বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১২৪): বিশ্বকাপ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

বিশ্বকাপ ক্রিকেট শেষ হল। সমস্ত টুর্নামেন্ট ভালো খেলে ফাইনালে ভারতের ভরাডুবি ঘটল। আসলে ২০১৩ সালের পর থেকে টীম ইন্ডিয়া বেশ কয়েকবারই শেষ পর্যন্ত ঘাঁটে নৌকা ভেড়াতে পারেনি। তাই কষ্টের হলেও এটা নতুন কিছু নয় – না টীম ইন্ডিয়ার না তার ফ্যানদের জন্য। ভাবলাম ক্ষতি কী যদি এ উপলক্ষ্যে বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে দু কলম লিখে ফেলি, যদিও ক্রিকেটের ক ও বুঝি না। কোন দিন খেলিনি। ছোটবেলা থেকেই রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনে এসেছি। এখনও  মনে আছে কী ভোর সকাল, কী রাত দুপুর, কী স্বাভাবিক সময় – যখনই কোথাও টেস্ট ক্রিকেট খেলা হত কানের কাছে রেডিও নিয়ে বসে থাকতাম। বলতে গেলে বাড়ির সবাই। আর নিজেরা খেলতাম ফুটবল, ভলিবল, দাড়িয়াবাঁধা, হাডুডু ইত্যাদি। তখনও ক্রিকেট গ্রামে জনপ্রিয় ছিল না আর ছিলনা খেলার সরঞ্জাম, মাঠ – যদিও ফুটবলও আমরা খেলতাম বিভিন্ন ফাঁকা জমিতে। বাড়িতে খেলাধুলার নিয়ম কানুন নামে একটা বই ছিল, সেখানে ক্রিকেটের নিয়মও ছিল, তবে জানা হয়নি। আর ছিল স্পোর্টস স্টার সহ অন্যান্য পত্রিকা। আমি সেখান থেকে ছবি কেটে কেটে অ্যালবামে সেটে রাখতাম। এখন আগের মত ওভাবে খেলা আর দেখা হয় না। মূলত মাঝে মধ্যে স্কোর দেখি। যেহেতু জানি হার আর জিতের সম্ভাবনা ৫০/৫০ তাই মন খারাপ করি না। একদল জিতলে একটু বেশি খুশি হই, অন্যদল জিতলে কম। আসলে প্রায় সব দলেই আমার কিছু কিছু প্রিয় খেলোয়াড় আছে, তাই মন খারাপ করার সময় নেই। শুনেছি আমাদের দেশের কিছু কিছু পরিবারের লোকজন নাকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মী, তাই যারাই ক্ষমতায় আসুক, এসব পরিবার সব রকম ঝড়ঝাপটা এড়িয়ে যায়। খেলাধুলোর ক্ষেত্রে আমারও সেই অবস্থা। বিভিন্ন খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী অনুসারে বিভিন্ন দলকে সমর্থন করি। তাই যাকে বলে, খেলাটাই উপভোগ করার চেষ্টা করি, কারো হারজিৎ নয়। তবে এবারের বিশ্বকাপে ফেসবুকে বিভিন্ন ধরণের কমেন্ট দেখে আবার বুঝলাম আমরা বাঙালিরা আর কিছু পারি না পারি অন্যের সমালোচনা করতে কার্পণ্য করি না। গ্রামে একটা কথা ছিল, জীবনে আর তো কিছুই ত্যাগ করতে পারি না, তাই বেশি বেশি মল মূত্র ত্যাগ করি। আমাদের সেই অবস্থা। যদি জয়ের আনন্দ না পেতে পারি অন্তত অন্যদের সমালোচনা করে একটু গা গরম করি। আর এসব ক্ষেত্রে আমরা ভক্তিতে যেমন অন্ধ, ঘৃণায় তার শতগুন।

