ্রাতৃদ্বয়গণ, শ্রমিকশ্রেনীকে বুদ্ধিবিবর্জিত জনতা হিসেবে উন্নাসিকতার চোখে দেখে থাকে। মার্কস ও এঙ্গেলস নিরন্তর এই উদ্ভট ও ক্ষতিকারক প্রবণতার বিরোধিতা করেছেন।” কারো কারো মতে, বইটিতে  তারা লিখনীর মাধ্যমে সেসময়কার রাষ্ট্র,চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্ম ও সম্পত্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। এছাড়া, ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কসের সাথে যৌথভাবে ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ রচনা করেন।

মার্কসের তত্ত্ব যে বৈজ্ঞানিক তার দার্শনিক ভিত্তি রচনা করেন এঙ্গেলস। তিনি মনে করেন, প্রকৃতিবিজ্ঞানের সাহায্যে যেমন প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তেমনি মার্কসের তত্ত্বের মাধ্যমেও মানুষের সামাজিক জীবন ও ইতিহাসের বিকাশমান ঘটনাগুলোর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাঁর মতে, বৈজ্ঞানিকতা যে শুধু সমাজতন্ত্রের বীক্ষাতেই সীমাবদ্ধ তা নয়, মার্কসের আলোচনা পদ্ধতিই মূলতঃ বৈজ্ঞানিক।

আবার, বস্তুবিশ্বের প্রকৃতি ও স্বরূপ যে দ্বন্দ্ববাদ নির্ধারিত-এই বক্তব্যের প্রতিষ্ঠাই এঙ্গেলস এর বিজ্ঞান গবেষণার প্রেরণা। আমাদের চিন্তাকাঠামো দ্বন্দ্ববাদী গড়নের বলে বস্তুবিশ্ব ঐরকম মনে হয়, তা নয়, আসলে বস্তুবিশ্বই  দ্বন্দ্ববাদী ধাঁচে বিকশিত হচ্ছে। স্হিতি বিশ্বের স্বরূপ নয়, নিয়ত স্ফুটনোন্মুখ বিকাশমান এই স্বরূপের উপযুক্ত বর্ণনার ভাষাই দ্বন্দ্ববাদ। এভাবে এঙ্গেলস বিজ্ঞান ও দর্শণকে একসূতোয় বেঁধে ফেলার প্রয়াস নিয়েছেন। এই বিষয়ে তাঁর মৌলিক গ্রন্হ হচ্ছে ‘ডায়ালেটিকস অব নেচার’। এসব নিয়ে ‘আ্যান্টি ডুরিং’ নামক আরো একটা বই লিখেন যা প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে। ড্যুরিং সেসময় মার্কসের ‘ডাস ক্যাপিটাল’ এর প্রথম খন্ডের রিভিও লিখে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। মূলতঃ ড্যুরিং এর সমালোচনা করে এঙ্গেলস  ‘আ্যান্টি ডুরিং’ বইটি লিখেন। এই বইয়েরই তিনটি অধ্যায় নিয়ে পরবর্তিতে ‘সোশালিজমঃ ইউটোপিয়ান এ্যান্ড সায়েন্টিফিক’ নামে আলাদা বই প্রকাশিত হয়। বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ নিয়ে এঙ্গেলস এর ধারণা এই বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

বন্ধু মার্কসের মৃত্যুর পর তার অনেক অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনা ও প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এঙ্গেলস। মার্কসের মৃত্যুর পরে তিনি সেই বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড-দুটি সম্পাদনা করেন। আরো তিনি মার্কসের “উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব” বিষয়ের নোটগুলো একত্রিত করেন এবং এগুলো পরে “পুঁজি”র চতুর্থ খণ্ড হিসেবে প্রকাশিত হয়। মার্কসের সারাজীবনের কাজকে তিনি বিজ্ঞানের অগ্রগতি হিসেবে দেখেন। মার্কসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, “Just as Darwin discovered the law of development of organic nature, so Marx discovered the law of human history.”

একবার মার্কস এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন যে তিনি (মার্কস) সবসময়ই তাঁর পথকে অনুসরণ করেন। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিবিসি-র করা এক সমীক্ষায় ‘বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তক’ মার্কসের এমন উক্তি বাস্তবে এঙ্গেলসকে, মার্কসের গভীর স্বীকৃতি।

সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক, লেখক ও রাজনীতিবিদ ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮২০ সালের ২৮ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মানব মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম এই পথিকৃতের জন্মদিনে শ্রদ্ধান্জলী।

তথ্যসূত্রঃ

১)উইকিপিডিয়া

২)নির্বাচিত রচনা সংগ্রহঃ আন্তোনিও গ্রামশি(প্রথম খন্ড)