না না, খেলা নিয়ে আমার তেমন কথা নেই। কথা শুধু এ নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্যে। প্রথমত বাংলাদেশের খেলা নিয়ে। ভালো খেলেনি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, তবে চারিদিক থেকে সবাই যেভাবে উপদেশ দিতে শুরু করল তা দেখে আমার এক পুরানো সোভিয়েত চুটকি মনে পড়ে যায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নে আর্মেনিয়ান রেডিও নামে এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে শ্রোতারা বিভিন্ন প্রশ্ন পাঠাত, আর সেই অনুষ্ঠান থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিত। স্বাভাবিক ভাবেই সেটা ছিল জোক। তেমন এক জোক। শ্রোতা প্রশ্ন করছে

আইফেল টাওয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে জন সম্মুখে বান্ধবীকে চুমু দেওয়া যাবে?
না।
কেন?
নীচে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার লোকজন কীভাবে চুমু খেতে হবে সে ব্যাপারে উপদেশ দিয়ে তোমাদের মাথা খারাপ করে ফেলবে।

আমাদের অবস্থাও তাই। খেলে মাত্র এগার জন, টিমে সব মিলিয়ে মনে হয় জনা বিশেক। আর তাদের নিরলস ভাবে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে ১৭ কোটি মানুষ। সবার উপদেশ শুনতেই দিন কাবার, খেলার সময় কোথায়?

তবে বাংলাদেশ দলের যেটা একেবারেই ভালো লাগেনি সেটা হল তাদের মনোভাব, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। আফগানিস্থান, নেদারল্যান্ড এরা হারুক আর জিতুক – লড়াই করেই সেটা করেছে। সমস্যা হারজিতে নয়, সমস্যা আটিচুডে, সমস্যা মনে হয় দলের অভ্যন্তরে।

অস্ট্রেলিয়া আর সাউথ আফ্রিকার দ্বিতীয় সেমিফাইনালে শুরুতে কয়েকটি উইকেট হারানোয় অনেকেই সাউথ আফ্রিকাকে চোকার বলে গালি দিচ্ছিল, কিন্তু তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিল, বিনা যুদ্ধে পরাজয় মানেনি। এই যে শেষের আগেই সব কিছু শেষ করে ফেলার মনোভাব – এটাও মনে হয় একান্তই আমাদের।

সবচেয়ে মজা লেগেছে পাকিস্তানের কোন কোন প্রাক্তন ক্রিকেটার ভারতীয় বোলারদের বিরুদ্ধে বিশেষ বল ব্যবহারের, টসে চিট করার আর পীচ বদলানোর অভিযোগ তোলায়। এটা ঠিক প্রথমে যে পীচে খেলার কথা ছিল, পরে ঠিক সেখানে খেলা হয়নি, তবে উভয় দল একই পীচে খেলেছে। এমনকি ওয়াসিম আকরামের মত বিশ্বনন্দিত খেলয়াড়রা এর বিরোধিতা করতে বাধ্য হয়েছেন। এরা তো সবাই কমবেশি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। আচ্ছা, দামী কলম থাকলেই কি কেউ রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল হতে পারে? আঁকার দামী রঙ তুলি থাকলেই কি যে কেউ দাভিঞ্চি হতে পারে? আবার পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী আইনস্টাইনকে বললেই কি তিনি মানুষের শরীরে অস্ত্রপ্রচার করতে পারেন? একজন ভাল বল করতে পারে, একজন ভালো ব্যাট করে। আর এদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটা দল। ঠিক যেমন সমাজে থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জেলে, কৃষক, তাঁতি। সবারই সবাইকে দরকার। একেক জনের একেক রকম স্কীল। টেকনিক্যাল সরঞ্জাম গুরুত্বপূর্ণ, তবে স্কীলটাই আসল। যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। সমস্যা বলে নয়, সমস্যা সামির স্কীলে, সামির সাফল্যে। বাংলাদেশের ফ্যানদের যেমন সাকিব-তামিম বিতর্ক, ভারতের ফ্যানদের তেমনি রোহিত-কোহলি। অনেকেই বলছে কোহলি নিজের জন্য খেলছে, সেঞ্চুরির জন্য স্লো খেলছে। মানলাম। কিন্তু যদি বেপারোয়া পেটাতে গিয়ে আউট হত তাহলে তার করা রানগুলো দল মিস করতেই পারত। মনে রাখা দরকার জাদেজার পরে বোলাররা কেউ তেমন রান করতে পারে না আর এটা ভারতের বড় সমস্যা। এ কারণেই প্রথম দিকে সামি দলে জায়গা পায়নি। ভাগ্য ভালো যে এদের প্রায় কাউকেই ব্যাট করতে হয়নি, যদি হত? হলে কি হয় সেটা আমরা জানি। ফাইনালে দেখেছি। অনেকদিন আগে সচীন তেন্ডুলকারের এক সাক্ষাৎকার শুনেছিলাম –
যেকোনো ব্যাটসম্যানকে আউট করতে একটা বলই যথেষ্ট, কিন্তু বোলার খারাপ বল করেও কম করে দশ ওভার বল পায়। রুশেরা বলে স্যাপার বা মাইনাররা শুধু একবারই ভুল করতে পারে। ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রেও তাই। কী রোহিত, কী কোহলি, কী সাকিব, কী মাহমুদুল্লাহ – সবাই নিজ নিজ দেশের জন্য খেলছে। প্রথমত তারা দল তারপর ব্যক্তি। কারণ ক্রিকেট দলগত খেলা। সেখানে প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে। বাইরে থেকে যখন দলের বিভিন্ন খেলোয়াড়দের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাতে পারে এরকম মন্তব্য করা হয়, সেটা আর যাই হোক দল বা দেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না। যেখানে আশ্বিনের মত বোলার প্রথম একাদশে স্থান না পেয়েও হাসিমুখে দলের ভেতর আন্তরিক পরিবেশ বজায় রাখতে ব্যস্ত – আমরা এদের মধ্যে বিভিন্ন কোন্দল খুঁজে সেটাই নষ্ট করছি। এমন ফ্যান থাকতে আর প্রতিপক্ষের দরকার হয় না। তবে এতে অবাক হবার কিছুই নেই। প্রতিদিনই লোকজন ফেসবুকে বাবা-মা আর সন্তানকে, স্বামী ও স্ত্রীকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করিয়ে পোস্ট দিচ্ছে। ঐক্য নয়, ভাঙ্গনটাই যখন সব কিছুর মূলে তখন অন্য সুর আসবে কোত্থেকে? হয়তো আমরা ভুলেই গেছি মান্না দের সেই গান

আমার না যদি থাকে সুর তোমার আছে তুমি তা দেবে
তোমার গন্ধহারা ফুল আমার কাছে সুরভি নেবে
এরই নাম প্রেম এরই নাম প্রেম।

আমাদের প্রেম নেই।

সবচেয়ে মজা লাগল যখন কেউ কেউ খেলার মাঝে ভারতের পক্ষে পীচ সরানোর অভিযোগ তুলল। আমি কল্পনায় ভেবে দেখার চেষ্টা করলাম, ভারত কত উন্নত হলে হাজার হাজার দর্শকের সামনে, কোটি কোটি টিভি দর্শকের সামনে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে এটা করতে পারে। আমার মনে পড়ল সত্তরের দশকে আনন্দমেলার পূজা সংখ্যার একটা গল্প। খুব সম্ভব সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের।
সেবার দেবতা আর অসুরেরা ঠিক করলেন এবার আর যুদ্ধ নয়, ক্রিকেটের মাঠে বিবাদ মীমাংসা হবে। অসুররা ব্যাট করছে। কার্তিক বল করছে। সবার চোখের আড়ালে সে ধনুকে বল লাগিয়ে তীরের মত ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর উইকেটকিপার গনেশ শুঁড় দিয়ে অসুরের পা টেনে ধরেছে। অন্য দিকে দেবী দুর্গা দশ হাত ব্যবহার করে ক্যাচ লুফে নিচ্ছে।
হয়তো এবারের বিশ্বকাপেও কোন অদৃশ্য শক্তি সকলের চোখে ধুলো দিয়ে ভারতের পক্ষে এসব করছে। আমরা যেমন দলপ্রেমকে দেশপ্রেম বলে মনে করি ঠিক একই ভাবে ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও দলপ্রেমকে ক্রিকেট প্রেম বলে মনে করি। আর এর ফলে ক্রিকেটের সৌন্দর্য নয়, বিভিন্ন দলের খেলোয়াড়দের কোন্দল, সমস্ত লজিককে ঝেটিয়ে দূর করে অপছন্দের দল জিতলে সেই জয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করা এটাই যেন আমাদের মূল উপভোগ্য। এটাও বর্তমানের সামাজিক চিত্র। কেননা বিভিন্ন তারকাদের দৈনন্দিন জীবনের স্ক্যান্ডাল যত প্রচার ও লাইক পায়, অন্য কিছুই সেটা পায় না। আসলে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে ঐক্য নয় ভাঙনই চালিকাশক্তি ক্রিকেট কেন বাদ যাবে? এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল, অনেক দিন আগে ফেসবুকে পড়া।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১২৩): লৌহ যবনিকা -বিজন সাহা

এক ছেলে রচনা লিখতে বললেই গরুর রচনা লেখে। গরু গৃহপালিত প্রাণী। গরু আমাদের দুধ দেয়।……. একবার শিক্ষক বিরক্ত হয়ে তাকে কুমিরের রচনা লিখতে বললেন। সে শুরু করল – এক নদীতে একদিন এক কুমির এলো। সকালে সে নদীর চরে রোদ পোহাত। একদিন এক গরু এলো নদীতে জল খেতে। গরু গৃহপালিত প্রাণী……
আমাদের অবস্থাও তাই। যেকোন ব্যাপারেই কথা হোক না কেন নিজের দলীয়, ধর্মীয়, জাতীয় যত রকমের পরিচয় আছে সেটা প্রকাশ করতেই হবে। আমরা নিজেদেরকে ভালোবাসা বা ঘৃণার বেড়াজালে এমন ভাবে আটকে রেখেছি যে এর বাইরেও যে একটা বিরাট পৃথিবী আছে সেটা নিয়ে ভাবার অবকাশ পাই না। বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন স্ট্যাটাস যতটা না ক্রিকেটের তারচেয়ে বেশি নিখুঁত করে আমাদের সমাজের বর্তমান চিত্রটা তুলে ধরেছে।

ফাইনাল খেলা শেষে আরও যেটা লক্ষ্য করলাম ফেসবুকের বাংলা সিগমেন্টে – তা হল অস্ট্রেলিয়ার জয়ের চেয়ে বহু গুণ বেশি মানুষ ভারতের পরাজয় উদযাপন করছে। দু একটা ভিডিওতে আনন্দ মিছিল পর্যন্ত দেখলাম। সাথে কিছু জোক। যেমন ভারতের পরাজয়ের আনন্দে চিৎকার করে এক ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এখন ভিসার লাইনে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসার জন্য ভারত যাবে বলে। জোক হলেও আমাদের বাস্তবতা এখানেই। আমি রাশিয়ায় থেকে দেখেছি অন্ধ রুশ বিরোধিতা ইউক্রেনে কী পরিণতি ডেকে এনেছে। বাল্টিকের বিভিন্ন দেশ, জর্জিয়া, মালদোভা, এমনকি ফিনল্যান্ড একই পথে হাঁটছে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ এখন অর্থনৈতিক মন্দার শিকার। না, আমি বলছি না যে যুদ্ধের দামামা সেখানে বাজবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মাঝে শুধু দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অফিসিয়াল সম্পর্কই থাকে না, থাকে অসংখ্য অলিখিত সম্পর্ক যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। চিকিৎসা, শিক্ষা, খাদ্য, ভ্রমণ – কোন বিষয়ে ভারতের সাথে আমাদের লেনদেন নেই। মনে হয় বাণিজ্যিক দিক থেকে ভারত আমাদের অন্যতম প্রধান পার্টনার। উল্লেখ করা যেতে পারে যে শত বৈরিতার মধ্যেও ভারত ও পাকিস্তান দীর্ঘদিন পরস্পরের সবচেয়ে সুবিধাভোগী বাণিজ্যিক পার্টনার ছিল। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের পরস্পরের উপর নির্ভর করে চলে হয় সেখানে এই আনন্দ কি আমাদের দুর্বলতার প্রকাশ নয়। ইউক্রেন চেয়েছিল। কী পেল? এমনকি যুদ্ধের আগেই তাদের অর্থনীতি দেউলিয়া হয়ে গেছিল। কেউ কেউ লিখছে আমরা ভারতবিরোধী নই, মোদি সরকার বিরোধী। কিন্তু খেলছে তো সরকার নয়, খেলছে দেশ। দেশের মানুষের সবাই তো আর বিজেপি নয়। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ক্ষমতায় বলে আমি বাংলাদেশের বিরোধিতা করব – এটা কি কোন কথা হল? বলতে পারেন মানুষই তো বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছে। মানুষ আনেনি, এনেছে আপনার ভালো লাগা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা। এইতো আর্জেন্টিনার নতুন প্রেসিডেন্ট যিনি জাতীয় মুদ্রা বাতিল করতে চান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বন্ধ করতে চান – এক কথায় দেশদ্রোহী কথাবার্তা বলেন – মানুষের ভোটে জিতে গেলেন। কারণ যারা দেশপ্রেমের কথা বলে তারা মুদ্রাস্ফীতি ছাড়া কিছু দিতে পারেনি। আজ যে ভারতের উন্নয়ন তার পেছনে বিজেপির অবদান আছে। না, বিজেপির রাজনৈতিক ভাবনা নয়, তার হিন্দুত্ববাদ নয়। বিজেপি একটা স্থিতিশীল সরকার দিতে পেরেছে। অর্থনীতি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুব পছন্দ করে। এখানে অন্য যেকোনো দল হতে পারত। কিন্তু অন্যেরা পারেনি। কারণ, কী বাম, কী গণতান্ত্রিক – সেসব দলগুলো নিজেদের মধ্যে রেষারেষিতে এত ব্যস্ত যে স্থিতিশীলতা কি সেটাই তারা ভুলে গেছে। তাই ভারতের মানুষকে নয়, সেখানকার তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তবে অন্যের কষ্টে উল্লাস নতুন কিছু নয়। আজকাল নাকি বিভিন্ন দেশে লোকজন বিয়ের চেয়েও বেশি ঘটা করে বিবাহ বিচ্ছেদ উদযাপন করে। এ অর্থে আমরা সঠিক ট্র্যাকে।

প্রশ্ন আসতে পারে আমাদের কি নিজেদের ইচ্ছে মত কোন দলকে সমর্থন করার অধিকার নেই? বাংলাদেশের মানুষের অবশ্যই স্বাধীনতা আছে যাকে খুশি সমর্থন করার তবে কাউকে সমর্থন করা না করা আর কারো পরাজয়ে বিজয় উল্লাস করা এক জিনিস নয়। এটা ঠিক ব্রাজিল হারলে আমাদের আর্জেন্টিনার সমর্থকরা বিজয় মিছিল করে, তবে এটা যতটা না ব্রাজিলের বিপক্ষে তার চেয়ে বেশি স্থানীয় সমর্থকদের নিয়ে হাসাহাসি করতে। তাছাড়া ভৌগলিক দূরত্ব ও ভাষাগত কারণে ব্রাজিল আর ভারত এক নয়। শত অপছন্দের মধ্যেও আমাদের অনেক কিছুই ভাগ করে নিতে হয় – ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, নদী, বন, ঝড়বৃষ্টি অনেক কিছুই। বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমস্যা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এমনকি আমেরিকা ও কানাডাও সব প্রশ্নে একমত নয়। কিন্তু খেলার বাইরেও জীবন আছে। যেকোনো বড় সমস্যার শুরু হয় ছোট ঘটনা দিয়ে। আচ্ছা, এই যে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারত যাচ্ছে বা বাংলাদেশে আসছে – এ ধরণের কাজ কি সেটাকে কঠিন করবে না। আমাদের পর্যটন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবে, ভারতের চিকিৎসকরা আর ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত যারা তুলনামূলক স্বল্প খরচে চিকিৎসা পায় সেটা থেকে বঞ্চিত হবে। ইতিমধ্যে ফেসবুকেই দেখেছি ওদিক থেকেও  বিভিন্ন রকম উস্কানিমূলক লেখালেখি। বাংলাদেশের বই বয়কটের আহ্বান। আজ ফেসবুকে দেখলাম চঞ্চল চৌধুরীর মন্তব্য নিয়ে অনেক ক্যাচাল। আসলে ভারতকে সমর্থন করা বা না করার একক কোন কারণ নেই। বিভিন্ন অজুহাতে একজন যেমন ভারতকে সমর্থন করতে পারে আবার একই ভাবে ভারতের বিরোধিতাও করতে পারে। সেটা খেলার মাঠেও যেমন সত্য, জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তেমনি সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হল প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের পাশাপাশি বাস করতেই হবে, বিভিন্ন বিষয়ে আমরা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকব। সরকার যায়, সরকার আসে কিন্তু জনগণ থেকে যায়। দুই দেশের সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকার পরেও কোন না কোন ভাবে এক ধরণের সম্পর্ক বজায় রাখে, কিন্তু যদি সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরণের পারস্পরিক বিরোধিতা দেখা দেয়, সেটা দূর করা খুব সহজ নয়। জনগণের স্বার্থেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের যেমন, রাজনীতিবিদদেরও তেমনি উচিৎ এই উত্তেজনা কমিয়ে আনা। কারণ এর সাথে চলে আসে সাম্প্রদায়িকতা আর তাতে শক্তিশালী হয় মৌলবাদীদের হাত। উপমহাদেশে মৌলবাদী শক্তির রমরমা ব্যবসার মূলে রয়েছে এই ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বিরোধিতা – তা যে ইস্যুতেই হোক না কেন। কারণ এটাকে সহজেই ধর্মীয় পোশাক পরিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটা যায়।

আরও দুটো কথা না বললেই নয়। সারাদিন এ বিষয়ে বিভিন্ন পোস্ট ও তাতে মন্তব্য দেখে বুঝলাম সেদিনের খেলায় ভারতের বিপক্ষে যেমন, পক্ষেও তেমনি অসংখ্য বাংলাদেশী দর্শক ছিল। তবে বিজয় মিছিল যেহেতু শুধু যারা জেতে তারাই বের করে, তাই ভারতের সমর্থকদের সেদিন চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। আর নির্বাচন সামনে বিধায় এই ভারত বিরোধিতাকেই বিশেষ ভাবে হাই লাইট করা হচ্ছে যাতে এই মুহূর্তে দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরে। কেউ কেউ বলছে যে যেহেতু ভারতের সমর্থকরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান ও শ্রীলংকাকে সমর্থন করেছে তাই আজকের এই ভারত বিরোধিতার জন্য ভারত নিজেই দায়ী। আমিও একমত যে এ জন্যে ভারতই দায়ী। তবে ভারত আফগানিস্তান বা শ্রীলঙ্কাকে সমর্থন করেছে বলে নয়, ভারত অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে গেছে বলে। যদি ভারত বিশ্বকাপ ফাইনালে জিতত তাহলে ভারত বিরোধী এই বিজয় মিছিলের প্রশ্নই আসত না।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো